ঢাকা: প্রথমে রোজার ঈদের পর, পরে কোরবানির ঈদের পর সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কিন্তু আগের ঘোষণার কারণেই কি না খালেদা জিয়ার এই ঘোষণা তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না বিএনপির নেতা-কর্মীদের কাছে। তাছাড়া আন্দোলন করতে হলে যে প্রস্তুতিগুলো থাকতে হয় তারও কিছুই হয়নি এখনো।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় দেখা গেছে কোনো রাজনৈতিক দল কোনো আন্দোলনে গেলে তার আগে বিভিন্ন সংগঠন নানা দাবিতে মাঠে নামে। সরকারকে সম্ভব সব দিক থেকে চাপ তৈরির কৌশল হিসেবেই এটা করা হয় বলে জানিয়েছেন নেতারা। এবার তারও কোনো নমুনা নেই। ফলে বিএনপি বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে সেটা বিশ্বাস করছেন না দলের কোনো পর্যায়ের নেতা-কর্মী। বরং দলের কর্মকা- নিয়ে হতাশা ছড়াচ্ছে কর্মীদের মধ্যে।
বিএনপি বর্জন করলে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ করতে পারবে না আর করলেও ১৯৯৬ সালে বিএনপি যেমন ১৩ দিন টিকেছিল তেমন পরিণতিই হবেÑএমন বিশ্বাস ছিল নেতা-কর্মীদের মধ্যে। কিন্তু নির্বাচনের পর সরকার এখন বেশ শক্তিশালী অবস্থানে আছে বলেই ধারণা তাদের। ৫ জানুয়ারির পর সবার অংশগ্রহণে নতুন নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর নানা বক্তব্যও থেমে গেছে আগেই। এর মধ্যে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, নতুন নির্বাচন হবে কি না এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। দেশের রাজনৈতিক দল এবং জনগণই ঠিক করবে তারা কি করবে। মজিনার এই বক্তব্য আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব পরিবর্তনের আভাস বলেই মনে করছেন বিএনপি নেতারা। এই বক্তব্যে আরও বেশি হতাশা ছড়িয়েছে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে।
নতুন নির্বাচন দেওয়ার বিষয়ে বিএনপির দাবি নানা সময় উড়িয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছেন, মধ্যবর্তী নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা নেই বাংলাদেশে। দেশে ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ঈদের আগে জামালপুরে এক সমাবেশে সরকারকে পদত্যাগ করে নির্বাচন দিতে ও বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসতে খালেদা জিয়ার আহ্বানের প্রেক্ষিতে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
জোরালো আন্দোলনের চিন্তা নেই
বিএনপির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে, আন্দোলনের ঘোষণা থাকলেও রাজপথ অচল করে দেওয়ার মতো কোনো কর্মসূচি এখনই দেবে না দলটি। সভা-সমাবেশের মতো কর্মসূচিই দেবে তারা। এসব সভা-সমাবেশে যথা সম্ভব লোক জড়ো করে তাদের দাবির প্রতি মানুষের সমর্থনের বিষয়টি তুলে ধরতে চায় বিএনপি।
ধর্ম নিয়ে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর সাম্প্রতিক একটি বক্তব্যকে পুঁজি করতে চায় বিএনপি। তারা মনে করে, ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করা তুলনামূলক সহজ হবে। তবে লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা ও দল থেকে বহিষ্কারের পর এই কৌশল কতটা কাজে দেবে তা নিয়ে নেতাদের মধ্যে সংশয়ও আছে। কারণ এর আগে বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে বিরূপ মন্তব্যের কারণে যে ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, লতিফ সিদ্দিকীর মন্তব্যের পর তেমনটি হয়নি। তাছাড়া বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ কর্মীরাও লতিফ সিদ্দিকীর শাস্তি চেয়ে প্রকাশ্যে কর্মসূচি পালনের পর এই ইস্যু কাজে লাগানো নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে বিএনপির মধ্যে। তাই বলে চেষ্টা থামিয়ে রাখবে না তারা। লতিফ সিদ্দিকীকে অপসারণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিজ মুখে বক্তব্যের পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, একজন মন্ত্রীর বক্তব্যের দায় পুরো মন্ত্রিসভাকেই নিতে হবে। সূত্র জানায়, এ বিষয়ে বিএনপি এই কৌশলেই এগুবে যে, লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্য কেবল একজন ব্যক্তির নয়, সরকারের অংশ হিসেবে বলা কথার জন্য সরকারকেই মাসুল গুনতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট সরকারবিরোধী আন্দোলনের মধ্যেই রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে কোরবানির ঈদের পর মূলত বিএনপি ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের দিকে অগ্রসর হবে। আলোচনার মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা ঈদের পর নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না দিলে বিএনপি জনগণের ভোটাধিকার ও ভূমিহীনদের জমি ফেরতসহ দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কোরবানি ঈদের পর পরই আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করবে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান বলেন, কোরবানির ঈদের পর বিএনপি মূলত নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার, জনগণের ভোটাধিকার ফেরত, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য কর্মসূচি ঘোষণা করে রাজপথে নামবে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে সরকার নতি স্বীকার না হলে বিএনপি হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচি ঘোষণা করবে।
সংশয় তৃণমূলেও
কেন্দ্র থেকে কোরবানির ঈদের পর জোরালো আন্দোলনের কথা বলা হলেও তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে খোদ দলটির তৃণমূলের নেতারা। গত রোজার ঈদের আগে বিভিন্ন ইফতার পার্টিতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ঈদের পর সরকারবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু রোজার ঈদের পর কোনো আন্দোলন ঘোষণা না করায় বিএনপির শীর্ষস্থানীয় থেকে তৃণমূলের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৃণমূলের এক নেতা বলেন, ‘বিএনপি মুখে শুধু বড় বড় কথা বলতে পারে, প্রকৃতপক্ষে রাজপথের আন্দোলন করার মতো ক্ষমতা তাদের নেই। বিএনপি যতই আন্দোলনের কথা বলুক না কেন তারা রাজপথে আন্দোলন করতে পারবে না। আমরা গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, বুকের তাজা রক্ত ঢেলে সারা দেশে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম। কিন্তু কেন্দ্রের তথা ঢাকার নেতাদের সীমাহীন ব্যর্থতায় আমাদের সেই আন্দোলন কোনো কাজে আসেনি। তারা শুধু মিটিং করেন, রাজপথে নেমে আসেন না।
ব্যর্থ ঢাকা মহানগর কমিটি
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সহিংস কর্মসূচি পালন করলেও রাজধানীতে তেমন কিছুই করতে পারেনি বিএনপি। বাস-ট্রাক এবং হিউম্যান হলারে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনায় সরকারের পাল্টা আক্রমণের মুখে জবাব দিতে পারেনি তারা।
ভোটের পর এ কারণে ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেন খালেদা জিয়া। এ কমিটিকে এক মাসের মধ্যে ওয়ার্ড কমিটিগুলো পুনর্গঠনে সময় বেঁধে দেন বিএনপি চেয়ারপারসন। কিন্তু ওই সময়ে কাজ এতটুকুও আগাতে পারেনি আহ্বায়ক কমিটি। বরং এই কমিটির প্রধান মির্জা আব্বাস এবং সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের মধ্যে দ্বন্দ্বে ঢাকা মহানগর বিএনপির কোন্দলে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান বলেন, সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে বিএনপি ঢাকায় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এটা আমরা স্বীকারও করি। আর এই ভুল থেকেই শিক্ষা নিয়ে বিএনপি এবার ঢাকায় রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলবে।
বিএনপির যুববিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার কারণ ঢাকায় আমরা তেমন কিছুই করতে পারিনি। এই বিষয়টি মাথায় রেখে এবার বিএনপি আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবে।
আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের কৌশল
আন্দোলনের পাশাপাশি সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের জন্য এবার কৌশলী হচ্ছে বিএনপি। দলটির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধির জন্য তৎপরতা সমান্তরালে চলবে। ক্ষেত্রবিশেষে কখনো কখনো এই বিষয়টির ওপর আন্দোলনের চেয়েও জোর দেওয়া হবে। সরকারকে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে নতুন করে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এই জন্য বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজে কাজ করছেন বলেও জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘ক্ষমতাসীনদের গুলি ও নির্যাতনের মুখে বিএনপি আন্দোলন ও সংগ্রাম করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং বিএনপি বুঝতে পেরেছে আন্দোলন করে এই সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায় করা সম্ভব নয়। তাই বিএনপি সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের কৌশল অবলম্বন করতে চাচ্ছে। এতে তারেক রহমান নিজে কাজ করছেন। এই কারণেই বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল চীন সফরে গিয়েছিলেন এবং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সিঙ্গাপুর সফর করেছেন।’- এই সময়ের সৌজন্যে