logo ৩০ এপ্রিল ২০২৫
সনদ জালিয়াতিই নয় দুর্নীতিও পদে পদে
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
২০ অক্টোবর, ২০১৪ ১১:২১:৩৩
image


১৯৯৫ সালের কথা। তখন তিনি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। স্থানীয় গোপালপুর আদর্শ গ্রাম প্রকল্পের কাজে ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। পরে অবশ্য তদন্ত কমিটি অর্থ আত্মসাৎ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করতে পারেনি। তবে তৎকালীন সংস্থাপন (বর্তমান জনপ্রশাসন) মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে তাকে সতর্ক করা হয়, যা তার সার্ভিস বইয়ে (পিডিএস) লেখা আছে। এই তিনি এখন স্বাস্থ্যসচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন মিঞা।

ওখানে থেমে থাকেনি প্রশাসনের দাপুটে এই কর্মকর্তার অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই গড়ে তুলেছেন দুর্নীতির বলয়। অভিযোগও আছে অন্তহীন। গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ১০টি পদে শতাধিক লোক নিয়োগে ব্যাপক বাণিজ্যের তকমা লেগেছে এই সচিবের গায়ে। কমিটিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেই চূড়ান্ত করেছিলেন ১১৩ জনের নিয়োগ। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দুটি আলাদা তদন্ত কমিটি করে দেয়। তদন্তে মিলে অভিযোগের সত্যতা। পরে বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে, নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে পুরোপুরি তদন্ত করার অনুরোধ করে পূর্ত মন্ত্রণালয়। এরপর দুই বছরেরও বেশি সময় পার হয়েছে। কিন্তু আজও নিয়াজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত আলোর মুখ দেখেনি। পূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে দুই দফা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছে না।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও সরকারি কর্মকমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান সা’দত হুসাইনের মতে, একের পর এক অনিয়ম, দুর্নীতি করে কেউ পার পেয়ে গেলে তার মধ্যে বেপরোয়া ভাব চলে আসে। একসময় দুর্নীতিবাজ ওই কর্মকর্তারা নিজেদের এমন উচ্চতায় কল্পনা করেন, যেখান থেকে তাকে নামানো কঠিন। মনে করেন, কেউ তাকে কিছু করতে পারবেন না।

সাবেক এই আমলার কথাই যেন সত্যি হয়েছে নিয়াজ উদ্দিন মিঞার বেলায়। একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর কিছুতেই দমে যাননি তিনি। বরং যেখানেই গেছেন, সেখানেই বিতর্কের বোঝা চেপেছে তার ঘাড়ে। ছিলেন পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (ডিজি)। সেখান থেকেও কি স্বচ্ছ ভাবমূর্তি নিয়ে ফিরতে পেরেছিলেন নিয়াজ উদ্দিন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুব দেরি হয়নি। পরিবার পরিকল্পনার অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘নিয়োগ, পদোন্নতি ও টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতা ও বাণিজ্যের কারণে এই অধিদপ্তরে একসময় নিয়াজ উদ্দিন মিয়ার নামও কেউ শুনতে পারতেন না। পত্র-পত্রিকাতেও এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। সবচেয়ে বড় অনিয়ম হয়েছে মাঠকর্মী নিয়োগে। অধিদপ্তর থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দুর্নীতি এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে, স্থবির হয়ে পড়েছিল পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম।’

এত অভিযোগ কাঁধে নিয়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে তার সচিব পদ পাওয়া রীতিমতো বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিল প্রশাসনে। তবে মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ নিয়ে লেজেগুবরে অবস্থায় পড়েছেন স্বাস্থ্যসচিব। চাকরির মেয়াদ বাড়তে তিনি এই ভুয়া সনদ নেন বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে উঠে এসেছে। সনদ বাতিল করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এই কাজ করায় কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিয়াজ উদ্দিনসহ চারজনকে কারণ দর্শাতে বলেছে।

কিন্তু এখনো বহাল আছেন স্বপদে। এমনকি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে নিউ ইয়র্ক থেকে ঘুরে এসেছেন তিনি, যা রীতিমতো বিস্ময় ছড়িয়েছে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জালিয়াতি প্রমাণের পরও অভিযুক্ত সচিবরা কীভাবে পদে বহাল আছেন, তা বিস্ময়ের।’ জনপ্রশাসন চাইলে কি এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারত না? ‘

স্বাস্থ্যসচিব নিয়াজ উদ্দিন মিঞার মতো আরও দুই সচিব ও একজন যুগ্ম সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ায় জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে দুদক। ভুয়া সনদ বাতিল করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়েছে এই সচিবদের। স্থগিত রাখা হয়েছে এক সচিবের সনদ। এরা সবই চাকরির বয়স বাড়ানোর জন্য ‘ভুয়া’ মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছিলেন।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন মিঞা জানান, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নোটিশের জবাব তৈরির কাজ চলছে। নির্ধারিত সময়েই জমা দেওয়া হবে। কোনো ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।  

