logo ২৯ এপ্রিল ২০২৫
অন্ধকার সুড়ঙ্গে জামায়াত
আল ফারুক ও হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
১০ নভেম্বর, ২০১৪ ১৯:৪০:৪৯
image


আপিল বিভাগে একাত্তরে আলবদর নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে গত বুধবার ডাকা প্রথম দিনের হরতালের সকাল বেলা। নয়টার দিকে রাজধানীর বড় মগবাজার এলাকায় জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আশপাশের বইয়ের দোকানগুলো তখনো বন্ধ। দোকানগুলো এখনো বন্ধ কেন? একজন মুদি দোকানির (যিনি নিজেও জামায়াত সমর্থক) জবাব এলো, ‘কোথা থেকে এসেছেন কে জানে, আপনি জানেন না কারা হরতাল ডেকেছে?’



 





-‘হ্যাঁ, জানি তো, জামায়াত।’

-‘হরতালে কি দোকানপাট খোলা থাকে?’

-আপনি যে রেখেছেন?

-‘আমার তো খাদ্য বিভাগ। তাই বাধ্য হয়ে রাখতে হয়েছে।’

মিনিট পাঁচেক পর আবারও দেখা সেই দোকানির সঙ্গে। দ্বিতীয়বার দেখে বললেন, ‘আচ্ছা ভাই, আপনার কী লাগবে?’

-‘জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র’।

জবাব শুনে সেই দোকানি বললেন, ‘শোনেন, গঠনতন্ত্রের পক্ষের লোক, বিপক্ষের লোক সবাই বিপদে আছে। নিরাপদে চলে যান।’

-‘চলে যাব কেন?’

-‘আশপাশে পুলিশ, গোয়েন্দার লোকজন। ওরা সব নজর রাখছে।’

-‘তা রাখুক। কিন্তু গঠনতন্ত্র আমার চাই, একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?’



 





শুরুতে অসম্মতি জানালেন। কিন্তু বারবার অনুরোধ করার একপর্যায়ে ওই ব্যক্তি নিজের দোকানে ঢুকলেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটি গঠনতন্ত্র বের করে কাগজে মোড়ালেন। সুতো দিয়ে বেঁধে হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন, ‘সোজা চলে যান। কোথাও দাঁড়াবেন না। সময় খারাপ।’



 





২২ টাকা দাম মিটিয়ে ফিরে আসতে আসতে পেছন ফিরে দেখা গেল, ওই ব্যক্তি তখনো তাকিয়ে আছেন ফেরার পথে।



 





জামায়াতের সমর্থক এক দোকানির এমন আচরণ যেন জামায়াতের সামগ্রিক চিত্রের প্রকাশ।



 





শুধু ঢাকা বলে নয়, প্রায় সারা দেশেই নিষিদ্ধ সংগঠনের মতো আচরণ করছে জামায়াতে ইসলামী। কোথাও প্রকাশ্য কোনো কর্মসূচি দিতে পারছে না দলটি। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে এরই মধ্যে, আরেক নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের দন্ড কার্যকর এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। দলটির গুরু হিসেবে পরিচিত গোলাম আযমের মৃত্যু হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কারাবন্দি অবস্থায়।



 





দলের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, অর্থদাতা হিসেবে পরিচিত নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসির দন্ড হয়েছে ট্রাইব্যুনালে। নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আজীবন থাকতে হবে কারাগারে। আরেক নায়েবে আমির আব্দুস সুবহান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামের বিচারও চলছে ট্রাইব্যুনালে।



 





কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের আগে জামায়াতের কর্মী-সমর্থকরা বিশ্বাসও করতে পারেনি সরকার এই দন্ড কার্যকর করতে পারবে। তাদের জোর বিশ্বাস ছিল, দেশে সহিংসতা এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সরকারের পক্ষে জামায়াত নেতাদের অন্তত ফাঁসি দেওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু এখন ভেঙে পড়েছে তাদের সেই বিশ্বাসের দেয়াল।



 





