logo ২৯ এপ্রিল ২০২৫
নির্বাচনী মামলায় গলদঘর্ম বাদীরা, নিশ্চুপ কমিশন

বিলকিছ ইরানী
৩০ অক্টোবর, ২০১৪ ১২:১৬:২৭
image


এবার খুলনার রূপসা উপজেলার চেয়ারম্যান পদে জিতেছেন আওয়ামী লীগ নেতা কামাল উদ্দিন বাদশাহ। কিন্তু এই ফলাফল মেনে নিতে রাজি না মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নেতা এ এস এম মনিরুল হাসান বাপ্পী। তার দাবি, নির্বাচনে জালিয়াতি আর জবরদখল করে জিতেছেন বাদশাহ। ভোটের ফল বাতিল করে তাকে নির্বাচিত ঘোষণার দাবিতে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন বাপ্পী।

কিন্তু মাস চারেক হয়ে গেলেও মামলার কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। আসলে এই সময়ে শুনানিই হয়নি মামলার।  কেন হয়নি জানতে চাইলে মনিরুল হাসান বলেন, বিবাদী বারবার সময় নিচ্ছেন, কিন্তু হাজিরা দিচ্ছেন না। এভাবে ঝুলে যাচ্ছে মামলাটি। মামলা আদৌ শেষ হবে কি না, এখন সে বিষয়েই সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

নির্বাচনের ফল বাতিল করার দাবিতে মামলা করায় উপজেলা চেয়ারম্যানের সমর্থকরা উল্টো নানাভাবে তাকে ও তার সমর্থকদের মামলা দিয়ে হয়রানি করছে বলেও অভিযোগ করেছেন বাপ্পী। তিনি দাবি করেন, ভোটকেন্দ্র দখল এবং কারচুপির নানা ভিডিও ফুটেজও আছে তার কাছে।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কামাল উদ্দিন বাদশাহ বলেন, ‘আমার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভোটে জিততে না পেরে নানা কথা তুলেছেন।’ তিনি বলেন, ‘কেন্দ্র দখল আর জাল ভোটের অভিযোগের কোনো মানে হয় না। কেন্দ্রে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল। আমি কোনো অন্যায় করলে তারা আগে ধরতো আমাকে।’ ভিডিও ফুটেজ থাকার বিষয়ে মনিরুল হাসান বাপ্পীর দাবির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কামাল উদ্দিন বাদশাহ বলেন, ‘ভিডিও ফুটেজের প্রমাণ থাকলে তিনি তা প্রদর্শন করুক। আমার আপত্তি নেই।’

বাপ্পীর এই মামলাটির মীমাংসা কেন হচ্ছে নাÑজানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ বলেন, ‘নির্বাচনী বিরোধের মামলাগুলোতে কমিশনের কিছু করার নেই। আদালতেই এর মীমাংসা হবে। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে আদালত।’

কেবল বাপ্পী নয়, উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলের বিরুদ্ধে করা ৫০টিরও বেশি মামলার একটিরও কোনো কূলকিনারা হয়নি। কেবল উপজেলা নির্বাচন নয়, ৫ জানুয়ারির ভোটের ফলাফলের বিরুদ্ধে করা ১৫টি মামলার মধ্যে এক-দুটির মীমাংসা হলেও বাকিগুলোর কোনো অগ্রগতি নেই। আবার এক-দুটি মামলা বাদী হুমকির মুখে তুলে নিয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। এ ক্ষেত্রেও নির্বাচন কমিশন তাদের কিছু করার নেই বলে নীরব থেকেছে। কেবল এবার নয়, বাংলাদেশে দশটি সংসদ নির্বাচনে ভোটের ফলাফলের বিরুদ্ধে মামলা করে সংসদের মেয়াদ থাকাকালে কেবল দুইজন সংসদে বসতে পেরেছিলেন। একজন প্রথম সংসদে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং অন্যজন নবম সংসদে বিএনপি নেতা মাহমুদুল হাসান। নবম সংসদে আওয়ামী লীগের আরও একজন (জসিম উদ্দিনের) সংসদ সদস্যের পদ খারিজ হয়েছিল পরাজিত বিএনপি নেতা হাফিজ উদ্দিন আহমেদের মামলার কারণে।    

নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, নির্বাচনী মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হলে কারচুপি ঠেকানো কঠিন। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে মামলা শেষ হয় না বলেই পেশিশক্তি ও টাকার ব্যবহার করে যেনতেনভাবে ভোটে জেতার চেষ্টা করে। জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকÑসুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরেই নির্বাচনী বিরোধের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির কথা বলে আসছি। এটা করতে পারলে কেউ কারচুপি বা কেন্দ্র দখল করে ভোটে জিতে আসলেও পদ হারাবেন। এর একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে নির্বাচনী ব্যবস্থায়। তখন এটা প্রতিষ্ঠিত হবে যে, কারচুপি করে কোনো লাভ নেই, তাই প্রার্থীরা ওই পথে না গিয়ে ভোটারদের মন জয়ে ব্যস্ত থাকবে।’   

কিন্তু একটি সমস্যা রয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশনের ফলাফলের বিরুদ্ধে মামলা করা হলেও তা নিষ্পত্তিতে কমিশনের কোনো ভূমিকা নেই। তাছাড়া কোনো মামলায় কমিশনকে পক্ষভুক্ত করা হলেও কোনো কোনো মামলায় তা করা হয় না। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘বিষয়গুলো আদালতের। আদালতের বিষয়ে কিছু বলা যায় না। এখানে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার নেই।’

