logo ২৯ এপ্রিল ২০২৫
মুসাও “ক্লিনচিট” সনদ পেয়ে যাবেন!
১২ নভেম্বর, ২০১৪ ১০:৫৮:৪০
image


প্রাসাদতুল্য বাড়িতে নাকি থাকেন তিনি। চড়েন কোটি টাকার গাড়িতে। নিজে দাবি করেন, পরেন বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানের ডিজাইন করা স্যুট। পায়ে দেন হীরাখচিত জুতো। এই হীরা আসল না-কি নকল? হাতঘড়িটাও নাকি হীরার তৈরি। লেখার কলমটাও হীরাখচিত। এ  কোনো রূপকথার গল্প নয়। বাংলাদেশি এক ধনকুবেরের জীবনাচরণ এটি। সেই ধনকুবের মুসা বিন শমসের। এতসব বিত্ত-বৈভবের উৎস কোথায়? এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে কারো মনে। এতকাল পর হলেও দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের নজর পড়েছে তার ওপর। কমিশন অনুসন্ধানের কাজও শুরু করে দিয়েছে। শেষমেষ ‘ক্লিনচিট’ সার্টিফিকেট না পেয়ে যান মুসা। এই প্রশ্নও কারো কারো মনে আছে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার ফুলসুতি ইউনিয়নের কাজীকান্দা-হিয়াবলদী গ্রামের মুসা বিন শমসেরের ব্যাপারে নানা বিতর্ক আছে স্থানীয়দের মুখে মুখে। অনেকে তার নাম শুনলেই নাক উঁচু করেন। বিশেষ করে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তার ও তার পরিবারের ভূমিকা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। ওই সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবেও দুর্নাম কুড়িয়েছেন মুসা।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পারিবারিকভাবে কোনো সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান ছিলেন না মুসা। বাবা শমসের আলী মোল্লা ব্রিটিশ আমলে স্থানীয় সরকার বিভাগে চাকরি করতেন। চার ভাই এবং দুই বোনের মধ্যে মুসা ছিলেন তৃতীয়। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে হঠাৎ করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া মুসার বিপুল অর্থ আয়ের উৎসের স্বচ্ছতা নিয়ে বেসুমার প্রশ্ন আছে। এ কথা বেশি চালু আছে যে, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা করে রাতারাতি কাড়িকাড়ি টাকা কামিয়েছেন মুসা। তার এই ব্যবসার কথা আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচিত। শক্তিশালী একটি অসাধু চক্রও আছে তার নিয়ন্ত্রণে। আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্রের সঙ্গেও জড়িত তিনি, এই প্রচার তার নিজের। যে কারণে ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে বিগত সময়ে নিজের ব্যবসাকে চাঙা রেখেছেন। এর বাইরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজ গ্রামের ধনী হিন্দু পরিবারের টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার লুটের অভিযোগও আছে তথাকথিত প্রিন্স মুসার বিরুদ্ধে। মানুষের গচ্ছিত আমানত খেয়ানত করার অভিযোগও লোকমুখে শোনা যায়। সবমিলিয়ে বৈধ-অবৈধ উপায়ে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি।

তবে এতকাল এ নিয়ে উঠেনি কোনো প্রশ্ন। বিদেশি পত্রিকায় তার বিলাসী জীবনাচরণ এবং বিপুল সম্পদের তথ্য প্রকাশের পর তথ্যানুসন্ধানে নেমেছে দুদক।

সমাজ ও রাষ্ট্র চিন্তাবিদরা বলছেন, রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তি যদি অর্থকড়ির জোরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যান, তা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। দুদকের আরও আগেই উচিত ছিল এ ধরনের সন্দেহভাজনদের তালিকা করে প্রভাবমুক্তভাবে অনুসন্ধান চালানোর। এখন দেরিতে হলেও তারা যে পদক্ষেপ নিয়েছে সেটি যেন কোনো কারণে ভেস্তে না যায়, সেদিকটিও খেয়াল রাখতে হবে।

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকÑসুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘শুধু এই প্রিন্স মুসা নন, তার মতো এমন অনেক ধনকুবের আছেন তাদের ব্যাপারে আমরা জানিও না। তারা নিজেদের যতটুকু সম্ভব লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে কার্য হাসিলের চেষ্টা করেন।’ তিনি বলেন, ‘এখন দেখতে হবে তিনি অর্থপাচার বা অবৈধ কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত কি না। কারণ বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে তার বিলিয়ন ডলার জমা আছে বলে শোনা যাচ্ছে। পাশাপাশি আয়কর হিসাবও ভালো করে খতিয়ে দেখা দরকার।’

অনেকে আবার বলছেন, সম্প্রতি ‘বিজনেস এশিয়া’ পত্রিকায় মুসাকে নিয়ে প্রকাশিত খবরটি উদ্দেশ্যমূলক কি না তাও ভেবে দেখতে হবে। এমনও হতে পারে তিনি যতটুকু নন তার চেয়ে বেশি কিছু প্রচার করা হচ্ছে। এর পেছনেও আন্তর্জাতিক কোনো সুবিধা পাওয়ার ব্যাপার থাকতে পারে। তা না হলে এতদিন পর কেন বিদেশি পত্রিকা মুসার বিষয়ে আগ্রহ দেখাল?

