logo ৩০ এপ্রিল ২০২৫
অভিযোগ হয় কমিটিও হয় কিন্তু বিচার হয় না
ভার্সিটিতে বেশি নম্বরের টোপ দিয়ে যৌন হয়রানি
মহিউদ্দিন মাহী
২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ১১:০৬:৩৯
image


পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ আবারও উঠল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ১৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সাইফুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্তও করেছে কর্তৃপক্ষ।

শিক্ষার্থীরা চায় কেবল সাময়িক বরখাস্ত নয়, অভিযুক্তকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দিতে হবে চিরদিনের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার। তবে এই আশ্বাস কতটা বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। কারণ এর আগেও নানা ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। সাময়িক বরখাস্ত করার পর আর নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থাই।

উপাচার্য বরাবর লেখা একটি আবেদনপত্রে ভুক্তভোগী ছাত্রী অভিযোগ করেন, ৮ সেপ্টেম্বর বিভাগীয় কার্যালয় থেকে ফোন করে তাকে চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে বলা হয়। তিনি চেয়ারম্যানকে ফোন করলে পরে কথা বলবেন বলে জানান। দুদিন পর চেয়ারম্যান তাকে ফোন করে গত ২৮ আগস্ট কোর্সের মিডটার্ম পরীক্ষায় নম্বরসংক্রান্ত জটিলতার কথা বলে নিজের বাসায় ডাকেন।

ওই ছাত্রী জানান, পুরো বিষয়টি তিনি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওয়াহিদা মল্লিককে জানান। ১৩ সেপ্টেম্বর চেয়ারম্যানের বাসায় যাওয়ার কথাও আগেই ওয়াহিদাকে মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা জানিয়ে রাখেন বলেও জানান তিনি।

ছাত্রী জানান, বাসায় যাওয়ার পর ওই শিক্ষক তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। বাসায় অবস্থানের কিছু সময় তার মোবাইল ফোনের রেকর্ডার চালু ছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি। আবেদনপত্রের সঙ্গে মুঠোফোনে ধারণ করা এসব তথ্য-প্রমাণও জমা দেন ওই ছাত্রী।

সাইফুল ইসলামের ঘটনাই প্রথম নয়। এর আগে অনেকেই যৌন হয়রানির অভিযোগে বরখাস্ত হয়েছেন। কিছুদিন পর আবার ফিরে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘আমরা যৌন হয়রানির বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। বিভিন্ন সময় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, শিক্ষকদের কাছ থেকে যৌন হয়রানির কোনো ঘটনা কাম্য নয়। কারণ শিক্ষকরা জাতির কারিগর। তারাই যদি অনৈতিক কাজে জড়িত হয় তাহলে সেটা কাম্য নয়। এটা শিক্ষক সমাজের কলঙ্ক।’

আখতারুজ্জামান বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনায় যদি অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনানুগ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা যায় তাহলে আর যৌন নিপীড়নমূলক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।’



আগের কিছু ঘটনা

২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক এ টি এম ফখরুদ্দীনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় ছুটিতে পাঠায়। তিনি বিয়ে করেছেন চারটি। তার ছাত্রীও আছেন এদের মধ্যে। চতুর্থ স্ত্রী ও এক সময়ের ছাত্রীর অভিযোগের কারণে এখন তিনি আছেন বাধ্যতামূলক ছুটিতে।

ছুটিতে গেলেও সময়মতো বেতন-ভাতা এবং শিক্ষকতার অন্য সুযোগ-সুবিধা সবই পাচ্ছেন ফখরুদ্দীন। দুই বছরেরও বেশি সময়েও তার বিরুদ্ধে কেন প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হলো নাÑ জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর এ এম আমজাদ বলেন, ‘আসলে একজন শিক্ষককে যখন বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয় তখন সে কিন্তু সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হয়। শিক্ষক সমাজেও সে নিগৃহীত হয়। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি একজন শিক্ষকের জন্য এটি কম শাস্তি নয়।’

ঢাকা এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক শিক্ষকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ওঠার পর ২০০৯ সালের জুনে এই অভিযোগ তদন্তে আলাদা কমিটি করে সরকার। তবে সব অভিযোগ যে সব সময় এই কমিটির কাছে যায়, তা নয়। আবার গেলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ একেবারেই বিরল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১০ বছরে কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ব্যবস্থা বলতে বিশ্ববিদ্যালয় একাধিক শিক্ষককে পাঠিয়েছে বাধ্যতামূলক ছুটিতে। কিন্তু পরে সব ভুলে যায় সবাই।

ব্যবস্থা না নেওয়ায় কয়েকজন ছাত্রী অভিমানে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়েছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক ছাত্রী বিভাগেরই এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে ভিসির কাছে যে অভিযোগ করেছেন তার এক জায়গায় লেখা আছে, ‘তিনি বইটি নিয়ে টেবিল ঘুরে এসে আমার হাতে দিলেন। আমি বইটি হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করেন।’

