logo ২৯ এপ্রিল ২০২৫
একটি মৃত্যু, দেশবাসীর উল্লাস
আল ফারুক
২৮ অক্টোবর, ২০১৪ ১০:৪৮:৩৩
image


একজন মানুষের মৃত্যুতে উল্লাস করতে নেই, এই সাধারণ বোধটির বদলে মৃত্যু-সংবাদে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনন্দ মিছিল বের হয়, তখন সেই মানুষটির প্রতি দেশবাসীর ক্ষোভ আর ক্রোধ কতটা তা সহজেই অনুমেয়।

মানুষ বার্ধক্যে পৌঁছলে সচরাচর মুছে যায় তার অতীত। কিন্তু বিখ্যাত আর কুখ্যাতদের ক্ষেত্রে তাই কি হয়? হয়নি গোলাম আযমের ক্ষেত্রেও। এতটাই কুখ্যাত হয়েছে তার নামটা, যেকোনো বাবা-মা যদি তার সন্তানের এই নাম রাখে তাহলে বড় হয়ে নাম পাল্টানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে বাংলাদেশে অহরহ। আর যারা বাবা-মায়ের দেওয়া নাম পাল্টাতে চান না, তাদেরকে সব সময় শুনতে হয় নানা কটূক্তি।

গোলাম আযমের কুখ্যাত হওয়ার কাহিনি শুরু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ কালোরাত থেকে। দেশ মাতা আক্রান্ত, আক্রান্ত বাংলার সাত কোটি মানুষ। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে হাজার হাজার বা লাখো মানুষ, অথচ গোলাম আযম দাঁড়িয়ে গেলেন  আক্রমণকারীদের পক্ষে। গণহত্যা চলছে দেশে কিন্তু গোলাম আযম বলছেন দাঁড়াতে হবে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে। কেবল নিজেদের লোকদের বলেননি, রীতিমতো রেডিওতে ভাষণ দিয়ে আহ্বান জানালেন হানাদার পাকিস্তানিদের পক্ষে দাঁড়াতে। পাকিস্তানি সেনা-কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর বৈঠক করে বের করলেন বাঙালি নিধনের মহাপরিকল্পনা। রাজাকার, আলবদর, আলশামসের মতো খুনি বাহিনী তৈরিতে পাকিস্তানিদের কেবল পরিকল্পনাই দিলেন না, এসব বাহিনী কীভাবে গড়ে তোলা যায়, কীভাবে বাঙালি নিধনে তাদের ব্যবহার করা যায় তার সব বন্দোবস্তও করেন গোলাম আযম। এমন একজন মানুষের মৃত্যুতে দেশে আনন্দের বন্যা বয়ে যাবেÑসেটাই স্বাভাবিক, বলছিলেন টিএসসিতে আনন্দ মিছিলে অংশগ্রহণকারী এক ছাত্র।

‘রাজনৈতিক জ্ঞান বুদ্ধি আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয়ে জানার পর থেকেই গোলাম আযমকে ঘৃণা করি। সারা জীবন মনপ্রাণ দিয়ে চেয়েছি এই নরপশুর যেন শাস্তি হয়। ৯০ বছরের কারাদ- নয়, চেয়েছিলাম মৃত্যুদ-। তা না হওয়াতে হতাশ ছিলাম। আজ এই মৃত্যুর সংবাদ আমাদের বুকের জ্বালা কিছুটা হলেও মিটিয়েছে। কুখ্যাত এই যুদ্ধাপরাধীকে আর বাংলাদেশকে বয়ে বেড়াতে হবে নাÑএটা ভেবে দৌড়ে বের হয়ে এসেছি বাইরে বলছিলেন তানিম আহমেদ নামে ওই মিছিলকারী।

বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই মানবতাবিরোধী অপরাধে ৯০ বছরের দ-প্রাপ্ত গোলাম আযমের মৃত্যুর খবর ভেসে আসছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাবেক জামায়াত নেতাকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয় কয়েক ঘণ্টা। অবশেষে রাত ১০টার কিছুক্ষণ পর চিকিৎসকরা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন এই মানবতাবিরোধী অপরাধীর মৃত্যুর। এরপরই আনন্দ প্রকাশ শুরু হয় দেশজুড়ে।