৫ জানুয়ারির নির্বাচন সহিংসতা করে ঠেকাতে পারলে আওয়ামী লীগ বেকায়দায় পড়বে বলেই ধারণা ছিল জামায়াতের। কিন্তু তা না হওয়ায় জামায়াতের বিপদ এখন বেড়েছে। সরকার এখনো জামায়াতকে নিষিদ্ধ না করলেও নিষিদ্ধ দলের মতোই কাজ চালাতে হচ্ছে দলটিকে। অবশ্য উচ্চ আদালতের নির্দেশে নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধনটিও স্থগিত করেছে। সব মিলিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা দলটি। পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক যে, বলতে গেলে নেতৃত্বে সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে দলটি।



 





মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরে গণহত্যা চালানোর দায়ে মুক্তিযুদ্ধের পর পর নিষিদ্ধ করা হয় জামায়াতকে। দলের সব নেতা তখন যান আত্মগোপনে। ধরা পড়েন কেউ কেউ, সাজাও হয় কারো কারো। তবে গোপনে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে মিশে গিয়ে জামায়াতকর্মীরা নানা নাশকতা চালাতে থাকেন। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেন জামায়াত নেতারা। আর জিয়াউর রহমানের বদান্যতায় দেশে ফেরেন গোলাম আযম। ১৯৭৮ সালে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ-আইডিএল নামে সক্রিয় হয় ধর্মভিত্তিক দলগুলো। জামায়াত সেখানে রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পরে নিজ নামেই রাজনীতি শুরু করে জামায়াত।



 





জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের সুযোগে দেশজুড়ে নিষিদ্ধ হওয়ার আগের মতোই কাজ শুরু করে জামায়াত। আর্থিক শক্তি আর ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে ধীরে ধীরে প্রভাব বাড়তে থাকে স্বাধীনতাবিরোধী দলটির। অবশ্য দলের নেতাদের বিচারের দাবিও ওঠে বরাবর। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর গোলাম আযমকে আমির ঘোষণার পর দেশজুড়ে স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠে জোরালো আন্দোলন। ১৯৯৪ সালে বেশ কয়েকজন জামায়াত নেতার অপরাধ মৃত্যুদন্ড পাওয়ার তুল্য বলে ঘোষণা করে গণ-আদালত। এর পর থেকেই ক্রমে চাপ বাড়তে থাকে জামায়াতের ওপর। তরে ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার পর ক্ষমতার স্বাদ নেয় দলটি। ১৯৭১ সালে যে দেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে জামায়াত, সেই দেশের মন্ত্রিত্ব নেন দুই নেতা।



 





আলবদর বাহিনীর দুই শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের গাড়িতে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা লাল-সবুজের পতাকা ক্ষুব্ধ করে তোলে দেশবাসীকে। জোট সরকারের পতনের পর ২০০৭ সালে জামায়াত নেতাদের বিচারের দাবিতে সক্রিয় হয় মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের সংগঠন সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম। সাড়া দেয় দেশবাসী। নির্বাচনী অঙ্গীকার হিসেবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি ইশতেহারে যোগ করে আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পেছনে এই অঙ্গীকার গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করে বলেই মনে করা হয়। নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও নানা ঘটনায় বিচারে বিলম্ব আর জটিলতার কারণে তৈরি হয় সংশয়। এমনকি বিচার চলাকালেও ছড়ায় নানা গুজব। আর নানা গুজব ছড়িয়ে চাপ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় জামায়াত। নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রকাশ্যে আসার পর এতটা বিপাকে কখনো পড়েনি জামায়াত।



 





জামায়াতের অস্তিত্ব আদৗ থাকবে কি না, তা নিয়েও তৈরি হয়েছে শঙ্কা। কারণ দলটির নেতাদের গড়ে তোলা শত শত প্রতিষ্ঠান পরিচালনা আগের মতো নতুনদের পক্ষে করা সম্ভব কি না, তা নিয়েও তৈরি হয়েছে সংশয়। যদিও নেতারা কর্মীদের কাছে কিছুই স্বীকার করতে চান না।



