logo ২৯ এপ্রিল ২০২৫
রাতের ঢাকা: আলোই নিপাদের জন্য অন্ধকার
মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস
২১ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:১৭:১৩
image

ঢাকা: রাত তখন দুটা। ১৭ ডিসেম্বর। ‍ছুটলাম রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেনের রাজপথে। উদ্দেশ্য, রাতের ঢাকার চিত্র পাঠকের সামনে তুলে ধরা। বেশ কৌতূহলী মন নিয়েই ছুটে চলা। চলতে চলতে রাস্তার সোডিয়াম বাতির আলোতে চোখ গেলো বোরাক টাওয়ারের পাশের গলিতে। রিক্সার জটলা দেখতে পেলাম। কৌতূহলী দৃষ্টিতে এগিয়ে গেলাম খানিকটা। কাছে যেতেই রিক্সাগুলোর চটজলদি কেটে পড়ল। কিন্তু রাস্তার গলিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখো গেলো তিন জন মধ্যবয়সী ও এক তরুণীকে।


এই প্রতিবেদককে দেখে একজন অশালীন ইঙ্গিত করলেন!প্রতিবেদক প্রথমে কথা শুনে না বুজলেও পরিস্থিতি দেখে বুঝতে আর অসুবিধা হল না।


আসলে এদের ক্ষেত্রে এই কাজের অর্থ ‘‘কষ্ট’’। এর অর্থ ‘‘উপার্জন’’ও। এটি তাদের ব্যবসায়িক ভাষা।  


রজপথে দাঁড়িয়ে কি করছেন জানতে চাইলে একজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘আরে ভাই ভিআইপি দিয়ে আমরা করুম কি? তারা কি আমগোরে ভাত দিবো? আমগো পেটের ধান্ধা আমাগোই করতে হবো।’’


ওদের সঙ্গে যখন এক কথা দুকথা চলছিল ঠিক তখন রিক্সায় দুইজন লোক আসল। দেখা গেলে তাদের মধ্যে একজন পুলিশ আরেকজন আনসার। এই প্রতিবেদককে দেখে পুলিশ সদস্য অনেকটা ধমকের সুরে বলল, ‘‘এখানে কী? বললাম আসছি ঘুরতে। এরই মধ্যে পুলিশ সদস্য আনসারকে দেখিয়ে বললেন ওপাশে যাও। বললাম কেন? পুলিশ বলল, গেলেই বুজবা। পরে বুজতে পারলাম ঐ আনসারের কাছে বখরা দিতে হবে। এই বখরা পুলিশ ও আনসার পরে ভাগ করে নিবে। এভাবে যাদেরকেই পায় তাদের কাছ থেকেই বখরা আদায় করে পুলিশ।


কথা বলার এক পর্ায়ে পরিচয় প্রকাশ করতেই তারা বুঝে গেলেন ভুল জায়গায় হাত দেয়া হয়ে গেছে। নিজেদেরকে অনেকটা শুধরে নিয়ে বললেন, ‘‘ভাই এসব কাজ তো হবেই। এগুলোতো আসলে ওরা (পতিতা) ইচ্ছা করে করে না। অনেক নির্যাতন ও নিষ্পেষণের পর ওরা রাস্তায় নিজেদের শরীর বিকিয়ে দেয়। খুব ভাল করেই তাদের পক্ষে গুণগান গাইলেন আনসার আর পুলিশ। এরপর এই প্রতিবেদক একটু দূরে গেলে দেখা যায় চার পতিতার কাছ থেকে টাকা নিয়ে রিক্সায় উঠে চলে গেল দুজন। এভাবেই চলে তাদের বখরা আদায়।


একটু পরে আমার ঐ নারীদের কাছে আসলে তারা বলেন, ‘‘ভাই আমাগো ক্ষতি কইরেন না। পুলিশ গোরে টাহা দেওন লাগে। আবার রাস্তা ছিনতাইকারীদের ঝামেলা তো আছেই। আপনি.....না লে কাইট্টা পড়েন।’’


এভাবে রাত যতো গভীর হয় ততোই তাদের খদ্দের সংখ্যা বাড়ে। আর খদ্দেরদের মধ্যে বেশির ভাগই রিক্সা চালক। কাজ বেশি হলে তাদের মনও থাকে ফুরফুরা। তবে ভোরের আলো ফুটলে বিষন্ন হয়ে হয়ে ওঠে তাদের মন। আলোই যেন তাদের জীবনে অন্ধকার নিয়ে আসে। যেন রাতের ঝিঝি পোকা তারা।


এরই মধ্যে ভোর হতে চলছে। একজনের কাছে কাছে যেতেই গলার আওয়াজ নামিয়ে এনেছে একদম নীচে। যেন নিজেদের কোনো কিছুই প্রকাশ করতে আগ্রহী নয় আর।


পিছু নিতেই জোরসে ধমকে উঠলো একজন, ‘ওই কী চাস? এহন আর না। দূরে যা।’ ধমক মনে হলেও এরমধ্যে ছিলো একরাশ ক্ষোভ। নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পারার তীব্র প্রতিবাদও ছিল এটি। খানিকটা পথ হেঁটেই উল্টো দৌড় দিলো সবাই। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল পুলিশের টহল গাড়ি। পুলিশকে যেন যমের মতো ভয় পায় ওরা সবাই।