মুসার ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যক্তি হিসেবে মুসা একটু আত্মপ্রচারমুখী মানুষ। নিজেকে সব সময় সমাজের উচ্চবর্গীয় হিসেবে ভাবতে পছন্দ করেন তিনি। ক্ষমতা ও অর্থের বিকল্প কোনো মন্ত্র নেই তার কাছে। জীবনযাপনের বিলাসিতাও তারই অংশ।

সমালোচনা আছে মুসার ছেলে হাজ্জাজ বিন মুসা ববিকে নিয়েও। বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ করেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সামনে আসেন ওই তরুণ। তাও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে। রাজনীতির আগেপাছে ছিলেন না ববি। কিন্তু হঠাৎ এরশাদের উপদেষ্টা বনে যাওয়া নিয়েও মুখরোচক আলোচনা আছে খোদ জাতীয় পার্টিতেও। দলের অনেক নেতাকে বলতে শোনা যায়, এরশাদকে মোটা অঙ্কের উপঢৌকন দিয়ে উপদেষ্টা পদটি বাগিয়ে নিয়েছেন। বয়সে তরুণ ও রাজনীতিতে ‘শিশু’ ববির কার্যক্রমে এখনো ক্ষুব্ধ জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা। দলের বড় একটি অংশ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না ববিকে।

জাতীয় পার্টির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, ‘এইচ এম এরশাদের মতো একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির ও প্রবীণ রাজনীতিকের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ববির কোনো পরামর্শ বা উপদেশ কাজে আসবে এমনটা কল্পনা করতেই হাস্যকর মনে হয়। কোথায় এরশাদ আর কোথায় ববি।’ তিনি বলেন, ‘এরশাদ সাহেবের বয়স হয়েছে। এই শেষ জীবনে তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মধ্যে অনেক ভুল আছে। কথাবার্তাও ঠিকঠাক বলতে পারেন না। এখন ববিকে বিশেষ উপদেষ্টার চেয়ার দেওয়া তার আরেকটি বড় ভুল। কারণ ববির বাবা একজন বিতর্কিত মানুষ। নানা অনৈতিক ও অবৈধ উপায়ে টাকা আয়ের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এমন বিতর্কিত মানুষের রাজনীতিতে আনাড়ি ছেলেকে উপদেষ্টা করায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে এরশাদ সাহেবের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে বৈ বাড়েনি।’

দুদকের চোখে মুসার সম্পদ ‘অস্বাভাবিক’

গত ৩ নভেম্বর দুদকের নিয়মিত সভায় মুসা বিন শমসেরের বিষয়টি আলোচনা হয়। দুদক চেয়ারম্যান বদিউজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত ছিলেন কমিশনার সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ও নাসির উদ্দীন আহমেদ। সভায় কমিশনাররা সবাই দেশ-বিদেশে মুসার অর্জিত সম্পদের বিষয়টি ‘অস্বাভাবিক’ বলে মন্তব্য করেন। সিদ্ধান্ত হয় অনুসন্ধানের। আর এর দায়িত্ব দেওয়া হয় উপ-পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলীকে।

পরে দুদক কমিশনার সাহাবুদ্দিন চুপ্পু সাংবাদিকদের জানান, মুসা বিন শমসেরের স্বচ্ছ-অস্বচ্ছ সব সম্পদ খতিয়ে দেখা হবে। বিলাসী জীবনযাপন ও গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত তার সম্পদ কমিশনের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। এত অর্থের জোগান কোথা থেকে আসে তা তদন্ত করে দেখা হবে।

দুদকের এই কমিশনার আরও বলেন, ‘চলতি বছরের জুনে ‘বিজনেস এশিয়া’ ম্যাগাজিনে মুসা বিন শমসেরের জীবনযাপন নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য আমলে নিয়ে তার নামে-বেনামে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। ম্যাগাজিনের ওই প্রতিবেদনে তার বিলাসবহুল জীবন, দেশে-বিদেশে অর্জিত অর্থ-সম্পদের চমকপ্রদ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সুইস ব্যাংকে তার নামে সাত বিলিয়ন ডলার, ৬০ কোটি টাকা দামের ঘড়ি ব্যবহারসহ জৌলুসপূর্ণ জীবনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যা কমিশনের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে।’

