ঢাকা:মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ আর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ঠেকানো ছিল তার দায়িত্ব। অথচ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ঝেটিয়ে বিদায়ের বদলে নিজেই বনে গিয়েছেন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। শুধু তাই নয়, দেশের অকৃত্রিম বন্ধু মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা শ্রদ্ধাভাজনদের সম্মান জানাতে দেওয়া ক্রেস্ট তৈরিতেও বড় ধরনের জালিয়াতির অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এতসব অভিযোগের জন্য সাময়িকভাবে বিভাগীয় শাস্তিও দেওয়া হয়েছে তাকে। কিন্তু দায়িত্বশীল পদ থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকীর অপরাধের শাস্তি কী এতটুকুই? দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির প্রমাণ মেলার পর এই প্রশ্নই উঠেছে।
মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে স্বাস্থ্য সচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন মিঞার বিরুদ্ধেও। এর আগে সুনির্দিষ্ট অভিযোগও ছিল। কিন্তু তারপরও দিব্যি বহাল আছেন এই কর্মকর্তা। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক থাকতে তার বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি, পদোন্নতির ঘোর অভিযোগ ছিল। কিন্তু তারপরও একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে তার সচিব পদ পাওয়া ছিল রীতিমতো বিস্ময়ের। মুক্তিযুদ্ধের সনদ জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে আইনগত ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে দুদক।
বেসরকারিকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে এই পদে আছেন তিনি। ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবও। ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর এই তিনিই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে একটি প্রজ্ঞাপন পাঠিয়েছিলেন। যেখানে জানিয়েছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানোর আদেশ জারি করার পর এ সুবিধার জন্য অনেকেই নানা ব্যাখ্যার মাধ্যমে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে সনদ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাই যেকোনো একটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
বিস্ময়কর হলো, মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান নিজেই কোনো মানদণ্ড না মেনে নিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা সনদ। দুদক তার তদন্তে প্রমাণও পেয়েছে। সুপারিশ করেছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। কিন্তু এখনো প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় গাড়িতে পতাকা উড়িয়ে বেড়াচ্ছেন এই কর্মকর্তা।
এর আগেও খাদ্য সচিব হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণে গিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন ওয়াহিদুজ্জামান। প্রশিক্ষণে অংশ না নিয়ে মাসাধিককাল যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে দেশে ফেরার পর তাকে চিঠি লিখেছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়াটি। চিঠিতে মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের দিকে আঙুল তুলে বলা হয়েছিল, এই ধরনের কর্মকর্তার জন্য বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না। পরে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছ থেকে নেয়া পাঁচ লাখ টাকা ফেরত দিতেও বাধ্য করা হয়।
অভিযুক্তদের মধ্যে আছেন সরকারি কর্মকমিশনের সচিব এ কে এম আমির হোসেনও। অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে দুদকের তদন্তে। সুপারিশ হয়েছে ব্যবস্থা নেওয়ার। কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছে না আমির হোসেনের। এর মধ্যে অবশ্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব আবুল কাসেম তালুকদারকে অভিযোগ ওঠার পর ওএসডি করা হয়েছে। তবে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, সপ্তাহে দু-চারদিন মন্ত্রণালয়ে আসেন তিনি। কিছুক্ষণ লাইব্রেরি, এর দপ্তর, ওর দপ্তর ঘুরে বাসায় চলে যান।
প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আইনে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার পর চাইলে দুদক দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও এ ধরনের নজির আছে। কিন্তু এই পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ার পরও আইনি ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে। এ থেকেই অনেকটা অনুমেয় যে, এই কর্মকর্তার ব্যাপারে শৈথিল্য মনোভাব দেখানো হচ্ছে।’
এদিকে দুদুকের সুপারিশের পর গত ৩ সেপ্টেম্বর বেসরকারি একটি টেলিভিশনকে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেন, ‘দুদকের তদন্ত একপেশে।’ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তির এমন মন্তব্য এবং দুদকের দায় চাপিয়ে দেওয়ার মনোভাব দেখে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তবে কি পার পেয়ে যাচ্ছেন আইন অমান্যকারী সচিবরা?
