logo ৩০ এপ্রিল ২০২৫
গতিহীন আওয়ামী লীগ
তানিম আহমেদ, ঢাকাটাইমস
৩১ আগস্ট, ২০১৪ ০০:০৬:৪৭
image

ঢাকা: সাংগঠনিক শক্তি আর জনসমর্থনের দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ। কিন্তু ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর সাংগঠনিক দিক থেকে অনেকটাই গতিহীন হয়ে পড়েছে দলটি। জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে সময়মতো দলের কেন্দ্রীয় কমিটি করা হলেও জেলা কমিটিগুলো স্থবির হয়ে আছে বছরের পর বছর। সময় বেঁধে দিলেও এই গতি ফেরাতে পারেনি তারা।


আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, প্রতি তিন বছর পর পর দলের সব পর্যায়ে সম্মেলনের বিধান রয়েছে। কিন্তু পিরোজপুরে সম্মেলন হয় না ২১ বছর ধরে। ১০ থেকে ১২ বছর ধরে সম্মেলন হয় না এমন জেলার সংখ্যাও ১০টির বেশি।


দলের জাতীয় সম্মেলন হলেও অনেক জেলা-উপজেলা কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থায় থাকে। এ নিয়ে জেলায় জেলায় বাড়ছে কোন্দল। সংঘর্ষ-সংঘাতে প্রাণ হারাচ্ছে নেতা-কর্মীরা।


ঢাকা মহানগরেও আছে বিশৃঙ্খলা। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের আশঙ্কায় গঠন হচ্ছে না কমিটি। ক্ষমতায় থাকার সুবাদে টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিতে জড়াচ্ছে নেতা-কর্মীদের একাংশ। দলে শৃঙ্খলা না থাকায় কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না নেতারা।


সারা দেশে দলকে সংগঠিত করতে সাংগঠনিক সম্পাদকদের আলাদাভাবে বিভিন্ন জেলার দায়িত্ব দিয়েও সুফল মেলেনি। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সাংগঠনিক সম্পাদকদের ওপর কী ভরসা রাখব। তাদের তিন থেকে চারজন ছাড়া বাকিদের ওপর ভরসা রাখার কিছু নেই। স্বভাবতই কিছু করতে পারেননি তারা।’


এই নেতা বলেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকের অভিজ্ঞতা জেলা নেতাদের চেয়ে অনেক কম হওয়ায় এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।


এই অভিযোগ মানতে নারাজ রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন। তিনি বলেন, জেলা কমিটির প্রতিটি নেতার সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক। জেলার জ্যেষ্ঠ নেতাদের আমরা সম্মান করি। তাদের ওপর খবরদারি করি না।’


জেলা কাউন্সিল না হওয়ার কারণ হিসেবে আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘২০১২ এবং ’১৩ সালের শুরুর দিকে আমাদের তৃণমূলের সম্মেলন হয়ে গেছে। কিন্তু সাঈদীর রায়ের পর দেশব্যাপী যে অরাজকতা হয়েছিল তা মোকাবিলা করার কারণে আমরা সেই জেলা সম্মেলন শেষ করতে পারিনি। তার পর জাতীয় নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচনের কারণে এই বছর কাউন্সিল হয়নি।’


বরিশাল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছি। দায়িত্ব পাওয়ার পর সাতটি জেলার মধ্যে দুটি জেলার কাউন্সিল করা হয়েছে। ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ হয়েছে। বাকি তিন জেলায় কমিটি হবে জাতীয় সম্মেলনের আগেই।’


সিলেট বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব হলো জেলা কমিটিগুলো তদারকি করা। আমাদের সেই দায়িত্ব আমরা পালন করছি। ইউনিয়ন এবং উপজেলা সম্মেলন শেষ পর্যায়ে। সেগুলো হলেই জেলায় সম্মেলন করব।’ 


দেশের সবচেয়ে বড় এবং সংগঠিত রাজনৈতিক দল এইভাবে চলতে থাকলে গোটা দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বলে মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা।


জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের একটি পুরনো দল। এই দলে আগে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছিল। কিন্তু গত দুই দশক ধরে সেই প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। আর এই প্রক্রিয়াটি এখন প্রকট আকার ধারণ করছে দল ক্ষমতা আসার পর থেকে। আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে তারা যা করে অন্যরাও সে পথেই চলে। তাই এই দলের ভেতরে গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চা না থাকলে অন্য দলগুলোর অবস্থা হবে আরও খারাপ। আর এর প্রভাব গিয়ে পড়বে গোটা দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়।’


এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘এখনকার নেতারা মনে করেন দল ক্ষমতা মানেই বৈধ এবং অবৈধ উপায়ে টাকা কামানো। এ কারণে ওই নেতারা তাদের পদ-পদবি ছাড়তে চান না। আর কেন্দ্রীয় নেতারা ধরে নিয়েছেন দল ক্ষমতা থাকলে লোকাল নেতারা কিছু আয় করবে। জেলা নেতাদের টাকার ভাগ অনেক কেন্দ্রীয় নেতাই পেয়ে থাকেন।’  


এ সমস্যার সমাধান কি? জানতে চাইলে গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যে এই সমস্যার সমাধান করতে চায়নি সেটা বলা যাবে না। তারা চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। তিনি মনে করেন, ‘দলের মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞ এবং ত্যাগী নেতাদের যদি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয় তাহলে সমস্যার সমাধান হবে।’


 


কোন্দলে জর্জরিত দল


দীর্ঘদিন সম্মেলন না হওয়ায় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন জেলার নেতারা। আবার অনেক জেলায় দিবসভিত্তিক ছাড়া কোনো কর্মসূচিই পালন করা হয় না।


সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মজিবুর রহমান, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক ও আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মীর মোসতাক আহমেদ রবির মধ্যে বিরোধ দানা বেঁধে উঠেছে। ১১ বছর ধরে সম্মেলন না হওয়ায় সাংগঠনিক কার্যক্রমও ঝিমিয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে জামায়াত-শিবির।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, ‘সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কারণে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পরও এ জেলায় জামায়াতের আধিপত্য বেড়েছে। তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে দলের কোনো নেতা-কর্মীকে নন, চাকরি দিয়েছেন জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের।’


এ বিষয়ে রুহুল হকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।


সিলেটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। এই নেতাদের দ্বন্দ্বের কারণে সাংগঠনিক কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে।


মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। দলের সব কর্মসূচি আমরা একসঙ্গে পালন করি। তিনি বলেন, সিলেট মহানগরের ২৩টি ওয়ার্ড সম্মেলনের মধ্যে ১০টিতে অর্থমন্ত্রীসহ আমরা (বদরউদ্দিন আহমদ কামরান) সবাই ছিলাম।’


কোন্দলমুক্ত নয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর জেলা শেরপুরেও। সরকার ও দলে প্রভাবশালী হলেও নিজ জেলায় দলীয় কোন্দল মেটাতে মতিয়া চৌধুরীর উদ্যোগী ভূমিকাও চোখে পড়েনি। কোন্দল মতিয়া চৌধুরীর নিজ নির্বাচনী এলাকাতেই। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আতিউর রহমান আতিক ও মতিয়া চৌধুরীর মধ্যে বিরোধের কারণে আতিকের নিজ উপজেলায় বিগত ৬ বছরে একদিনও পা রাখেননি কৃষিমন্ত্রী।


সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান বাদশার সঙ্গেও মতিয়া চৌধুরীর দ্বন্দ্ব পুরনো। ২০০৪ সালে সম্মেলন হলেও আর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।


মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গে বিরোধ এই কথাটি অস্বীকার করে জেলা সভাপতি আতিউর রহমান আতিক বলেন, ‘ওনার সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। তিনি কেন্দ্রীয় নেতা। আর আমার আসনে তো ওনার কোনো কাজ নেই।’


তাহলে জেলা সম্মেলন হচ্ছে না কেন? জানতে চাইলে আতিউর রহমান বলেন, ‘সম্মেলনের প্রক্রিয়া চলছে। তবে কখন হবে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান বিষয়টি।’


নারায়ণগঞ্জে সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। এতে নাজমা রহমানকে সভাপতি, এ কে এম শামীম ওসমানকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। ২০০২ সালে এ কমিটি ভেঙে আকরাম হোসেনকে আহ্বায়ক করে কমিটি করে দেওয়া হয়। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন নিয়ে মনোমালিন্য হওয়ায় ২০১১ সালের ১ নভেম্বর তিনি পদত্যাগ করলে সংগঠনে স্থবিরতা নেমে আসে। এরপর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম। বরং নানা ইস্যুতে বিতর্কিত হয়ে পড়ছে জেলার নেতৃত্ব।


নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাবেক আহ্বায়ক এস এম আকরাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, সাংগঠনিকভাবে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের অবস্থান কখনোই ভালো ছিল না। তার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে জেলা কমিটি নেই। এ অবস্থায় একটি সংগঠনের যা হওয়ার তাই হয়েছে।


নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে জেলা কমিটি নেই। তাই নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের অভিভাবক কে তা নিয়ে মতপার্থক্য বাড়ছে। যে যেভাবে পারছে দলের ক্ষমতাকে অপব্যবহার করছে। দোষারোপের রাজনীতির সংস্কৃতি মূলত এ কারণেই।’


আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘শিগগিরই জেলা কমিটি দেওয়া হবে বলে কেন্দ্র থেকে আশ্বাস পাওয়া গেছে। কমিটি হয়ে গেলে দল অনেকটা গোছানো অবস্থায় চলে আসবে।’


বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও মহানগর সাধারণ সম্পাদক আফজালুল করিমের মধ্যে বিরোধ আছে।


জানতে চাইলে বরিশাল মহানগর সাধারণ সম্পাদক আফজালুল করিম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘তিনি (হাসানাত আবদুল্লাহ) বড় নেতা। কেবল বড় নেতাই নন, তিনি বঙ্গবন্ধু পরিবারের একজন সদস্য। তার সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই। জাহাজের সঙ্গে কি ডিঙ্গি নৌকার লড়াই হয়।’  


পাবনা, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা, বগুড়া, ময়মনসিংহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ফেনীসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়ও কোন্দল দেখা দিয়েছে।


ক্ষমতাসীন দলে কোন্দলের প্রকাশ দেখা গেছে সদ্য সমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনে। সারা দেশে দুই শরও বেশি উপজেলায় একাধিক প্রার্থী ছিল আওয়ামী লীগে। দলের নেতাদের মধ্যে ভোট ভাগাভাগির সুযোগে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী অবস্থানÑ এমন উপজেলায়ও জিতেছে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা। কোনো কোনো উপজেলায় জেলা কমিটি এবং উপজেলা কমিটি প্রার্র্থী দিয়েছে আলাদা। কোথাও বা স্থানীয় সংগঠন একজনকে সমর্থন দিয়েছে তো সংসদ সদস্য সমর্থন দিয়েছেন অন্যজনকে। কোথাও আবার একজন মন্ত্রী ছিলেন এক প্রার্থীর পক্ষে আবার সংসদ সদস্য ছিলেন আরেক জনের পক্ষে। দ্বন্দ্ব মেটাতে কেন্দ্রীয় নেতাদের দায়িত্ব দিয়েও তার সমাধান করতে পারেননি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বহিষ্কারের হুমকি, কোথাও কোথাও বহিষ্কার কোনো কিছুই দলে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেনি।  


সময় বেঁধে দিয়েও কাজ হয়নি


অন্যদিকে সাত সাংগঠনিক জেলায় কাউন্সিলের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করেও শেষ পর্যন্ত কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়নি। জেলাগুলো হলো, মুন্সিগঞ্জ, বরগুনা, পটুয়াখালী, কিশোরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, খুলনা মহানগর এবং রাজশাহী মহানগর।


২১ জুনের মধ্যে মুন্সিগঞ্জ, ২৬ জুনের মধ্যে বরগুনা, ২৭ জুনের মধ্যে পটুয়াখালী, ২৮ জুনের মধ্যে কিশোরগঞ্জ, ১২ জুলাইয়ের মধ্যে ঠাকুরগাঁও, ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে খুলনা মহানগর এবং ১৯ জুলাইয়ের মধ্যে রাজশাহী মহানগরের সম্মেলনের সময় বেঁধে দেয় কেন্দ্র। এর মধ্যে সম্মেলন হয়েছে কেবল মুন্সিগঞ্জে।


জানতে চাইলে মুন্সিগঞ্জে আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের সম্মেলন হয়েছে। কমিটির তালিকা আমরা কেন্দ্রে পাঠিয়েছি।’


সূত্রে জানা গেছে, অনেক সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং নেতাদের দ্বন্দ্বের কারণে সম্মেলন হয় না অনেক জেলায়। অনেক নেতাই চান না দল ক্ষমতাই থাকতে নতুন নেতৃত্ব আসুক। কারণ সে ক্ষেত্রে পদ হারাতে পারেন তারা।


আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘দল ক্ষমতায় আছে। এই সময় যদি তারা (জেলা নেতারা) কোনো পদে দায়িত্বে থাকেন তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে পারবেন। আর এ জন্য কেন্দ্রের নির্দেশ সত্ত্বে¡ও তা পালন করেন না তারা।’