রক্ষক থেকে ভক্ষকের ভূমিকায় নেমেছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাবেক সচিব (ওএসডি) কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী। দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে তিনি জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সনদ। অথচ চাকরির শুরুতে কোথাও এই কর্মকর্তা উল্লেখ করেননি যে, তিনি সচিব ছিলেন। এই অপরাধে তাকে ওএসডি করা হয়েছে।

সনদ জালিয়াতির তালিকায় আছেন সরকারি কর্মকমিশনের সচিব এ কে এম আমির হোসেনও। অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে দুদকের তদন্তে। সুপারিশ হয়েছে ব্যবস্থা নেওয়ার। কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছে না আমির হোসেনের। এর মধ্যে অবশ্য  মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবুল কাসেম তালুকদারকে অভিযোগ ওঠার পর ওএসডি করা হয়েছে। তবে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, সপ্তাহে দু-চার দিন মন্ত্রণালয়ে আসেন তিনি। কিছুক্ষণ লাইব্রেরি, এর দপ্তর, ওর দপ্তর ঘুরে বাসায় চলে যান। প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় বেসরকারিকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের সনদটি স্থগিত রেখেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

দুদকের অনুসন্ধানে জালিয়াতি ধরা পড়ার পরও প্রশাসনের উঁচু পদের এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। নির্লিপ্ত আচরণ করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। প্রশাসনের সাবেক ও বর্তমান একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই সময়কে বলেন, সনদ জালিয়াতির অভিযোগ ওঠার পরই এসব কর্মকর্তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া দরকার ছিল। কারণ ক্ষমতায় থাকলে তদন্তকাজে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ থাকে। কিন্তু অভিযুক্ত সচিবদের বেলায় ঘটেছে ভিন্নতা। অভিযোগ প্রমাণের পরও আছেন স্বপদে। এতে প্রশ্ন উঠছে, প্রশাসনের কঠোরতা ও স্বচ্ছতা নিয়েও।

একই সুরে কথা বললেন সাবেক আমলা সা’দাত হুসাইন। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সনদ জালিয়াতি গুরুতর অপরাধ। তারা এই সনদ দিয়ে সুবিধা গ্রহণ করুক আর নাই করুক। দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণের পর এ ব্যাপারে সরকার চাইলে জালিয়াতির দায়ে মামলা করতে পারত। অথচ এখনো তারা যেভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তা অনাকাক্সিক্ষত ও রহস্যাবৃত্ত। এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে সরকারই ভালো বলতে পারবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব বলেন, ‘দোষ প্রমাণের পর দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্লিপ্ততার দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ভবিষ্যতে এটি উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করানো হলে প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তাছাড়া অধীনস্থরাও ঊর্ধ্বতনদের ওপর সম্মান হারাবেন। এই সংস্কৃতি কখনোই সুশাসনের জন্য সহায়ক হতে পারে না।’  

জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী বলেন, ‘কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না, কথাটি ঠিক নয়। যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এনিয়ে তাড়াহুড়োর কিছু নেই।’ তিনি বলেন, ‘১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের জবাব চাওয়া হয়েছে। জবাব পাওয়া গেলে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।’

নিয়াজ উদ্দিনের যত দূরাচার

বর্তমান সরকারের গত মেয়াদে স্বাস্থ্য খাতে একটি চক্র গড়ে উঠেছিল স্বাস্থ্যসচিবের ছত্রচ্ছায়ায়। চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, পদোন্নতি, পদায়ন, বদলি, মেডিকেল কলেজ অনুমোদন, ঠিকাদারি, মেডিকেল সরঞ্জাম সরবরাহ, সবই ছিল এই চক্রের নিয়ন্ত্রণে। কোটি কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ে। যারাই এই চক্রের বাইরে যেত তাদের শাস্তি হিসেবে বদলিসহ পদোন্নতি ঠেকিয়ে রাখার ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে।

মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে ১২টি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়। নিয়মের বাইরে গিয়ে একাডেমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে চারটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজকে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রতিটি মেডিকেল কলেজ অনুমোদনে দুই থেকে পাঁচ কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন কমিটির সভায় প্রস্তাব না তুলেই ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে এই চারটি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দিতে। কলেজগুলো হচ্ছে- রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কেয়ার মেডিকেল কলেজ, গুলশানের ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ, নারায়ণগঞ্জের ইউএস-বাংলা ও রাজশাহীর শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজ। মেডিকেল কলেজগুলো অনুমোদনে মন্ত্রীসহ ১২ সদস্যের কমিটির আটজনই সই করেননি। অনিয়মের অভিযোগ আছে মহাখালীর ইউনিভার্সাল, চট্টগ্রামের মেরিন সিটি, সিলেটের পার্ক ভিউ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল, খুলনার সিটি ও আদ-দ্বীন-আকিজ মেডিকেল কলেজ অনুমোদনের ক্ষেত্রেও।