সংবাদ কর্মী ফারদিন ফেরদৌস তাৎক্ষণিক তার ফেসবুক পেজে লিখেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা ও গণহত্যার প্রতীক গোলাম আযমের মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে খোদার আদালতে। নানা ফাঁকফোকর ও ছলাকলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে এই যুদ্ধাপরাধ শিরোমনি কিঞ্চিত ফাঁকি দিতে পারলেও মহান খোদা কর্তৃক মৃত্যুদ- কার্যকরের মধ্য দিয়ে এই পাপিষ্ঠের চরম বিনাশ সাধিত হলো। শোকর আলহামদুলিল্লাহ।’

সাংবাদিক ওয়াসেক বিল্লাহ সৌধ তার ওয়ালে লিখেন, ‘কারও মৃত্যু সংবাদে আনন্দিত হতে শিখিনি। তবে গোলাম আযম লাইফ সাপোর্টে (আসলে মারা গেছে) শুনে মনের মধ্যে খুশির হাওয়া। একটা বিশেষ কারণে বিরক্ত সৌধর মনে স্বস্তির হাওয়া। এক শয়তানের জীবনাবসান হচ্ছে।  এ রকম হাজারো প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর।  

পাকিস্তান অন্তপ্রাণ গোলাম আযম

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপরই পাকিস্তান রক্ষায় উঠেপড়ে লাগেন গোলাম আযম। কেবল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলোচনা নয়, মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তাগুলোর বাস্তব রূপ দিতে নিজ দল জামায়াতকে ব্যবহার করেন পুরোপুরি। সারা দেশ সফর করে স্বাধীনতাবিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ এবং তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে কাজ করেন আপ্রাণ। জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে তার সে সময়ের কিছু বক্তব্য এবং কর্মকা- প্রকাশিত হয় গুরুত্বের সঙ্গে।

এবার দেখে নেই গোলাম আযমের বেশ কিছু উক্তি।

‘পাকিস্তান যদি না থাকে তাহলে জামায়াত কর্মীদের দুনিয়ায় বেঁচে থেকে লাভ নেই।’ দৈনিক সংগ্রাম, ২৬  সেপ্টেম্বর, ১৯৭১।

‘কালেমার ঝা-া উঁচু রাখার জন্য রাজাকারদের কাজ করে  যেতে হবে।’- দৈনিক সংগ্রাম, ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১।

‘দুষ্কৃতকারীদের ধ্বংস করার কাজে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ণ সহযোগিতা করছে।’ দৈনিক সংগ্রাম, ১৭ আগস্ট, ১৯৭১।

‘পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি মুসলমান নিজ নিজ এলাকার দুষ্কৃতকারীদের তন্নতন্ন করে তালাশ করে নির্মূল করবে।’ - দৈনিক সংগ্রাম, ১২ আগস্ট, ১৯৭১।

‘দুষ্কৃতকারীদের মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে দেশের আদর্শ এবং সংহতিতে বিশ্বাসী লোকদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য আবেদন করেছি।’ Ñদৈনিক সংগ্রাম, ২৯ আগস্ট, ১৯৭১।

‘তথাকথিত বাংলাদেশের আন্দোলনের ভুয়া গোলাগানে কান না দিয়ে পাকিস্তানকে নতুনভাবে গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি।’ Ñদৈনিক পাকিস্তান, ১৭ অক্টোবর, ১৯৭১।

 ‘কোনো ভালো মুসলমানই তথাকথিত বাংলাদেশের আন্দোলনের সমর্থক হতে পারে না। রাজাকাররা খুব ভালো কাজ করছে।’ Ñদৈনিক সংগ্রাম, ২ অক্টোবর, ১৯৭১।

‘বর্তমান মুহূর্তে আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করাই হবে  দেশের জন্য আত্মরক্ষার সর্বোত্তম ব্যবস্থা।’ -দৈনিক সংগ্রাম, ২৪ নভেম্বর, ১৯৭১।

‘পূর্ব পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা  বেশিরভাগ রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধ করছে এবং প্রাণ দিচ্ছে। এখানে জামায়াতের অবদানই বেশি। সুতরাং পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হলে জামায়াত থেকেই হতে হবে।”-দৈনিক সংগ্রাম

বয়স বিবেচনায় মৃত্যুদ- থেকে রেহাই

মানবতাবিরোধী অপরাধে অন্য মামলাগুলোর সঙ্গে গোলাম আযমের মামলায় কিছুটা পার্থক্য আছে। অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে সরাসরি হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনা হয় পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্রের।

ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এ টি এম ফজলে কবির রায় ঘোষণার আগে স্পষ্টতই বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত না থেকেও একটি বাহিনীর প্রধান হিসেবে এসব দায় তার ওপর বর্তায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন ৪(২) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো বাহিনীর প্রধান যদি সেই বাহিনীর কোনো অপরাধ দমন করতে ব্যর্থ হন এবং এর জন্য শাস্তি না দিয়ে থাকেন, তাহলে সেই বাহিনীর প্রধানের ওপর সমস্ত দায় বর্তায়। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ সেই অভিযোগই নিয়ে এসেছে।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত প্রধানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাঁচ ধরনের ৬১টি অভিযোগ আনা হয়। প্রধান অভিযোগ, তিনি একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যার মূল পরকিল্পনাকারী। অন্য অপরাধগুলো ছিলো ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উস্কানি, পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা এবং হত্যা-নির্যাতনে বাধা না দেয়ার। ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই পাঁচটি অপরাধে মোট ৯০ বছরের কারাদ- দেওয়া হয় জামায়াত গুরুকে। তবে এই সাজা যে করুণা, সেটাও বলেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল জানায়, গোলাম আযমের অপরাধ মৃত্যুদ-তুল্য, কেবল বয়স বিবেচনায় সে সাজা না দিয়ে তাকে কারাদ- দেওয়া হয়েছে।

গোলাম আযমের সাজা হলেও তার মৃত্যুদ- না হওয়ায় অসন্তোষ ছড়ায় দেশজুড়ে। ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষও জানায়, তারা এই রায় প্রত্যাশা করেনি। সাজা বাড়ানোর আবেদন করে আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আর গোলাম আযম আবেদন করে সাজা মওকুফের জন্য। আপিল বিভাগে শুনানির দিন ঠিক হয় ২ ডিসেম্বর। কিন্তু এই তারিখ ঠিক হওয়ার পরদিনই মারা গেলেন কুখ্যাত রাজনীতিবিদ।

বিজয়ের আগে আগে বাংলাদেশ ছেড়ে

বাংলাদেশবিরোধী প্রচারে গোলাম আযম

১৬ ডিসেম্বরে বিজয়ের আগে আগে বাঙালিদের দমনে আরও কী করা যেতে পারে সে পরিকল্পনা করতে ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান গোলাম আযম। কিন্তু আর ফিরতে পারেননি তিনি। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে তিনি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানা চক্রান্ত করেন।

পাকিস্তানে বসে মাহমুদ আলী ও খাজা খয়েরউদ্দীনের সঙ্গে মিলে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করেন গোলাম আযম। ১৯৭২ সালে লন্ডনে বসে সে কমিটির শাখা খোলেন গোলাম আযম। এরপর যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, সৌদি আরব ও লিবিয়ায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য দেন দ-প্রাপ্ত মানবতাবিরোধী অপরাধী। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে রিয়াদে আন্তর্জাতিক ইসলামি যুব সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সাহায্য প্রার্থনা এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত সাতবার সৌদি বাদশাহর সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিয়ে হস্তক্ষেপ করার ও আর্থিক সাহায্য না দেওয়ার অনুরোধ করেন গোলাম আযম।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জারি হওয়া সামরিক শাসনের সুযোগ নিয়ে দেশে ফেরেন কুখ্যাত অপরাধী। ১৯৭২ সালে তাকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিলেও তিনি আসেননি। পরে ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল গোলাম আযমসহ ৩৮ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করে সরকার। পরে ১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই জিয়াউর রহমানের শাসনামলে অসুস্থ মাকে দেখতে আসার কথা বলে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসেন এই জামায়াত নেতা। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও বাংলাদেশ ছাড়েননি তিনি। বরং জামায়াতের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে থাকেন তিনি।

১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করে জামায়াত। এরপর সারা দেশে বিক্ষোভ শুরু হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে পরের বছর ১৯ জানুয়ারি গঠিত হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ১১ ফেব্রুয়ারি সমমনা ৭০টি দল ও সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি। এর আহ্বায়ক হন জাহানারা ইমাম।

পরের বছরের ২৬ মার্চ সমন্বয় কমিটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালত বসিয়ে গোলাম আযমের যুদ্ধাপরাধের প্রতীকী বিচার করে। গণআদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১০টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়। ১২ সদস্যের গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম ১০টি অপরাধ মৃত্যুদ-যোগ্য ঘোষণা করে রায় দেন এবং ওই রায় কার্যকর করতে সরকারের প্রতি দাবি জানান। এই সময়ের সৌজন্যে

লেখক : সাংবাদিক