 





দলটির সহকারী প্রচার সম্পাদক ও কর্মপরিষদ সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মুক্ত করতে আইনি চেষ্টা চলছে। তাদের মুক্ত করতে ব্যর্থ হলেও নেতৃত্বের সংকট হবে না। কারণ সংগঠনে তরুণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে চিন্তা চলছে।’



 





তবে মতিউর রহমান আকন্দ যাই বলুক না কেন, ধীরে ধীরে নিষিদ্ধ দলের মতো আচরণ করছে জামায়াত। ধর্মের অপব্যাখ্যা ও আর্থিক সুবিধা দিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব মানুষদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করলেও তা তেমন সুফল মিলছে না। কারণ ধর্মভিত্তিক অন্য দলগুলোর সঙ্গে জামায়াতের আকিদাগত বিরোধ দলটির বিপাকের আরেক কারণ। জামায়াতকে ইসলামের পক্ষের শক্তি হিসেবেই বিবেচনা করেননি দেশ বরেণ্য আলেমরা। দেশের হাজার হাজার কওমি মাদ্রাসায় জামায়াতের আধ্যাত্মিক গুরু আবুল আলা মওদুদীর মতবাদের বিরুদ্ধে বই পড়ানো হয়। ‘জামায়াত কেন ইসলামের শত্রু’ সে ব্যাখ্যা দিয়ে শত শত বই লিখেছেন ইসলামী চিন্তাবিদরা।



 





বিচার আর নিষিদ্ধের মুখোমুখি জামায়াত

দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছিল ধীর গতিতেই। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যে পর পর তিনটি রায়ের পর বেশ গতি পেয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এখন ঘুরে-ফিরে সামনে আসছে সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার কবে? এ প্রশ্নের উত্তর নেই ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রীয় আইনজীবীদের কাছেও। কারণ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলছেন, বিদ্যমান ট্রাইব্যুনাল আইনে কোনো সংগঠনের বিচার ও শাস্তির বিধান নেই। তাই ট্রাইব্যুনালের অধীনে জামায়াতের বিচার করতে হলে আইনে সংশোধনী আনতে হবে।



 





ট্রাইব্যুনালের তদন্তদল তাদের প্রতিবেদনে জামায়াতকে যুদ্ধপরাধীদের সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে। গত ২৫ মার্চ ওই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। ওই প্রতিবেদনের পর প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ জমা দেবে এবং জামায়াতের বিচার শুরু হবে, এমনটা আশা করা হয়েছিল। কিন্তু তা হয়নি।



 





জানতে চাইলে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম জানান, তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হয়েছিল। তাদের কাজ ছিল প্রতিবেদন পর্যালোচনার পাশাপাশি অভিযোগ জমা দেওয়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। কারণ আইনমন্ত্রী বলেছেন, আইন পরিবর্তন ছাড়া ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের বিচার করা সম্ভব নয়। সরকারের বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, আইন সংশোধন করে জামায়াতের বিচারের উদ্যোগও নিতে যাচ্ছে সরকার।



 





আইনের মারপ্যাঁচে জামায়াতের বিচার পেছানোর বিষয়টি ভিন্ন চোখে দেখছে জামায়াতের বিচারের দাবিতে সরব গোষ্ঠী। তারা বলছে, সরকার চায় না জামায়াতের বিচার করতে। তাই এ ধরনের টালবাহানা করা হচ্ছে। সরকার জামায়াতকে জিইয়ে রেখে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চায়।



 





সরকার চাইলে নির্বাহী আদেশেই যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে বলে মনে করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ের পর্যবেক্ষণে জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জামায়াত দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে যুদ্ধাপরাধ করেছে। এখানে ‘চেইন অব কমান্ডের’ দায়ও পরিষ্কার।



 





শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আইনটি সংশোধনের জন্য কেন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, সেটা একমাত্র আইনমন্ত্রীই ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু এ কারণে মানুষের হতাশা বাড়ছে এবং সবাই ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ছে। আর কত দিন অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে কে জানে।’



