রংপুর: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের করতে হলে এখানকার কালচারাল প্র্যাকটিস পরিবর্তন করতে হবে। কারণ এটা একটা বিদ্যাপিঠ। এ বিদ্যাপিঠে বিদ্যা চর্চা হবে। তার সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্যা থাকবে। কিন্তু সেই সমস্যা যেন এমন জায়গায় না যায়, যেখানে গিয়ে সব থমকে যায়।
আজকে ছাত্রের সাথে শিক্ষক, শিক্ষককের সাথে প্রশাসক, কর্মচারীর সাথে কর্মকর্তার সম্পর্কের যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা যেন এমন দিকে না যায় যাতে সব থমকে যাবে। এতে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়েরই মারাত্মক ক্ষতি হবে। উন্নয়ন ব্যাহত হবে, টার্গেট পুরণ করা যাবে না। রবিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. প্রফেসর নূর-উন-নবী ঢাকাটাইমসকে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।
আপনি যোগদানের পর বারবার অবরুদ্ধ হচ্ছেন, এখান থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কি?
আমি এখানে আসার আগেও নাকি তৎকালীন উপাচার্য মহোদয়কে অবরুদ্ধ করা হতো! তালা লাগানো হত। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে অভাব অনটন থাকবেই। কারণ এ বিশ্ববিদ্যালয়টা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। আর তাছাড়া যা ক্যাপাসিটি তার চেয়ে বেশী পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায়নি। অন্যদিকে শিক্ষার্থী বাড়ছে, তাদের চাহিদা বাড়ছে, প্রয়োজন বাড়ছে। তাদের এ চাহিদা একেবারে অযৌক্তিকও নয়। শিক্ষকরাও যে দাবী করছেন তাও অযৌক্তিক নয়, তাই আলোচনার মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে এগিয়ে যেতে হবে, সমস্যার সমাধান করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এখানে এসে বার বার অবরুদ্ধ হয়ে ক্লান্ত হচ্ছেন কিনা?
ক্লান্তি তো বেড়েছেই, এখানে পাহাড়সম সমস্যা। সে সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত সময় দিতে হয়। দ্বিতীয়ত এই সমস্যাগুলোর সব সমাধান রংপুরে নেই। এগুলোর সমাধান ঢাকায়, কেন্দ্রে। ফলে আমাকে কেন্দ্রে দৌঁড়াতে হয় খুব, সেটা আমি করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ সেরে রাতে জার্নি করি।
সমস্যাগুলোর সমাধান করতে গিয়ে অনেক চাপ অনুভব করি। তবে আমি মানসিকভাবে ক্লান্ত হইনি, বা হইনা। যখন দেখি যুক্তিটা আর কাজ করছে না, ইমোশন কাজ করছে তখন বিরক্তি লাগে, বিরক্ত হই, হতাশ হয়ে পড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা এভাবে কথা বলবে কেন? এভাবে আচরণ করবে কেন?
সমস্যা তো থাকবেই। অথচ যখন সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছিল, তখন কিন্তু অনেকেই এখানে উপস্থিত ছিলেন। তারা কিন্তু তখন কোনও প্রতিবাদ করেন নাই। তাহলে এখন কেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা সৃষ্টির পেছনে কেউ উস্কানি দিচ্ছে কিনা, দিলে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিবেন কি?
যেহেতু আমার কাছে কোনও প্রমাণ নেই কে উস্কানি দিচ্ছে, তাই বলবোনা কেউ উস্কানি দিচ্ছে। কিন্তু যে পরিস্থিতিটা তৈরি হয়েছে সেজন্য খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকেই বদলাতে হবে এমন দাবির কোনও যৌক্তিকতা নেই। কিন্তু আমি শুনি, আমার কানে আসে এমন প্রচেষ্টা চলছে, কয়েকজনের নামও চলে এসেছে। আবার সমস্যাকে আরও বড় করে দেখানোর জন্যও দেখা যাচ্ছে যে, বিভিন্ন রকম সভা-সমিতি করা হচ্ছে।
সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা আছে তারা জানে এসব কারা করছে। কেউ পরিস্থিতি ঘোলাটে করলে তাদের শায়েস্তা করার দায়িত্ব সরকারের। তারাই ব্যবস্থা নেবে, আমি নই। কারণ এটি সরকারের একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান। তবে যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়েছে নতুন ভিসি এসে সবার আগে সেগুলোর সমাধান করলে আমি সবচেয়ে খুশি হব।
সাবেক উপাচার্য যে গণ-নিয়োগ দিয়েছেন, আপনি তা বাতিল না করে কেন বৈধ করলেন?