অবশ্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বৃহস্পতিবার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এখনো দুদকের সুপারিশসহ প্রতিবেদন আমাদের হাতে এসে পৌঁছেনি। যারা চাকরির সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করেননি কিন্তু এখন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করছেন তাদের সনদ ও চাকরির সময় বাড়ানোর আদেশ আগেই বাতিল করা হয়েছে। এখন দুদকের সুপারিশ দেখে প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘দুর্নীতি প্রমাণের পর পাঁচ সচিবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুদকের সামনে বাধা কোথায় তা বোধগম্য নয়। কিন্তু এর মাধ্যমে যে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে তা ঠিকই বোঝা যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘রক্ষক হয়ে যখন কেউ ভক্ষকের ভূমিকায় নামে তখন তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিলে বিচারহীন সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকারের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ ধরনের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে সুশাসন শুধু মুখেই থাকবে, কাজে দেখা যাবে না।’
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল জানে না তারা মুক্তিযোদ্ধা
দুদক বলছে, তারা পাঁচ সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও গেজেট নেওয়ার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম পেয়েছে। পুরো প্রক্রিয়াটি হয়েছে আইনের বাইরে গিয়ে। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সুপারিশ ও যাচাই-বাছাই ছাড়াই সচিবরা এসব সনদ নিয়েছেন। তারা কেউই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। যুদ্ধে অংশ নেওয়ার অকাট্য কোনো দলিলও অনুসন্ধানকালে দেখাতে পারেননি।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত বৃহস্পতিবার দুদকের উপ-পরিচালক জুলফিকার আলী এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে কর্মকর্তাদের অসদাচরণের জন্য তাদের বিরুদ্ধে আইনি এবং বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও গেজেট বাতিল করার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়। চাকরিতে ঢোকার সময় মিথ্যা তথ্য দেওয়ায় সরকারি কর্মকমিশন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে বলেও প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।
দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এই কর্মকর্তারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছিলেন। কিন্তু আগেভাগে বিষয়টি ধরা পড়ায় এই সুযোগ আর তারা নিতে পারেননি। যদি তারা চাকরির মেয়াদ সত্যি সত্যি বাড়াতেন এবং আর্থিক সুবিধা নিতেন, তবে দুদক তাদের বিরুদ্ধে মামলা করত।’
চারজনের মেয়াদ শেষের দিকে
অভিযুক্ত সচিবদের চারজনের চাকরির মেয়াদ প্রায় শেষের দিকে। তিন বছর আগেই অবসরে গেছেন মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান। এরপর তিন বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও শেষ করেছেন। গত ১১ জানুয়ারি তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হয়। চুক্তির মেয়াদ আবার বাড়িয়ে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যান করা হয় তাকে। কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকীর অবসরে যাওয়ার কথা ছিল ৩০ অক্টোবর। তার আগেই ওএসডি করা হয়েছে তাকে। নিয়াজউদ্দিন মিঞা অবসরে যাবেন ৩০ ডিসেম্বর। এ কে এম আমির হোসেনের চাকরির মেয়াদও শেষের দিকে।
মানা হচ্ছে না চার মানদন্ড
মুক্তিযোদ্ধা সনদ পাওয়ার চারটি মানদণ্ড ঠিক করা হয়েছিল। এগুলো হচ্ছেÑ সরকারের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিতে যোগদানের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন অথবা যাদের নাম মুক্তিবার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাদের নাম গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যারা প্রধানমন্ত্রীর সই করা সনদ নিয়েছেন। অভিযোগ আছে জালিয়াতি ধরা পড়া পাঁচ সচিবসহ অনেকেই এই মানদ- মানছেন না। নিয়ম না মেনেই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বা সংসদ সদস্যদের সুপারিশ নিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা সনদ।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুবিধা নিলে বাতিল হবে
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা দেননি, তারা পরবর্তী সময়ে কোনো সুবিধা নিয়ে থাকলে সব বাতিল হবে। ভুল তথ্য দিয়ে চাকরিতে ঢোকার দায়ে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে এ ধরনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে তথ্য সংরক্ষণ শুরু করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
মাসুদ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে আরও যত অভিযোগ
মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধুদের দেওয়া সম্মান স্মারকে স্বর্ণ জালিয়াতির জন্য মুক্তিযোদ্ধা সচিব (ওএসডি) কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকীকে দায়ী করেছে তদন্ত কমিটি। কমিটি বলছে, তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবহেলা করেছেন। সচিব কোনো প্রশ্ন বা যাচাই-বাছাই ছাড়াই সাবেক প্রতিমন্ত্রীর কাছে নথি পাঠিয়েছিলেন। প্রতিমন্ত্রী নথি পেয়েই তা অনুমোদন করেছেন। শুধু তাই নয়, মাসুদ সিদ্দিকী শাখা পর্যায় থেকে উপস্থাপিত নথিতে স্বর্ণের ক্যারেট উল্লেখ না করার দায়ভার অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর চাপিয়েছেন। অথচ ক্রেস্ট সরবরাহকারী পেয়েছে সর্বোচ্চ দর।
সরকার স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট নাগরিক ও সংগঠনকে সম্মান জানায়। সম্মান স্মারক হিসেবে ক্রেস্ট দেওয়া হয় তাদের। প্রতিটি ক্রেস্টে এক ভরি স্বর্ণ ও ৩০ ভরি রুপা থাকার কথা ছিল। কিন্তু সম্মাননা দেওয়ার সময় বিএসটিআইয়ে একটি ক্রেস্ট পরীক্ষা করায় মন্ত্রণালয়। তাতে দেখা যায়, ক্রেস্টটিতে এক ভরির জায়গায় সোয়া তিন আনা স্বর্ণ এবং রুপার বদলে ৩০ ভরি পিতল, তামা ও দস্তা দেওয়া হয়েছে।
দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের অনুদানের টাকাও ছয়নয় করেছেন মাসুদ সিদ্দিকী। নিয়ম ভেঙে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়Ñএমন প্রতিষ্ঠানকে টাকা দিয়েছেন। নিজের বাবার কলেজেও মুক্তিযোদ্ধাদের টাকা অনুদান দিয়েছেন। পরে অবশ্য নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় মাসুদ সিদ্দিকীর বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত মওলানা মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী কলেজকে দেওয়া মোট ২০ লাখ টাকা ফেরত দিতে হয়েছে তাকে।
(ঢাকাটাইমস/০৮সেপ্টেম্বর/এইচএফ/এআর/ ঘ.)