 





জামায়াতের বিচার করতে সরকার এরই মধ্যে ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনে খসড়া তৈরি করেছে। তবে এখনো তা অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। খসড়া অনুমোদন হলে ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০ (২) ধারায় সংগঠনের শাস্তির বিধান যোগ হবে। তাতে ট্রাইব্যুনাল দোষী সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে এবং এই নামে বা অন্য কোনো নামে সংগঠনটির ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে। ট্রাইব্যুনাল চাইলে সংগঠনটির সদস্যদের সাজাও দিতে পারবেন। এ ছাড়া আইনের ৪ নম্বর ধারা সংশোধনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো সংগঠনের কার্যনির্বাহী কমিটি অথবা কেন্দ্রীয়, আঞ্চলিক বা স্থানীয় কমিটির সদস্য যদি অপরাধ করেন, তা হলে ওই অপরাধের জন্য সদস্যের পাশাপাশি সংগঠনও দায়ী হবে।



 





তবে ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আরেক আইনজীবী রানা দাসগুপ্ত অবশ্য মনে করেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ট্রাইব্যুনালের আইনে ব্যক্তি এবং সংগঠন দুইয়ের বিচার করা যাবে। তবে সংগঠনের ক্ষেত্রে শাস্তির বিষয়টি বিচারকের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তাই প্রচলিত ট্রাইব্যুনাল আইনেই জামায়াতের বিচার সম্ভব। কিন্তু সরকার চাইলে সাজার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দিতে আইন সংশোধন করতে পারে।



 





জামায়াতকে নির্বাহী আদেশেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে বলে মনে করেন যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে আন্দোলনকারীরা। তবে সরকার এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছুই বলছে না।

দলীয় কর্মসূচি পালনে কর্মীদের অনীহা!



 





ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন হিসেবে কেন্দ্রঘোষিত সব কর্মসূচি পালনে জামায়াতকর্মীদের আপ্রাণ চেষ্টাই এত দিন দেখে এসেছে দেশবাসী। সে জন্য জামায়াতের দলীয় শৃঙ্খলা আর কর্মীদের কর্তব্যনিষ্ঠা উদাহরণ হয়েছে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও। সীমিত সমর্থন আর কর্মী বাহিনী নিয়ে সর্বোচ্চ প্রভাব বিস্তারের কাজ বছরের পর বছর ধরে করে এসেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বানচালের চেষ্টায় বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনের সময় বিএনপিকর্মীরা তেমন সক্রিয় না থাকলেও জান-প্রাণ দিয়ে খাটে জামায়াতের কর্মীরা। জামায়াত অধ্যুষিত সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নীলফামারী, ঝিনাইদহ আর তাদের প্রভাব আছে এমন এলাকা যেমন রংপুর, জয়পুরহাট, বগুড়া, নওগাঁ, রাজশাহী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, চট্টগ্রামে জামায়াতকর্মীদের সক্রিয়তা স্বপ্ন দেখাচ্ছিল ২০ দলের নেতাদের। ৫ জানুয়ারি ভোট ঠেকাতে যেসব এলাকায় সহিংসতা হয়েছে তার প্রায় সবগুলোই জামায়াত প্রভাবিত হিসেবে পরিচিত।



 





কিন্তু নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থতার পর এই জামায়াতের কর্মীদের নিষ্ক্রিয়তা রীতিমতো বিস্ময় জাগাচ্ছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে। আপিল বিভাগ জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির দন্ড কমিয়ে আমৃত্যু কারাদন্ড দেওয়ার পর জামায়াত হরতাল ডাকলেও কর্মীরা মাঠে নামেনি বললেই চলে। কর্মীদের এমন আচরণে সরকারের সঙ্গে জামায়াতের আঁতাতের গুজবও ছড়ায়। এর মধ্যে এক সপ্তাহের মধ্যে গোলাম আযমের মৃত্যু, ট্রাইব্যুনালে মতিউর রহমান নিজামী ও মীর কাসেম আলীর ফাঁসি আর আপিল বিভাগে কামারুজ্জামানের ফাঁসির দন্ড বহাল রাখার পর সেই সরকার-জামায়াতের গুজব আর ডালপালা মেলতে পারেনি। কিন্তু আগের মতোই নিষ্ক্রিয় থাকে কর্মীরা।