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব ছিল, কিন্তু আমার সমস্যা যেটা হয়েছে, এই লোকগুলো আমি আসার আগে থেকেই কাজ করছেন। বেতন পেয়েছেন, বেতনটা আগের উপাচার্য যেখান থেকেই দিক, দিয়েছে। আমি আসার পরে দেখলাম এই বেতনটা দেওয়া যাচ্ছে না, কারণ এই বেতন বাজেটে অন্তর্ভুক্ত নেই। কারণ তাদের এই পদগুলো অনুমোদিত ছিল না। আমি প্রথমে চিন্তা করলাম যে যেহেতু পদগুলো নেই, আমিও বেতন দিতে পারব না। কিন্তু লোকগুলোকে কি আমি তাড়িয়ে দেব? এই প্রতিষ্ঠানে তারা কাজ করেছে কয়েক মাস। আমি মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের নিয়োগ অব্যাহত রেখেছি। যদি তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয় তাদের পেটে লাথি মারা হবে। নতুনকরে সামসাজিক সমস্যা তৈরি হবে। একটি পরিবারকে ভিক্ষার ঝুলি হাতে ধরিয়ে না দিয়ে বরং পুনর্বাসন করার মানসিকতা থেকেই আমি তাদের চাকরি খাইনি।
এই অবৈধ নিয়োগের জন্য সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধেতো মামলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে কী ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
মামলার বিষয়ে যে অথরিটি কাজ করছে তা দুদক। আমি আসার পর দু’দফায় তারা কিছু কাগজপত্র চেয়েছেন, আমরা সেগুলোর কপি সাপ্লাই করেছি। উনারা সেই কাগজপত্র জব্দ করেছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তার কাছে জিম্মা রেখেছেন। যখনই প্রয়োজন হবে, তখনই তারা নেবেন। আগের উপাচার্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও এখতিয়ার আমার নেই। এটি সরকারের এখতিয়ার।
আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর ২৬৭টি পদের অনুমোদন এনেছি। এছাড়াও ৪৬ জন নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছি। তারা অনেক অভিজ্ঞ, যোগ্য এবং দক্ষ।
নতুন কোনও বিভাগ কি খোলা হয়েছে?
যেসব বিভাগ আছে, সেগুলোরই শিক্ষক নাই, ক্লাশ রুম নাই, বই নাই। এই বিল্ডিংগুলোতে ২১টি বিভাগের ক্যাপাসিটি ছিল তা করা হয়েছে। আমি আর খুলতে পারবো না। কারণ, আমার যে রিসোর্স আছে তা দিয়ে বর্তমানগুলোই চালাতে পারছি না। নতুন করে কীভাবে খুলবো?
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর এ পর্যন্ত কত টাকা বাজেট এনেছেন?
আমি যখন এসেছি তখন ৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা বাজেট ছিল, এখন ১৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা। আমি এসে দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টে মাত্র ১৩০ টাকা ১১ পয়সা। বকেয়া বিল ছিল প্রায় ৫ কোটি টাকা!
বর্তমানে যে অবকাঠামো আছে তাতে আরও শিক্ষক কর্মকর্তা প্রয়োজন আছে কি?