প্রায় ১০ মিনিট পরে গলি ছেড়ে আবার বেরুলো সবাই। পুলিশকে না দেখে রাস্তার একপাশেই বসলো দুইজন। খানিকটা ক্লান্ত। একটু যেন গা এলিয়ে দিতে পারলেই শান্তি। পাশে গিয়ে বসতেই প্রশ্ন ছুঁড়লো, ‘পুলিশডি কোনদিগে গেল?’ চলে গেছে জেনে এবার যেনো নিশ্চিন্ত হলো। ক্যান, পুলিশে কী সমস্যা? পাল্টা প্রশ্ন করতেই সব ঝাড়লো একসঙ্গে। একজন বলে উঠলো, ‘আরে জানেন না। মাইরা কিচ্ছু রাখে না। লাঠি দিয়া পিডাইয়া সব ফাডাইয়া দেয়।’ বলেই পায়ের কাপড় সরিয়ে দেখালো অন্যজন। আঁতকে ওঠার মতো দৃশ্য। বাম পায়ের হাঁটুর নীচে লাল হয়ে ফুলে গেছে একটি অংশ। মোটা হয়ে বসে গেছে লাঠির আঘাত।


তারপর এক এক করে ঝাড়তে লাগলো রাতভর জমে থাকা ক্ষোভগুলো। ‘পুলিশের লাইগা কিচ্ছু করন যায় না। এমনিতেই শীত। তারপরেও পুলিশ আইয়া শান্তি দেয় না। খালি ট্যাকা দিলেই সব ঠিক।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন।


নাম জানতে চাইলে এবার আর কোনো আড়ষ্টতা নয়। ঝটপট বললেন, ‘নিপা’। বাড়ি কই, প্রশ্ন করতেই সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘গাজীপুর। তারপর নিজ থেকেই বললেন, ‘পেটের দায়ে ইজ্জত বেচি। রাস্তায় নামছি। শখে না। কোন কিছুর বাছ বিছার করি না। মানুষ খারাপ কয়। শরম লাগে। তবুও এইসব করি। খালি কয়ডা খাওনের লাইগা, পোলাপাইনডিরে মানুষ করনের লাইগা। তারপরেও এতো কষ্ট আর সহ্য হয় না।’


সঙ্গে থাকা আরেকজন তখনই কথা বলে উঠলেন, ‘আল্লাহ হেগো বিচার করবো। আমরা তো কারও ক্ষতি করি না। ক্ষতি যা, তা তো নিজেরই করছি। নিজেরে শেষ কইরা দিছি। আর কিচ্ছু বাকি রাখি নাই। তবুও আমাগোরো শান্তি দেয় না।’


নিপাদের জীবনগল্প মোটেও সুখকর নয়। নিপা জীবনের বাঁকে বাঁকে কষ্ট সহ্য করেছেন। সুখকর ছিল না তার পথ চলা। এ মেয়ে বড় হয়েছেন গাজীপুরেই। আর্থিক টানাপোড়েনের সংসারে পড়াশোনার ঝাপি খুব একটা খুলতে পারেননি। বইখাতা গুটিয়ে ফেলতে হয়েছে ক্লাস ফাইভে ওঠার আগেই। বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে বয়স হওয়ার আগে। বাবার অভাবী সংসারে নিয়ম মতো খাবার না জুটলেও ভেবেছিলেন স্বামীর সংসারে হয়তো সেটা আর থাকবে না। কিন্তু কষ্ট পিছু ছাড়েনি। মাত্র আটমাস টিকেছে সে সংসার। তারপর রিকশাচালক স্বামী আরও একজন বউ তুলে এনেছেন ঘরে। ততোদিনে নিপার পেটে নতুন মুখের কোলাহল।


শুরু হলো নতুন যন্ত্রণা। নিত্য মারধর, গালাগাল। সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন নিপা। প্রতিবাদে নেমে এসেছেন রাস্তায়, বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেকে। গত সাত বছর ধরে এভাবেই চালাচ্ছেন নিজেকে। তার সন্তান পিয়াসের বয়সও এখন সাত বছর।


কথার ফাঁকে আলো ফুটে উঠেছে চারদিকে। ফেরার তাগাদা অনুভব করেছে নিপারা। উঠে দাঁড়ালেন দুজনেই। আবার ভালো করে মুখ ঢেকে নিলেন দুজনেই। তাদের সঙ্গে তখন রাতভর আয় করা কয়েকশ টাকা আর নিজেকে বিকিয়ে দেয়ার রাশি রাশি কষ্ট। ‘ভাই গেলাম। রাইতে আইসেন, সব কমু। অহন যাই, বাচ্চার ঘুম ভাইঙ্গা না পাইলে কাইন্দা দিবো। আমগোরে রাইতেই পাইবেন, দিনে না।’


নিপারা দ্রুত পা চালালেন। যাওয়ার আগে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন, আঁধারেই তাদের জীবন, আঁধারই তাদের কাছে আলো, আলো যেন অন্ধকার!


(ঢাকাটাইমস/২১ডিসেম্বর/এমএম/ এআর/ ঘ.)