 





জামায়াত ও শিবিরের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন কর্মসূচি পালনে মূলত শিবিরকর্মীদের ওপর নির্ভর করে মূল দল। পরীক্ষার মৌসুমে এই কর্মীরা মাঠে নামতে চাইছে না। কারণ পুলিশের হাতে ধরা পড়লে পরীক্ষা দেওয়া হবে না আর এতে করে এক বছর নষ্ট হবে। তা ছাড়া এখন আন্দোলন করেও সরকার পতন ঘটানো সম্ভব নয়- সে চিন্তাও কর্মীদের মধ্যে ঢুকেছে বলেও মনে করছেন নেতারা। আর নিজেরা আত্মগোপনে থেকে কর্মীদের চাপ দিতেও পারছেন না নেতারা।



 





বিদেশি যোগাযোগ প্রকাশ

নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি এবং একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের মুক্তির দাবিতে যে নজিরবিহীন সন্ত্রাস ও সহিংসতা করেছে জামায়াত তার অর্থের উৎস নিয়ে অনেক আগে থেকেই প্রশ্ন উঠেছে। দেরিতে হলেও মিলেছে সেই উত্তর। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ফাঁস করে দেওয়া খবরে বলা হয়েছে, সহিংসতার জন্য হাজার হাজার ককটেল, বিস্ফোরক, গানপাউডার, অস্ত্রশস্ত্র কেনার জন্য অর্থ দিয়েছে ভারতের বিতর্কিত বিনিয়োগকারী গোষ্ঠী সারদা গ্রুপ।



 





সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে বিপাকে আছে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস। দলটির সংসদ সদস্য আহমেদ হাসান ইমরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তার সঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গোপন আঁতাত ছিল। তার মাধ্যমেই সরদা বাংলাদেশ হয়ে পশ্চিমের দেশগুলোতে টাকা পাচার করেছে। এসব অর্থের বড় একটি অংশ জামায়াতকে দিয়েছে সহিংসতার রসদ হিসেবে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যতটাই ভালো, পশ্চিমবঙ্গে সঙ্গে দূরত্ব যেন ততটাই বেশি। তিস্তাচুক্তি, স্থলসীমান্ত চুক্তির নিয়ে বরাবরই বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান পশ্চিমবঙ্গ সরকারপ্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মূলত তার বিরোধিতার কারণেই কেন্দ্রে সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দুই দেশের অমীমাংসিত এসব বিষয়ের কোনো কূল-কিনারা হচ্ছে না। এর আগে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের আলাদা সফরে এসব বিষয়ে মীমাংসা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মমতার বিরোধিতার কারণেই পালে হাওয়া পায়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, এসব কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে মমতার সম্পর্কের একটা অলিখিত দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে বহু আগে। তৃণমূল কংগ্রেস তাই বাংলাদেশের ক্ষমতা পালাবদলের দিকে তাকিয়ে ছিল। নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে এমন দলকে ক্ষমতায় আনতেই জামায়াতকে কোটি কোটি টাকা দিয়ে সহিংসতায় উস্কে দেওয়া হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে।



 





এই মন্তব্যের যথেষ্ট কারণও আছে। কারণ জামায়াতে ইসলামী হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে সহিংসতার জন্য সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোকেই চিহ্নিত করেছিল। ওই এলাকায় সহিংসতা সৃষ্টির জন্য পর্যাপ্ত রসদও হয়তো মজুদ ছিল তাদের কাছে। অন্যদিকে ছিল পশ্চিমবঙ্গের একটি অংশের পৃষ্ঠপোষকতা।



 