শিক্ষক সংকট সবচেয়ে বেশী, ক্লাস রুমের সংকটও আছে। কিন্তু অনুমোদন না থাকায় শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারছি না। আমি তো নিজের ইচ্ছে মতো নিয়োগ দিতে পারি না।
আর বড় ধরণের কোনও সেশনজট নেই উল্লেখ করে উপাচার্য বলেন, আমি আসার পর বলা হয়েছে কখনো শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হবে না। তবে আমি আশঙ্কা করছি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এ থেকে উদ্ধার পেতে হলে ধৈর্য্য ধরতে হবে, সমস্যা কোথায় তা চিহ্নিত করে খোলা মনে সমাধান করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে নয়।
৩ টি হলের মধ্যে ১টি চালু আছে অন্য দু’টি এখনও বন্ধ, খুলে দেওয়া হচ্ছে না কেন?
শুরুতে ভবনগুলো আমাদের হাতে ছিল না। শিক্ষা প্রকৌশলের হাতে ছিল, কাজ শেষ হতে দেরি হওয়ায় হস্তান্তর হতে দেরি হয়েছে। এরপর যখন হাতে পেলাম, হলে প্রোভোস্ট নিয়োগ দেওয়া হল, হলে ছাত্রভর্তির সিদ্ধান্ত হল, স্বাক্ষাৎকারের তারিখ নির্ধারণ হল, এরপরই তারা পদত্যাগ করলো, আর আমিও চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ফলে শিক্ষার্থীরা বলল, ভিসি স্যার নেই, তাই আমরা হলে উঠবো না। তাই হল চালু হচ্ছে না। দ্রুত এর সমাধান করা হবে।
প্রো-ভিসি, ট্রেজারার এবং সিনিয়র শিক্ষক কেন নিয়োগ দিচ্ছেন না?
আমি চাই সিনিয়র শিক্ষক আসুক, প্রো-ভিসি আসুক, ট্রেজারার আসুক। কিন্তু সেই পরিবেশতো নেই। পরিবেশটাতো আগে সৃষ্টি করতে হবে। কেউ আসলেই অবরোধ, অবস্থান ধর্মঘট, পদত্যাগ। তাহলেতো কেউ আসবে না? আমি তো নিয়ে এসেছিলাম একজন রেজিস্ট্রারকে। কিন্তু তাকে বিদায় করে দিতে হল। কেন হল আপনারাই তা ভাল জানেন। একজন ট্রেজারার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তখন আমি অবরুদ্ধ ছিলাম। একথা শুনে তিনি আর এখানে আসেননি। তাহলে কেমনে হবে! কে আসবে এখানে! এ জন্য আগে পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার।
একসাথে এতো শিক্ষকের একযোগে পদত্যাগের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়তো সংকটে পড়ে গেছে, চেইন অফ কমান্ড ভেঙ্গে পড়েছে এ থেকে উত্তরণের উপায় কি?
চেইন অফ কমান্ড তো অবশ্যই ভেঙ্গে পড়েছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এটি কাম্য হতে পারে না। পদত্যাগে কোনও সমাধান আসবে না। আমি যতটুকু জানি এর আগের উপাচার্য মহোদয়ের আমলেও তারা পদত্যাগ করেছেন। একজন শিক্ষকতো একটি পদ থেকে পদত্যাগ করেননি। একাধিক পদ রয়েছে তার। নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যদি তারা এটা করেন তাহলে উপায় কি? সমস্যা আছে, সমাধানও আছে। সে জন্যতো ফাইট করতে হবে। যারা বিভিন্ন দাবীতে পদত্যাগ করেছেন, তাদের আবেদন তাদের বোর্ডে দিয়েছি, এ্যাক্সপার্টরা দেখবেন, সেখান থেকে রিভিউ করে অন্য বোর্ডে দেওয়া হবে। সেখানে অ্যাকসেপ্ট হলেতো আর কথাই নেই। সেটা আলোচনার মাধ্যমে করা যেতে পারে। কিন্তু সময় সীমা বেধে দিয়ে নয়।
আপনি তো এই বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানের করতে চেয়েছেন, সে প্রচেষ্টা কি থমকে দাড়ায়নি?
আমি আসার পর দেড় বছর পার হচ্ছে। আমি শুরুতেও বলেছি, এখনও বলছি, আমি এখানে নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত থাকতে পারলে আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় করবো। এ জন্য প্রয়োজন সবার সহযোগীতা।
(ঢাকাটাইমস/১৬নভেম্বর/এমএটি)