বর্তমান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ বলেন, ‘আমরা তো বিবাদী। আমরাও চাই মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। কিন্তু আদালতের ওপর তো আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আদালত রায় দিলে আমরা দ্রুত তা কার্যকর করি। নবম সংসদে দুটি আসনের মামলা নিষ্পত্তির পর আদালতের আদেশ অনুযায়ী আমরা একটিতে পুনর্নির্বাচন দিয়েছি আর অন্যটিতে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিজয়ী ঘোষণা করেছি।’

তাহলে কি কিছুই করার নেইÑজানতে চাইলে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সংস্থা ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমীন মুরশিদ বলেন, নির্বাচন কমিশনের কিছু করার নেই সেটা বলে বসে থাকলে চলবে না। নির্বাচন পরিচালনা যারা করেন, নির্বাচন নিয়ে কোনো ধরনের সমস্যা হলে তার সমাধানের দায়িত্বও তাদের থাকতে হবে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে এই ক্ষমতা কমিশনকে দেওয়া যেতে পারে অথবা নির্বাচনী মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তিতে আদালতেও বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে বলেও মনে করেন শারমীন মুরশিদ।

উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলের বিরুদ্ধে মামলা

নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী ৪৭৭টি উপজেলায় নির্বাচনের ফলাফল বাতিলের দাবিতে ৪৫টি উপজেলায় মামলা হয়েছে ৫০টি। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে চেয়ারম্যান পদ নিয়ে, সব মিলিয়ে ৩৯টি। তিনজন ভাইস চেয়ারম্যান এবং সংরক্ষিত নারী ভাইস চেয়ারম্যানের ফল বাতিল চেয়ে মামলা হয়েছে ৮টি।

সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে বরিশাল জেলায়। ভাইস চেয়ারম্যান পদে বরিশালের সদর উপজেলায় ও চেয়ারম্যান পদের বিরুদ্ধে গৌরনদী, সদর, বাকেরগঞ্জ, মুলাদী, বানারীপাড়া এই ৬ উপজেলায় বিজয়ী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পরাজিত প্রার্থীরা।

কুমিল্লার লাকসাম উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদের বিরুদ্ধে মামলা করেন সৈয়দ এ কে এম সরওয়ারউদ্দিন সিদ্দিকী। বরিশাল সদরে ভাইস চেয়ারম্যান পদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন পরাজিত প্রার্থী আনোয়ার হোসেন এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগরে ভাইস চেয়ারম্যান পদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন স ম আ সাত্তার।

ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলায় মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদের বিজয়ী পারুল বেগমের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন পরাজিত প্রার্থী ভারতী রানী রায়। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদের বিজয়ী নাজনীন নাহারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন পরাজিত প্রার্থী রায়হাতুন্নাহার কোকিলা। পিরোজপুরের জিয়ানগর উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিজয়ীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন পরাজিত দিলরুবা মিলন নাহার। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলায় মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিজয়ীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন পরাজিত প্রার্থী কল্পনা বেগম। ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলায় মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী রোকেয়া বেগম। নরসিংদীর শিবপুরে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিজয়ীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন পরাজিত প্রার্থী রোকেয়া বেগম। কুমিল্লার তিতাস উপজেলায় মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিজয়ীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন পরাজিত প্রার্থী শাকিলা পারভীন। লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলায় মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিজয়ীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন পরাজিত প্রার্থী রোখসানা আক্তার।

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ ও হাকিমপুর, রংপুরের পীরগঞ্জ, নওগাঁর আত্রাই, নাটোর সদর, যশোরের বাঘারপাড়া, মাগুরার মহম্মদপুর, বাগেরহাটের চিতলমারী, বরগুনার আমতলী, পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া, ময়মনসিংয়ের ধোবাউড়া, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরের শ্রীপুর, রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া, শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ, সিলেটের বালাগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, কুমিল্লার তিতাস, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ, ফেনীর ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া, চট্টগ্রামের সীতাকু-, চন্দনাইশ ও বাঁশখালী উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে বিজয়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন পরাজিত প্রার্থীরা।

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় এবারের নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন জামায়াতের নাজনীন নাহার। তার বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন বাতিল চেয়ে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী রায়হাতুন্নাহার কোকিলা। যোগাযোগ করা হলে রায়হাতুন্নাহার কোকিলা বলেন, ‘গঙ্গাচড়ায় কেন্দ্র আছে ৮১টি। অথচ ভোট গণনায় একটি কেন্দ্র গায়েব! এখান থেকে কোনো প্রার্থীরই ফলাফল পাওয়া যায়নি। ১১টি কেন্দ্রে ২২০০ ভোটে এগিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎই ফলাফল ঘুরে যায়।’

রায়হাতুন্নাহার বলেন, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করলে তারা গেজেট প্রকাশের পর মামলা করতে বলে। আর ১৯ মের ভোটের ফলাফলের গেজেট প্রকাশের এক মাসের মধ্যে রংপুরে মামলা করেন তিনি।  সেই মামলার কোনো অগ্রগতি নেই দেখে হতাশ তিনি। এ বিষয়ে জামায়াতের নাজনীন নাহারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও পাওয়া যায়নি তাকে।-এই সময়ের সৌজন্যে