সরদার কোটি কোটি টাকা জামায়াতের পেছনের ঢালার বিষয়টি এড়িয়ে যায়নি গোয়েন্দাদের চোখ। দেশের গোয়েন্দারা অনেক আগেই সরকারকে জানিয়েছেন বিষয়টি। সে অনুযায়ী এ নিয়ে ভারত সরকারের কাছে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ। আর জামায়াতকে অর্থ দেওয়ার অভিযোগে ভারতের সারদা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার।



 





ব্যাপক সহিংসতায় দুর্নাম

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ব্যাপক সহিংসতা চালিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। এতে ঘটেছে ব্যাপক প্রাণহানি। আহত হয়েছে অনেকে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে গত ১২ ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার। ওই ঘটনার প্রতিবাদে ১৫ ডিসেম্বর সারা দেশে হরতালের ডাক দেয় জামায়াতে ইসলামী। বরাবরের মতো হরতাল কর্মসূচিকে ঘিরে ব্যাপক সহিংসতা চালায় যুদ্ধাপরাধের অভিযুক্ত দলটি। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী লালমনিরহাট ও জয়পুরহাটে প্রাণ হারায় ছয়জন। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলায় ৪০ হাজারের বেশি গাছ কাটে জামায়াতকর্মীরা।



 





গত ২৮ ও ২৯ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ফাঁসির আদেশের আগে ও পরে সারা দেশে জামায়াত-শিবিরের সহিংসতায় নিহত হয়েছে ৪৬ জন। এর মধ্যে আছেন পুলিশ, যুবলীগকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সহিংসতার ঘটনা বেশি ঘটেছে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে। সহিংস হামলায় সাতক্ষীরায় ৯ জন, রংপুরের মিঠাপুকুরে ছয়জন, গাইবান্ধায় চার পুলিশ সদস্যসহ সাতজন, ঠাকুরগাঁওয়ে পাঁচজন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক প্রকৌশলীসহ দুজন, সিরাজগঞ্জে দুজন, বগুড়া, দিনাজপুর, নাটোর, মৌলভীবাজারে একজন করে চারজন, চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় এক পুলিশ সদস্যসহ দুজন, নোয়াখালীতে পাঁচজন, কক্সবাজারে দুজন প্রাণ হারান। এর বাইরে রাজধানীতে প্রাণ হারান দুজন।



 





এত ব্যাপক সহিংসতার কোনো বিচার হয়েছে, এমন নজির নেই। ভুক্তভোগীরা বলছেন, জামায়াতের সহিংসতায় প্রাণ হারানো মানুষের পরিবার বিচারের দাবি কার কাছে করবে? আদৌ কি এসবের বিচার হবে? যদি এ ধরনের একটি ঘটনার বিচার হলে পরবর্তী সময়ে কেউ আর দ্বিতীয়বার এমনটি করার সাহস দেখাত না।



 





বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কের টানাপড়েন

জোটবন্ধু বিএনপির সঙ্গে দিন দিন সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ছে জামায়াতে ইসলামীর। বলতে গেলে জামায়াতের কোনো কর্মসূচিতেই নেই বিএনপির প্রকাশ্য সমর্থন। একই অবস্থা জামায়াতের ক্ষেত্রেও। বিএনপির ডাকা আন্দোলনে আগে জামায়াতই থাকত রাজপথে। কিন্তু এখন জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের ওই অর্থে সক্রিয় হতে দেখা যায় না। কয়েক দিন আগে জামায়াতের সাবেক প্রধান গোলাম আযম মারা যাওয়ার পর কোনো শোকবার্তাও দেয়নি বিএনপি। আলোচনা আছে, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশেই গোলাম আযমের মৃত্যুতে শোকবার্তা দেওয়া ও তার জানাজায় অংশ নেওয়া থেকে দূরে থেকেছে বিএনপি। এ নিয়ে গোলাম আযমের ছেলে আমান আযমী ফেসবুকে বিএনপিকে ‘অকৃতজ্ঞ’ উল্লেখ করে স্ট্যাটাসও দিয়েছেন। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, জামায়াতকে ছাড়া বিএনপি কোনো নির্বাচনে জয়ী হতে পারবে না। যদিও জামায়াত বলছে, এটি তাদের দলীয় বক্তব্য নয়। বিএনপিও এটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে বলে মনে হয়নি। কারণ ওই ঘটনার পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘গোলাম আযমের ছেলে ফেসবুকে যা লিখেছেন এটি তার নিজস্ব মতামত।’ পরে অবশ্য এই মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন গোলাম আযমপুত্র।