বিভিন্ন জেলায় বেঁধে দেওয়া তারিখের মধ্যে সম্মেলন কেন হয়নিÑজানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘জুন-জুলাইয়ে  রোজা হওয়ায় সে সময় ঘোষিত কাউন্সিল হয়নি। সে সময় ছিল ইফতারের রাজনীতি। আর এখন শোকের মাস চলছে । এই মাসে আমাদের ওই ধরনের কোনো কর্মসূচি হয় না।’


সারা বছরই তো এ রকম কিছু না কিছু থাকে, তাহলে দল গোছানো হবে কেমন করে জানতে চাইলে লেনিন বলেন, ‘সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যেই হয়ে যাবে কোনো কোনো জেলায়। বাকিগুলোতেও সুবিধামতো সময়ে হবে সব কিছু।’


শেখ হাসিনা ও সৈয়দ আশরাফের জেলায় করুণ দশা


দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জেলা গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগ চলছে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দিয়ে। এখানে সব শেষ সম্মেলন হয় ১০ বছর আগে ২০০৪ সালে। এতে সভাপতি নির্বাচিত হন মোহাম্মদ আলী খান আবু মিয়া এবং সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী এমদাদুল হক। আবু মিয়া মারা গেলে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পান রাজা মিয়া বাটু। এই জেলার মেয়াদ শেষ হওয়া কমিটি চলছে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দিয়ে। কাশিয়ানী ছাড়া জেলার অন্য থানা ও ইউনিয়ন কমিটিগুলোর অবস্থাও প্রায় একই।


ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাজা মিয়া বাটু ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এটি প্রধানমন্ত্রীর নিজের জেলা। এই জেলার সম্মেলনের সময় তিনি নিজেই ঠিক করবেন।’


আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের জেলা কিশোরগঞ্জে সম্মেলন হয় না ১৬ বছর ধরে। এই জেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুইজনই ভারপ্রাপ্ত। ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক গোলাপ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এলে স্পিকার নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ। ওই একই বছর মারা যান সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক গোলাপ। তারপর থেকে ৬ বছর ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্ব দিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি চলছে। বর্তমানে এ কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম। তিনি সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের চাচা। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রয়েছেন এম এ আফজল।


ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এম এ আফজল ঢাকাটাইমসকে বলেন, আগামী ডিসেম্বরে হবে সম্মেলন। কেন্দ্র নির্ধারিত সময়ে কেন কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটা সম্মেলন করতে হলে অনেক প্রস্তুতি লাগে। তাই আমরা কেন্দ্র নির্ধারিত সময়ে তা করতে পারিনি।’


তিন বছর আগে মারা যান ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাসিবুল হাসান লাবলু। এরপর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান সৈয়দ মাসুদ হোসেন। পিরোজপুর জেলা সম্মেলন হয় না ২১ বছর। ২০০৪ সালের ২৯ অক্টোবর পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুধাংশু শেখর হালদার মারা যান। সেই থেকে জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আকরাম হোসেন।


২০০৯ সালে রমেশ চন্দ্র সেন আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেলে ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন মকবুল হোসেন বাবু। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নতুন মন্ত্রিসভায় জায়গা হয়নি রমেশ চন্দ্র সেনের। কিন্তু এখনো মকবুল হোসেনই ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে জেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বে আছেন।


দুই বছর আগে ঘোষিত নতুন কমিটিতে রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন আবুল মনসুর আহমেদ। তিনি মারা গেছেন। তার জায়গায় ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বে আছেন মমতাজ উদ্দিন আহমেদ। গাইবান্ধা জেলা সম্মেলন হয় ২০০৫ সালে। ওই সময় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন মোহাম্মদ খালেদ। পরের বছর তিনি মারা গেলে সৈয়দ শামসুল আলম হিরু ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পান।


মেয়াদ পার হওয়া নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হানিফ আলী শেখ মারা যান ২০১২ সালে। তার মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন সাবেক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার।


২০০৭ সালের ৫ নভেম্বর মারা যান সিরাজগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল লতিফ মির্জা। তারপর থেকেই ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন মোস্তাফিজুর রহমান।


মারা গেছেন কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রশিদুজ্জামান দুদু। এর পর থেকেই জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি খন্দকার জুলফিকার আলী আরজু।


মাগুরা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলতাফ হোসেন মারা যান গত বছর। সেই থেকে জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তানজেল হোসেন খান।