নিয়ম না মেনে গড়ে তোলা এসব বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন বাতিলের ব্যাপারে সরব হয়েছিল চিকিৎসক সমাজ। সরকারকে চিঠি দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বাতিলের দাবি জানায় চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। এর পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে ১২টি মেডিকেল কলেজের কাজ স্থগিত করে বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে দেখার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসচিব বলেন, ‘আমি এ ধরনের অভিযোগের বিষয়ে কিছুই জানি না। যারা অভিযোগ তুলেছেন তারাই বলতে পারবেন। তবে আমি কেবল বলব, কোনো অনিয়ম আমার হাত দিয়ে হয়নি।’

নিয়োগ বাণিজ্য

মহাজোট সরকারের গত মেয়াদে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে ৯টি জেলায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ চরম অনিয়ম হয়েছে। পরীক্ষা নিতে খরচ হয়েছিল প্রায় দুটি কোটি টাকা। অথচ পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন না করেই চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা জনপ্রতি ঘুষের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম উল্লেখ করে ভুক্তভোগীরা হাইকোর্টে রিট করলে নিয়োগ স্থগিত হয়ে যায়। এই নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী এবং বর্তমান সচিব জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ আছে।

দুর্নীতিচক্রের অন্য সদস্যদের মনগড়া অতিরিক্ত দায়িত্ব ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার অভিযোগও আছে বর্তমান সচিবের বিরুদ্ধে। নির্বাচনকালীন সরকারের সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা রওশন এরশাদকে অন্ধকারে রেখে স্বাস্থ্যসচিব দুটি আদেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ১৭ কর্মকর্তাকে বদলি ও পদোন্নতি দেন। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর এক আদেশে ১৩ কর্মকর্তাকে পদায়ন ও পদোন্নতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া একই মাসের ৩০ তারিখ আরো ১২ কর্মকর্তাকে বদলি ও পদায়ন করা হয়। এসব পদায়ন, বদলি ও পদোন্নতিতে বাণিজ্য করার অভিযোগ করেছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাই।

স্বাস্থ্যসচিব নিয়াজ উদ্দিন অবশ্য এ বিষয়ে তার কোনো দায় স্বীকার করতে চান না। তিনি বলেন, ‘যা করার করেছে নিয়োগ কর্তৃপক্ষ। আমি তো আর সে কর্তৃপক্ষ ছিলাম না। তা হলে আমার ওপর কেন দায় আসবে?’

তদবির অফিস

টাকা বিনিময়ে কাজ হাসিলকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রেওয়াজে পরিণত করেছেন স্বাস্থ্যসচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন। এ জন্য আলাদা অফিস খুলে তদবির বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন এই কর্মকর্তা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা এই সময়য়ের কাছে এ নিয়ে রীতিমতো ক্ষোভ ঢালেন। তারা জানান, গাজীপুরবাসীর স্বাস্থ্যসেবার জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় অফিস খোলা হয়েছে। অথচ সেখানে কোনো রোগী দেখা হয় না। স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন অধিদপ্তর ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখানে তদবিরের জন্য ভিড় করেন। এ অফিস থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ-বাণিজ্য সম্পন্ন হয়। সচিব ছুটির দিনে ওই অফিসে বসেন। তার সহকারী ডা. মনিরের মাধ্যমে সব অবৈধ লেনদেন হয় বলে অভিযোগ আছে।

এ ছাড়া হাসপাতালে সরঞ্জাম কেনাতেও গোপন বাণিজ্য করছে সচিবের নেতৃত্বাধীন চক্র। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, হাসপাতালের চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটার জন্য অন্য কোডের অর্থ বরাদ্দ পেতে স্বাস্থ্যসচিবের ডিও নিয়ে চলছে লাগামহীন বাণিজ্য।

তবে এসব অভিযোগও অপপ্রচার বলে দাবি করেছেন নিয়াজ উদ্দিন। তার অভিযোগ, একটি মহল অবৈধ সুবিধা না পেয়েই তার বিরুদ্ধে দুর্নাম ছড়াচ্ছে।

মাসুদ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে আরো যত অভিযোগ

মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধুদের দেওয়া সম্মাননা স্মারকে স্বর্ণ জালিয়াতির জন্য মুক্তিযোদ্ধা সচিব (ওএসডি) কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকীকে দায়ী করেছে তদন্ত কমিটি। কমিটি বলছে, তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবহেলা করেছেন। সচিব কোনো প্রশ্ন বা যাচাই-বাছাই ছাড়াই সাবেক প্রতিমন্ত্রীর কাছে নথি পাঠিয়েছিলেন। প্রতিমন্ত্রী নথি পেয়েই তা অনুমোদন করেছেন। শুধু তাই নয়, মাসুদ সিদ্দিকী শাখা পর্যায় থেকে উপস্থাপিত নথিতে স্বর্ণের ক্যারেট উল্লেখ না করার দায়ভার অধীন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর চাপিয়েছেন। অথচ ক্রেস্ট সরবরাহকারী পেয়েছে সর্বোচ্চ দর।

সরকার স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট নাগরিক ও সংগঠনকে সম্মান জানায়। সম্মাননা স্মারক হিসেবে ক্রেস্ট দেওয়া হয় তাদের। প্রতিটি ক্রেস্টে এক ভরি স্বর্ণ ও ৩০ ভরি রুপা থাকার কথা ছিল। কিন্তু সম্মাননা দেওয়ার সময় বিএসটিআইয়ে একটি ক্রেস্ট পরীক্ষা করায় মন্ত্রণালয়।  তাতে দেখা যায়, ক্রেস্টটিতে এক ভরির জায়গায় সোয়া তিন আনা স্বর্ণ এবং রুপার বদলে ৩০ ভরি পিতল, তামা ও দস্তা দেওয়া হয়েছে।

দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের অনুদানের টাকাও ছয়নয় করেছেন মাসুদ সিদ্দিকী। নিয়ম ভেঙে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়- এমন প্রতিষ্ঠানকে টাকা দিয়েছেন। নিজের বাবার কলেজেও মুক্তিযোদ্ধাদের টাকা অনুদান দিয়েছেন। পরে অবশ্য নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় মাসুদ সিদ্দিকীর বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত মাওলানা মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী কলেজকে দেওয়া মোট ২০ লাখ ফেরত দিতে হয়েছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে একাধিকবার চেষ্টা করেও মাসুদ সিদ্দিকীর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এখন ওএসডি হওয়ায় তার কোনো দপ্তর নেই আর ব্যক্তিগত মুঠোফোনটি বন্ধ করে রেখেছেন তিনি।

স্থগিত মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের সনদ, বিতর্ক ছিল আগেও

দুদক বলেছিল, মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও গেজেট নেওয়ার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম করেছেন বেসরকারীকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান। পুরো প্রক্রিয়াটি হয়েছে আইনের বাইরে গিয়ে। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সুপারিশ ও যাচাই-বাছাই ছাড়াই এই সচিব সনদ নিয়েছেন। এজন্য সনদ ও গেজেট বাতিলের সুপারিশ করেছিল দুদক। কিন্তু মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের গেজেট ও সনদ বাতিল না করে আপাতত ‘স্থগিত’ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে তার শুনানি শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুদকের সুপারিশের পরও কেন তার সনদ বাতিল করা হলো না- এ নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন আছে খোদ প্রশাসনের মধ্যেই।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক এই সচিবের বিরুদ্ধে অতীতেও বিস্তর অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর এই তিনিই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে একটি প্রজ্ঞাপন পাঠিয়ে ছিলেন। যেখানে জানিয়েছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানোর আদেশ জারি করার পর এ সুবিধা নেওয়ার জন্য অনেকেই নানা ব্যাখ্যার মাধ্যমে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে সনদ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাই যেকোনো একটি মানদ-ের ভিত্তিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মুক্তিযোদ্ধ গণকর্মচারী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান নিজেই কোনো মানদ- না মেনে নিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা সনদ। দুদক তদন্তে এর প্রমাণও পেয়েছে।

এর আগেও খাদ্যসচিব হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণে গিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন ওয়াহিদুজ্জামান। প্রশিক্ষণে অংশ না নিয়ে মাসাধিককাল যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে দেশে ফেরার পর তাকে চিঠি লিখেছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি। চিঠিতে মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের দিকে আঙুল তুলে বলা হয়েছিল, এ ধরনের কর্মকর্তার জন্য বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না। পরে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছ থেকে নেওয়া পাঁচ লাখ টাকা ফেরত দিতেও বাধ্য করা হয়।

তবে এসব বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি নন মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান। অভিযোগ ওঠার পর থেকে গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলছেন তিনি।  

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘জালিয়াতি প্রমাণের পরও এসব দুষ্কৃতিকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধা কোথায়, তা সরকারই ভালো বলতে পারবে। এভাবে তো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। তাছাড়া দুর্নীতি প্রমাণের পর দুদকও এদের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ মামলা করতে পারত। কিন্তু সেটাও হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘জাল টাকা ও জাল শিক্ষাগত সনদ ধরা পড়লে যদি শাস্তি হয় তাহলে জাল মুক্তিযোদ্ধা সনদ ধরা পড়ার পর কেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে না?’ -এই সময়ের সৌজন্যে