 





রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রকাশ্যে দুই দলের শীর্ষ নেতৃত্ব যাই বলুক না কেন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের যে দূরত্ব দিন দিন বাড়ছে তা সহজেই অনুমেয়। কারণ যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির পরও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি বিএনপি। এমনকি ট্রাইব্যুনালের কোনো রায়ের ব্যাপারেও কথা বলেনি দলটি। অথচ মিত্র হিসেবে জামায়াত আশা করছিল তাদের এই দুর্দিনে বিএনপি পাশে থাকবে। তাই আগামী দিনে বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচিতে জামায়াতের কতটুকু সমর্থন থাকবে, তা এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।



 





জামায়াতের কেন্দ্রীয় একজন নেতা বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের জোট শুধু নির্বাচনের জন্য নয়। সুখে-দুঃখে আমরা একে অপরের পাশে থাকব, এটা ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু এখন অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বিএনপি গা বাঁচিয়ে চলতে চাচ্ছে। তৃণমূল জামায়াতের নেতা-কর্মীদের মনেও এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। ঢাকার বাইরে গেলেই এসব প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। রাজনীতিতে বিএনপি ও জামায়াত দুই দলই ঝুঁকির মধ্যে আছে। এই পরিস্থিতি থেকে উঠে আসতে হলে সুবিধাবাদী আচরণ পরিহার করতে হবে। তা না হলে আগামী দিনে বিএনপি আন্দোলনে জামায়াতকে পাশে না পেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।’



 





কেন্দ্রে নেতৃত্বের সংকট

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১০ সালে একে একে গ্রেপ্তার হন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। গোলাম আযম ছাড়া বাকিরা সবাই জামায়াতের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম নির্বাহী পরিষদের সদস্য। আগে নির্বাহী পরিষদের সদস্য ১৫ জন থাকলেও শীর্ষ ৯ জন নেতা মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ালে নেতৃত্ব সংকটে পড়ে জামায়াত। সেই সংকট তাৎক্ষণিকভাবে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করলেও এখনো সফল হয়নি।



 





জামায়াতের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমির নির্বাচিত হন তিন বছরের জন্য। সে অনুযায়ী আমির মতিউর রহমান নিজামীর মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। তিনি যুদ্ধাপরাধের দায়ে হাজতে আছেন তিন বছরের বেশি সময়। সেই থেকে ভারপ্রাপ্ত আমিরে চলছে জামায়াতে ইসলামী।



 





নির্বাহী পরিষদের বাকি সদস্যদের অনেকেই সংগঠনে সক্রিয় নন। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আ ন ম আব্দুজ্জাহের নিষ্ক্রিয়। সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুর রাজ্জাক ট্রাইব্যুনালের মামলা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। তবে বেশ কয়েক মাস ধরে তিনি নিজেও দেশের বাইরে। রাজ্জাক কবে ফিরবেন, তা বলতে পারছেন না কেউ। শুধু ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমদ (নায়েবে আমির), নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান ও ঢাকা মহানগর আমির রফিকুল ইসলাম খান সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছেন। তবে তারা কেউই প্রকাশ্যে নেই, কেবল জোটের সমাবেশে আত্মগোপন থেকে এসে বক্তব্য দেন। নানা হুমকি-ধমকি দিলেও তাদের কর্মীদের কর্মকান্ডে আগের মতো সেই জোস নেই আর।



 