নানা ঘটনায় দেখা গেছে টিউটোরিয়াল, ইনকোর্স ও অ্যাসাইনমেন্টের নম্বরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ছাত্রীদের হয়রানির চেষ্টা করেন কোনো কোনো শিক্ষক। এরপর বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েও ছাত্রীদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কও স্থাপন করেন কেউ কেউ। এ রকম প্রতারণার শিকার হয়ে সম্প্রতি কুয়েত মৈত্রী হলের এক ছাত্রী আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।

এ কেমন ব্যবস্থা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক বাহালুলের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ এনেছেন বিভাগের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। প্রতিকারে কলা অনুষদের ডিন, বিভাগের চেয়্যারম্যান ও প্রক্টরকে চিঠিও দেন তারা। অভিযোগের পর ওই শিক্ষককে সব ধরনের কোর্স থেকে প্রত্যাহার করে বিভাগীয় প্রশাসন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদ হাসানের বিরুদ্ধেও যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। অভিযোগের পর ২০১২ সালের ৩০ জুন একাডেমিক কমিটি এ অধ্যাপকের জন্য বিভাগের ২০০৯-১০ ব্যাচের সব কোর্স গ্রহণ নিষিদ্ধ করেছে। একই বছরের ৭ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক নূরউদ্দিন আলোর বিরুদ্ধে যৌতুকের দাবিতে স্ত্রীকে মারধরের অভিযোগে মামলা করা হয়। ওই বছরই নৃবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন এক ছাত্রী।

২০০৯ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন মোল্লার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন এক ছাত্রী। এরপর ওই শিক্ষককে এক বছর একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ২০১০ সালে ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তখনকার চেয়ারম্যান অধ্যাপক আফজাল হোসেনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে।

২০১১ সালে উর্দু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইসরাফিলের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলেন এক শিক্ষার্থী। একই বছরের এপ্রিল মাসে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবু মুসা আরিফ বিল্লাহর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ ওঠার পর মুসা আরিফ বিল্লাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তার বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ওই বছরেরই জুন মাসে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক মুহিত আল রশিদের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন এক ছাত্রী। এরপর তাকেও একাডেমিক কার্যক্রম থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। একই বছরে পরিসংখ্যান বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রী লাঞ্ছনার অভিযোগ ওঠে। পরে ছাত্রীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য অভিযোগ সিন্ডিকেটে পাঠানো হয়। সিন্ডিকেট এখনও কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি।

২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এমরান হোসেনের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তোলেন। অভিযোগ ওঠার পর অন্যদের মতো এমরান হোসেনকেও বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়।

২০০৭ সালে মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক কামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন এক শিক্ষার্থী। ওই অভিযোগের পর অধ্যাপক কামাল উদ্দিনকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। এরপর ২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কামাল উদ্দিনের বাধ্যতামূলক ছুটি প্রত্যাহার করে নেয়।

অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তদন্ত ঝুলিয়ে রাখা বা কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘আমরা সাধারণ তদন্ত কমিটির সুপারিশের আলোকে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। তদন্তে এগুলো অধিকাংশই প্রমাণিত হয় না। যার কারণে অভিযুক্তরা পার পেয়ে যায়। তবে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যৌন নিপীড়নের ঘটনাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। তদন্তে প্রমাণিত হলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।’

উপাচার্য বলেন, ‘শিক্ষকদের নৈতিক স্খলন হলে তাদের সর্বোচ্চ চাকরিচ্যুত করতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়। সেটাই আমরা করছি। কেউ এসব বিষয়ে ফৌজদারি মামলা করলে সেটা পুলিশ এবং আদালত দেখবে।’



যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি অকার্যকর

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের ঘটনা তদন্তে ২০০৯ সালে যৌন নিপীড়নবিরোধী তদন্ত কমিটি গঠন করার নির্দেশনা দেন আদালত। এ অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাঁচ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের যৌন নিপীড়নবিরোধী তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য মাহবুবে আলমকে মনোনীত করা হয়।

কমিটির অন্য সদস্যরা হলেনÑ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এ এফ এম মেজবাহউদ্দীন, সৈয়দ রেজাউর রহমান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক তাজমেরী এস এ ইসলাম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সৈয়দ রেজাউর রহমান। তবে এই কমিটি এখন পর্যন্ত কার্যকর কিছু করতে পারেনি বলে মনে করেন কমিটির সদস্য অধ্যাপক তাজমেরী এস এ ইসলাম। এই সময়কে তিনি বলেন, ‘এই কমিটি আছে নামেই। এখনও কোনো কাজ করতে পারেনি কমিটি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আমজাদ আলী বলেন, ‘কয়েকজনের কারণে গোটা শিক্ষক সমাজই পড়েছে লজ্জায়। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ শুনতে খুব খারাপ লাগে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নেওয়া উচিত।’

শাস্তির বিষয়ে আমজাদ আলী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী সিন্ডিকেট কমিটিও একজন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করতে পারে না। এ জন্য সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাই এ ধরনের নৈতিক অবক্ষয় থেকে মুক্তি পেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে।’

(ঢাকাটাইমস/২৪সেপ্টেম্বর/এমএম/এআর/ঘ.)