২০১০ সালের ২২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লুৎফুল হাই সাচ্চু মারা যাওয়ার পর সৈয়দ এমদাদুল বারীকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়। সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবীরের শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। তিনি কথা বলতে পারেন না। বর্তমানে জহিরুল হক খান ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন।


কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এ কে আহম্মদ হোছাইন। ২০০৩ সালে আলী আশরাফ কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক হওয়ার পর কুমিল্লা (উত্তর) জেলার সভাপতির পদ ছাড়েন। তখন থেকে আবদুল আউয়াল সরকার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। কুমিল্লা (দক্ষিণ) জেলা পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালের (লোটাস কামাল) নেতৃত্বে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলছে।


নোয়াখালী জেলা সভাপতি মারা যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন খায়রুল আনম সেলিম।


নারায়ণগঞ্জ জেলা আহ্বায়ক কমিটির সভাপতি এস এম আকরাম দল ছেড়েছেন আগেই কিন্তু এই পদে আর দায়িত্ব দেওয়া হয়নি কাউকে।


মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের শেষ সম্মেলন হয়েছিল ২০০৬ সালের জুলাইয়ে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছাড়া আর কোনো কর্মকর্তা এখানে নির্বাচন করা হয়নি। জেলা কমিটির সভাপতি ফেরদৌস জমাদ্দার মারা যাওয়ার পর কাউকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না সহসভাপতি পদে কেউ না থাকায়।


নেত্রকোণা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুজ্জোহাকে দল থেকে বহিষ্কারের পর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মতিয়ার রহমান খান। ৯ বছর আগে এ জেলার সম্মেলন হয়েছিল।


সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুইজনই ভারপ্রাপ্ত। ১৯৯৯ সালের সম্মেলনে নির্বাচিত সভাপতি আবদুস জহুর মারা যাওয়ার পর ৬ বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন মতিউর রহমান। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন নুরুল হুদা মুকুট।


 


মহানগর আওয়ামী লীগে যাচ্ছেতাই


ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কমিটি হয়েছিল ২০০৩ সালের ৪ জুন। ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ মারা যাওয়ার পর থেকে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগে সভাপতির পদটি চলছে ভারপ্রাপ্ত দিয়ে। এ পদে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এম এ আজিজ।


৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেই ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ কমিটি পুনর্গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। কিন্তু ভোটের আগে নতুন করে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তৈরি করতে চায়নি বলে সে উদ্যোগ নেয়নি দল। আর ক্ষমতায় আসার পর স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে তৈরি হয়েছে নতুন পরিস্থিতি।


চট্টগ্রাম ও সিলেটের কমিটি এক যুগ পার করার পর গত বছর সম্মেলন ছাড়াই নতুন কমিটি করা হয়েছে। একই অবস্থা রংপুরেও। সেখানে সম্মেলন ছাড়া ঘোষণা করা হয়েছে নতুন মহানগর কমিটি।


রাজশাহী ও খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটির বয়স ১০ থেকে এক যুগ হতে চলল। রাজশাহী মহানগরের সম্মেলন হয়েছিল ২০০৪ সালে। সম্মেলনে নির্বাচিত সভাপতি মাসুদুল হক ডুলু মারা গেছেন ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে। তখন থেকে প্রায় আড়াই বছর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি পদে কাউকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। প্রথমে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বজলুর রহমানকে। পরবর্তী সময়ে তাকে ‘ভারমুক্ত’ করে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়।


বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজালুল করিম একাই সব। মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটিতে বর্তমানে আর কোনো নেতা নেই। এ কমিটির সভাপতি শওকত হোসেন হিরন মারা যাওয়ার পর এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ২০১২ সালে মহানগর কমিটির সম্মেলন হলে শুধু সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয়। এরপর পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা হয়নি দেড় বছরেও। এর আগেই গত ৯ এপ্রিল মারা যান সভাপতি শওকত হোসেন হিরন। এর পর কাউকে যে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হবে সেই উপায় নেই।


১৫ জুলাই খুলনা মহানগর এবং ১৯ জুলাই রাজশাহী মহানগরের কাউন্সিলের তারিখ নিধারণ করা হলেও তা করা হয়নি।


জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খায়রুজ্জামান লিটন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘রোজা এবং ঈদের এক সপ্তাহ আগে হওয়ায় সেসময় আমাদের সম্মেলন হয়নি। আগামী মাসের মাঝামাঝিতে তা করা হবে।’


(ঢাকাটাইমস/৩১আগস্ট/টিএ)