জেলা ও মহানগর কমিটি নভেম্বরে ঘোষণা

আমির, কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ থাকছে আগের মতোই। এসব পদে বহাল থাকছেন একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দ-প্রাপ্ত নেতারাও। তবে জেলা ও মহানগর কমিটিগুলোতে পরিবর্তন আসছে। জামায়াতের দলীয় সূত্র জানায়, জেলায় জেলায় গোপন ব্যালটের মাধ্যমে রুকনরা নেতা নির্বাচন করেছেন। প্রায় ৩৭ হাজার রুকন এতে অংশ নেন। কেন্দ্র থেকে নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা জেলা ও মহানগর পর্যায়ে ঘুরে ঘুরে এসব ভোট সংগ্রহ করেছেন। ভোটাভুটি শেষ। এখন নভেম্বরের যেকোনো সময় তা প্রকাশ করা হবে।



 





জামায়াত নেতা মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘আমির নির্বাচন রুকন সম্মেলন ছাড়াও হতে পারে। নিজ নিজ জায়গা থেকে ভোট দেবে, নির্বাচন কমিশন সেটি ফলাফল আকারে প্রকাশ করবে। কিন্তু আমির নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংবিধানের যে বাধ্যবাধকতা ছিল, সেটি সংশোধন করার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে আমির নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা নেই।’



 





দলীয় সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার পর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দলীয় কাঠামো। এই পরিষদের বর্তমান মোট সদস্য ৪০। এই পরিষদের ওপরেই জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভার। এই পরিষদ কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্যদের মাধ্যমে মনোনীত। দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার নির্বাচন না হওয়ায় এই পরিষদ মনোনয়নও বন্ধ আছে। তবে যেকোনো সময় কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সর্বসম্মতিক্রমে এই পরিষদের সদস্য বাড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে মনোনীত সদস্যকে অবশ্যই কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য হতে হয়। এই কেন্দ্রীয় শুরা ও কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে থাকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ। এই পরিষদও কেন্দ্রীয় শুরার মাধ্যমে মনোনীত হয়। ২০১১ সালে এর সদস্য সংখ্যা ২১ হলেও বর্তমানে সদস্য সংখ্যা ২৬। এই পরিষদের নির্বাচনও এখন হবে না। কারান্তরীণ আমির মতিউর রহমান নিজামীকে রেখে কেন্দ্রীয় কোনো নির্বাচনে যাবে না জামায়াত। নিজামীর সর্বশেষ অবস্থার ওপর নির্ভর করছে সব কিছু।



 





নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামায়াত নেতা ও সাবেক একজন সংসদ সদস্য জানান, ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জামায়াতের রুকন সম্মেলন হয়। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রকাশ্যে আর রুকন সম্মেলন হয়নি। কিন্তু গোপনে বিশেষ রুকন সম্মেলন করে সংশোধন আনা হয় গঠনতন্ত্রে। ওই সংশোধনীর পর নিজামীকে আমির রাখা হয়।



 





জামায়াতের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ‘জামায়াতের সর্বোচ্চ ফোরাম হচ্ছে রুকন সম্মেলন। সিদ্ধান্তের ব্যাপারে চূড়ান্ত ক্ষমতা এই সম্মেলনের। এরপরই কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার ক্ষমতা। সদস্য সম্মেলনের সিদ্ধান্তের বিপরীতে না হলে সব বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার হাতে রয়েছে।’ তবে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, বছরে দুবার মজলিসে শুরার অধিবেশন করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা হচ্ছে না। বর্তমানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য ১৫৯।



 





জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মুক্ত করতে আইনি চেষ্টা চলছে। তাদের মুক্ত করতে ব্যর্থ হলেও নেতৃত্বের সংকট হবে না। কারণ সংগঠনে তরুণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে চিন্তা চলছে। আমির নির্বাচন রুকন সম্মেলন ছাড়াও হতে পারে। নিজ নিজ জায়গা থেকে ভোট দেবে, নির্বাচন কমিশন সেটি ফলাফল আকারে প্রকাশ করবে। কিন্তু আমির নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংবিধানের যে বাধ্যবাধকতা ছিল, সেটি সংশোধন করার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে আমির নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা নেই। - সাপ্তাহিক এই সময়ের সৌজন্যে