মুসা বিন শমসের ডেটকো গ্রুপের মাধ্যমে জনশক্তি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবেও তিনি বহির্বিশ্বে বেশ পরিচিত।



অতীতেও সমালোচনা মুসাকে ঘিরে

১৯৯৭ সালের কথা। সেসময় যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে অনুদান দিতে চেয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন মুসা বিন শমসের। লেবার পার্টির টনি ব্লেয়ার নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর জন্য তার পাঁচ মিলিয়ন ডলার অনুদানের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। বাংলা উইকিপিডিয়ায় মুসার জীবনযাপন সম্পর্কে বলা হয়, তিনি বাংলাদেশের ‘বিজনেস মোগল’ নামে পরিচিত। তিনি অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক পরিচিত। এ নিয়ে তিনি বিশ্বব্যাপী বিতর্কিতও।

২০১১ সালের ২৪ জুন মুসা বিন শমসেরের ব্যাংক হিসাব চেয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তার নো ইউর কাস্টমার (কেওয়াইসি) ফর্মেরও সব তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছিল। একই সময়ে তফসিলী ব্যাংকগুলোকে তার স্থায়ী, চলতি, সঞ্চয়ী, ডিপিএস, এসডিপিএস, এফডিআরসহ সব ধরনের হিসাব-নিকাশ পাঠানোর নির্দেশ দেয়।

এছাড়া নিয়মবহির্ভূত লেনদেনের জন্য ২০০৯ সালে মুসা বিন শমসেরের সাত বিলিয়ন ডলার ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছিল সুইস ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। পরে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তিনি একাধিকবার শীর্ষ খবর হয়েছিলেন।

সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত ফোবর্স ম্যাগাজিনের এক হিসাব অনুযায়ী, মুসা বিন শমসেরই বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তার মোট সম্পদ প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের ওপরে।

মুসার জৌলুসপূর্ণ জীবনযাপন

রাজধানীর অভিজাত গুলশান এলাকায় বাড়ি বানিয়েছেন মুসা বিন শমসের। সেখানে থাকেন পরিবার নিয়ে। লিভিং রুমসহ প্রাসাদের গুরুত্বপূর্ণ স্থানের ছাদ অবধি শোভা পাচ্ছে বড় বড় ঝাড়বাতি। ঘরগুলোর মেঝে কার্পেটে মোড়া। লিভিং রুমে আছে সুপরিসর ডাইনিং স্পেস। মুসার বাসার স্টাইল-আয়োজন কর্মকা- সবকিছুই ফাইভ স্টার মানের। এসব প্রচার করে বেড়ান মুসা।

মুসা বিন শমসেরের তিন সন্তান। তারা হচ্ছেন জাহানারা বিনতে মুসা ন্যান্সী, হাজ্জাজ বিন মুসা ববি ও আজ্জাত বিন মুসা জুবি। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, প্রিন্স মুসা হীরকখচিত যে জুতো পরেন তার মূল্য লক্ষ ডলার। তার সংগ্রহে এমনি রতœখচিত হাজারো জুতো রয়েছে। তার পরনের কয়েকটি স্যুট স্বর্ণসুতাখচিত। তিনি নিত্য গোসল করেন নির্জলা গোলাপ জলে।

তার সংগ্রহে নাকি মূল্যবান স্যুট রয়েছে। প্রতিটি স্যুটের দাম পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার পাউন্ড। যা শুধু তার জন্য তৈরি করা হয়েছিল বলে প্রচার করে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডিজাইনার বলে খ্যাত প্রিওনি বেলভেস্ট এবং ইটালির আবলা এবং ফ্যান্সিসকো স্মলটো ও ক্রিশ্চিয়ান ডিয়রের বিশেষ ব্রান্ডের অতি মূল্যবান পোশাক-আশাক দিয়েই তার আলমারি ভরা। তার হাতের সবচেয়ে মূল্যবান ঘড়ির ডায়াল এবং ব্রেসলেট হচ্ছে হীরকখচিত। যার মূল্য অর্ধমিলিয়ন ডলার এবং তার সবচেয়ে মূল্যবান ঘড়ির বেল্ট, কাফলিঙ্ক-এর সেটের মূল্য ১.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কেবল তার জন্য প্রস্তুতকৃত এই মূল্যবান ঘড়িটি তৈরি করা হয়েছিল ২৭ মাসেরও বেশি সময় ধরে। বিশ্ব বিখ্যাত রোলেক্স কোম্পানি এই অত্যাশ্চর্য ঘড়িটির প্রস্তুতকারক।- সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে