logo ৩০ এপ্রিল ২০২৫
যুক্তিহীন উক্তি
১৫ অক্টোবর, ২০১৪ ১২:৪৬:৪৯
image


গোলাম রাব্বীঃ সম্প্রতি কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তি কয়েকটি মন্তব্য করে সবার মুখে আলোচনা-সমালোচনার এক অন্যতম বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছেন। তবে বেশিরভাগ লোকই তাদের নিজ নিজ বক্তব্যে সবার মাঝে কেবল সমালোচনার পাত্রই হননি; প্রত্যেকের বিচার ও  শাস্তি দাবির কথাও উঠে আসছে বেশ জোরেশোরে। বর্তমানে যে নামটি বেশ ঘৃণাভরে উঠে আসছে, তিনি হলেন বর্তমান সরকারের সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। তিনি সর্বশেষ ৬৯তম জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে নিউইয়র্কে যান। সেখানে ২৭ সেপ্টেম্বর বাঙালি কমিউনিটির এক সভায় অংশ নিয়ে তিনি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.), পবিত্র হজ, তাবলীগ-জামাত ও প্রধানমন্ত্রী-পুত্র জয়কে নিয়ে মনগড়া মন্তব্য করেন।

এবার এক এক করে আলোচনা শুরু করা যাক। প্রথমেই আসি সম্প্রতি লতিফ সিদ্দিকীর করা মন্তব্যে। তিনি ওই দিন নিউইয়র্কের সভায় তাবলীগ নিয়ে বলেন, ‘এই তাবলীগারদের কোনো কাজ নেই। প্রতিবছর তারা লাখ লাখ লোক জমায়েত করে। তাদের কারণে শুধু ঢাকাই নয়, সারা দেশে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়।’ এখানেই থামেননি আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। এরপর আরো যোগ করে বলেন, ‘আমি মূলত যত না জামায়াতের নেতাকর্মীদের বা দলকে ঘৃণা করি, এরচেয়েও বেশি ঘৃণা করি তাবলীগ-জামাতকে।’ একই বক্তব্যে পবিত্র হজ নিয়ে বাজেভাবে মন্তব্য করেন। বলেন, ‘এটা আবার কিসের ধর্মকে অনুসরণ। লাখ লাখ লোক এদেশ থেকে বহু টাকা খরচ করে মাসখানেক ওখানে থেকে দেশের টাকা নষ্ট করার ফন্দি ছাড়া আর কিছু নয়। এর দ্বারা কি আমাদের দেশের টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে না।’ মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় এ কাজকে নিয়ে তিনি বলেন, ‘এদের কোনো প্রোডাকশন নেই, তারা সবসময় ডিডাকশন করেই দেশের উন্নয়ন নয় অনুন্নয়নেই ভূমিকা রাখে।’ তিনি  কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন মুসলমানদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে নিয়েও। শুধু ধর্ম নিয়ে বক্তব্য দিয়েই তিনি যে ক্ষান্ত হয়েছেন তা কিন্তু নয়। তিনি বক্তব্য দিয়েছেন তার দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী-পুত্র ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়েও। এক সাংবাদিকের করা প্রশ্নের জবাবে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, ‘আপনারা কিছু হলেই জয় জয় করেন’, ‘জয় কে?, জয় কি আওয়ামী লীগের কেউ’, কিছু হলেই আপনারা জয় ভাইকে খোঁজেন, আমি আওয়ামী লীগে কোনো জয়কে চিনি না।’ তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন তার সারমর্ম মূলত এ রকমই।

বাংলাদেশ থেকে বহু দূরে নিউইয়র্কের ওই অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিলেও মোবাইলে ধারণ করা ভিডিও দ্রুতই চলে আসে গণমাধ্যমকর্মীদের হাতে। আর প্রতিটি গণমাধ্যমেই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে সম্প্রচার ও প্রকাশ করা হয়। এর পরপরই তার মন্তব্য নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে দেশে ও বিদেশে । অবশ্য এমন বক্তব্য দিয়ে থাকলে ৯৮ ভাগ মুসলমান অধ্যুষিত দেশে বিদ্রƒপের পাত্র হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর দলের কর্ণধারের পুত্রকে নিয়ে করা মন্তব্যের কারণে দলেও হাস্যরসের বস্তুতে পরিণত হয়েছেন। আর হবেনই বা না কেন, যেখানে মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সহযোগিতা করে পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় দেশবাসীর মন জয় করে ফেলেছেন অথচ তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে কাজ করা মন্ত্রীই জয়কে চিনবেন না, তা কি করে হয়? অবাক করার মতো এই বক্তব্য শুনে অবশ্য সভায় উপস্থিত আওয়ামী লীগ কর্মীরাই হতচকিত ও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। অনেকে ওখানেই প্রতিবাদ জানিয়ে তার বিরুদ্ধে স্লোগান ও সভাস্থল ত্যাগ করে বিচারও দাবি করেন।

উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোও। তার মন্ত্রিত্ব কেড়ে নেওয়াসহ ফাঁসির দাবি করে বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। তার কুশপুত্তলিকা পোড়ানোসহ বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, নোয়াখালী, কুমিল্লা, কক্সবাজার, বান্দরবান, পটুয়াখালী, ময়মনসিংহ, জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও থানা শহরে।

এর কয়েকদিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে সমালোচিত হন শিক্ষামন্ত্রী। শিক্ষামন্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৪-১৫ সেশনের খ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের পর মন্তব্য করেনÑ ‘যেখানে প্রায় ৯৩ ভাগই ফেল করে অর্থাৎ মাত্র ৭ ভাগ পাস করে সেটা কোনো পরীক্ষা হলো।’ শিক্ষামন্ত্রী রাগান্বিত হয়ে বলেনÑ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।’

শিক্ষামন্ত্রী আরো বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাছাই প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ।’ এছাড়াও তিনি প্রশ্ন ছোঁড়েন, ‘আমাদের জিপিএ-৫ প্রাপ্ত লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ২ জন কি ইংরেজি বিভাগের ভর্তি হওয়ার জন্য যোগ্য?’ এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাকে তিনি শিক্ষার্থীদের সর্বনাশ করার নামান্তর বলে অ্যাখ্যা দেন।’ বলেন, ‘এটা কোনো পরীক্ষাই নয়।’ মন্ত্রীর মতে, ‘এক শ্রেণির শিক্ষক নাকি শিক্ষার্থীদের ফেল করার জন্যই কঠিন প্রশ্ন করেছেন?’ তাই তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘এমন ব্যবস্থার পরিবর্তন না করলে প্রয়োজনে আমরা আইন পরিবর্তন করব।’ ‘বাংলাদেশে ৩২ হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য হয় তা আমি জানি আর আপনারা শিক্ষার্থীদের কোন কোচিং-এ ভর্তি হলে প্রশ্ন পাওয়া যাবে তাও জানান।’ শিক্ষার্থীদের তিনি বলেন, ‘তোমরাই বলো তোমরা কি ১২ বছরে পাস করার মতো কিছুই শেখনি? এরপরই অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক ভাইস চ্যান্সেলর আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এটিএন নিউজে সরাসরি টক শোতেই মন্ত্রী নাহিদের উপস্থিতিতেই তার বক্তব্যের কড়া জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা মন্ত্রীকে জানাতে চাই, এখানে পাস-ফেলের কোনো ব্যাপার নয়।’ ‘সবাই পাস করলেও তো আমরা সবাইকে ভর্তি করাতে পারব না।’ আর মন্ত্রী যে বললেনÑ ‘এ প্লাস-এর কি কোনো দাম নেই, তারা কি মেধাবী নয়? হ্যাঁ, দাম আছে। আর তাই তো ‘ঢাবির ভর্তি প্রক্রিয়ায় এসএসসি-এইচএসসির ফলাফল অনুযায়ী ৮০ নম্বর পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া আছে।’

আমারও ঠিক একই কথা- মন্ত্রী কি জানেন না যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ফলাফলের ভিত্তিতে ৮০ নম্বর দেওয়া হয়? তিনি কেন রাজনৈতিকভাবে সফল হওয়ার জন্য পাস করানো শিক্ষার্থীদের চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঘাড়ে? তিনি কি জানেন না যে, দেশে এখন পিএসসির শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন ফটোকপির দোকানে বিক্রি করা হয়? তার কাছে কি জানা নেই, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জেএসসি, এসএসসি আর এইচএসসির প্রশ্ন পরীক্ষার আগেই হাতে ছিল পরীক্ষার্থীদের। অথচ শতবর্ষ পূরণ করতে যাওয়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো পর্যন্ত প্রশ্ন আউট হওয়ার নজির নেই আর যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অন্তত ভর্তি পরীক্ষাকে সম্মানের চোখে দেখেন, কোনো কোচিং-এর কথা পর্যন্ত বলেন না, তাদের কি এমন দোষ দেওয়া সাজে? এমনকি একবার শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রশ্ন আউটের খবর বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওই পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছিল? তাহলে শিক্ষামন্ত্রীর এমন রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের বক্তব্যের মানে রইল কই?

এর আগে সিলেটের এক আলোচনা সভায় ‘সাংবাদিকদের খবিশ ও চরিত্রহীন’ বলে বক্তব্য রেখে সমালোচিত হন সমাজকল্যাণমন্ত্রী মহসীন আলী। এর কয়েকদিন পরই তার মেয়ের বিয়েতে বিশাল এক আয়োজন করে সেখানে হাজার হাজার লোককে দাওয়াত করে খাওয়ালেও শেষ পর্যন্ত তার অভিযোগের তীর সাংবাদিকদের বাড়িতে এনেও তাদের আহারের ব্যবস্থা না করেও সমালোচিত হন তিনি। আর এভাবেই যুক্তিহীন উক্তি করে তারা আমাদের সমাজে বড় বড় পদের অধীনে দিনের পর দিন অধিষ্ঠিত হয়ে থাকেন বহাল তবিয়তে। আর কেনই বা তারা থামবেন। যেখানে একের পর এক মন্ত্রী আর দলের লোকেরা এমন মন্তব্য করছেন তারপরও তাদের সাফাই গাইতে দেখা যায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকেই। কেননা ‘লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রী ও দল থেকে বহিষ্কার করা হবে’ এমন কথা যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে এসে প্রধানমন্ত্রী বললেও; সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন তাহলে কয়েকদিন আগে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যে বিষোদগার করেছিলেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী তার বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন কি না? তখন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘তিনি কোন অবস্থায় আর কেন এ কথা বলেছেন তা জেনে দেখুন।’ অর্থাৎ মহসীন আলীর কিছু হচ্ছে না এটা ধরে নেওয়া যায়। আর যেখানে দুর্নীতির দায়ে কোনো কোনো মন্ত্রীর দোষে পদ্মাসেতুর মতো জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও  জনগণের প্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা না করেই সে সময়ের যোগাযোগমন্ত্রীকে ‘সৎ’ এবং ‘দেশপ্রেমিক’ লোকের সার্টিফিকেট দিয়ে সংসদে বক্তব্য রাখা হয় সেদেশে এমন যুক্তিহীন উক্তি মাঝেমধ্যেই হওয়াটাই স্বাভাবিক নয় কি?



লেখক : সংবাদ উপস্থাপক ও নিউজরুম এডিটর, সময় টেলিভিশন



[email protected]