ঢাকা:বলা নেই, কওয়া নেই, নেই কোনো বৈঠক, হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন চেয়ারম্যান, দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে বাদ দেবেন দলের নীতি নির্ধারণী ফোরাম থেকে। যা ভাবা সেই কাজ। তৈরি হলো প্রেস বিজ্ঞপ্তি, চলে গেল গণমাধ্যমে। জানা গেল দলের সভাপতিম-লীতে আর ঠাঁই হবে না তাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং মশিউর রহমান রাঙ্গার।
কেবল সভাপতিম-লী নয়, রাঙ্গাকে রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টি এবং তাজুল ইসলামকে কুড়িগ্রাম জাতীয় পার্টির সভাপতির পদ থেকেও অপসারণ করেছেন চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরশাদের ছোট ভাই জি এম কাদের আরেকটু বাড়িয়ে বলেছেন, কেবল সভাপতিম-লী নয়, জাতীয় পার্টির প্রাথমিক সদস্যপদও আর নেই এই দুই নেতার। যদিও মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু বলেছেন, এমন সিদ্ধান্ত হয়নি এখনও।
এর আগে ঢাকা মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি পদ থেকে কাজী ফিরোজ রশীদকেও সরিয়ে দেন এরশাদ। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তখন তেমন কোনো কথা হয়নি। তবে রাঙ্গা ও তাজুলকে সরিয়ে দেওয়ার পর এই দুই নেতা ক্ষোভের কথা বলেছেন প্রকাশ্যেই। রাঙ্গা প্রকাশ্যেই বলেছেন, স্বাভাবিক চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়েছেন এরশাদ।
তাজুল ইসলাম চৌধুরীও জানান ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। তিনি বলেন, ‘এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা হতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। আমরা তাকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা না করায় তিনি ক্ষেপে উঠেছেন।’
এই দুই নেতা পদপদবির দিক থেকে নানা কারণেই বেশ ওজনদারই বলা যায়। তাজুল ইসলাম জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ আর মশিউর রহমান রাঙ্গা গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী। এই দুইজনই আবার জাতীয় পার্টিতে রওশনপন্থি হিসেবে পরিচিত।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে থেকেই জাতীয় পার্টিতে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। একদিকে চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, অন্যদিকে তার স্ত্রী রওশন এরশাদ। এরশাদ এইদিকে তো রওশন অন্যদিকে। ভোটে যাবে না জাতীয় পার্টি জানালেন এরশাদ, কিন্তু রওশন জানালেন, তিনি যাবেন। এর মধ্যে ‘অসুস্থ’ এরশাদের ঠাঁই হলো হাসপাতালে আর রওশনের ‘নেতৃত্বে’ নির্বাচনে গেল জাতীয় পার্টি। প্রথমে শপথ নেবেন না বললেও সংসদ সদস্য হিসেবে পরে ঠিকই শপথ নেন এরশাদ। তবে সংসদীয় দলের নেতা তিনি নন, হলেন রওশন এরশাদ।
দুইজনের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধের খবর এসেছে বারবার। যদিও কেউ কখনও স্বীকার করতে চাননি।
নাখোশ রওশন
দুই নেতাকে এরশাদ কেন বহিষ্কার করলেন, সে বিষয়ে এখনও কোনো কারণ বা ব্যাখ্যা কিছুই দেননি এরশাদ। কেবল বলা হয়েছে, চেয়ারম্যানের ক্ষমতা বলে এই কাজ করেছেন তিনি। তবে বিষয়টি মোটেও ভালোভাবে নেননি রওশন। যদিও এ নিয়ে তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি।
বুধবার তাজুল ও রাঙ্গা সভাপতিম-লী থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর দলের আরেক নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ এবং রওশনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন দফায় দফায়। দলীয় সূত্র জানিয়েছে, তাদেরকে আশ্বস্ত করে কিছু দিন চুপচাপ থাকতে বলেছেন রওশন।
জাতীয় পার্টির সূত্র জানিয়েছে,মন্ত্রিসভায় দলের সদস্যদের থাকা না থাকা এবং বিরোধীদলীয় উপনেতা নির্বাচন ইস্যুতে চলমান টানাপড়েনই এরশাদের এই হঠাৎ সিদ্ধান্তের কারণ। দলের গঠনতন্ত্রে চেয়ারম্যানের ক্ষমতার কারণে তিনি যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, এই বিষয়টি অন্য নেতাদের দেখিয়ে দিয়েছেন এরশাদ।
এরশাদ বেশ কিছুদিন ধরে মন্ত্রিসভা থেকে দলের সদস্যদের পদত্যাগের কথা বললেও রওশন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এ নিয়ে দলের মধ্যে এখনও কথা হয়নি কোনো। মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির যেসব সদস্য আছেন তারা সবাই রওশনপন্থি। তারা সরকার থেকে সরে যেতে রাজি নন বলেও জানিয়েছে দলের সূত্র।
সূত্র জানায়, মশিউর রহমান রাঙ্গাও বিভিন্ন ইস্যুতে পার্টি চেয়ারম্যান এরশাদের বিপক্ষে অবস্থান নেন। প্রকাশ্যে তার সমালোচনা ছাড়াও তিনি দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ অবস্থায় তাকেও দলীয় পদ থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেন এরশাদ।
জাতীয় পার্টির একাধিক সংসদ সদস্য জানিয়েছেন, তাজুল, রাঙ্গা ও ফিরোজ রশীদ বুধবার সংসদ অধিবেশনে মাগরিবের বিরতিতে সংসদ কক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। তাজুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীকে রাঙ্গা এবং তাকে দলের সভাপতিম-লী থেকে অব্যাহতির কথা জানান। জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানতে চান, ‘কেন এমন হলো? এরশাদ সাহেবকে ফোন দেন।’
জানতে চাইলে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিগত নির্বাচনের পর রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতা করার পর থেকে এরশাদ আমার ওপর ক্ষুব্ধ। এর ঝাল তিনি মিটিয়েছেন এভাবে।’
বিরোধীদলীয় উপনেতা কে হবেন?
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আবার অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতা নির্বাচন। সংসদীয় উপনেতা নির্বাচন নিয়ে দলের মধ্যে তৈরি হয়েছে দুটি ধারা। রওশন এরশাদ চান কাজী ফিরোজ রশীদকে সংসদীয় উপনেতা বানাতে। আর এরশাদ চান দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে উপনেতা বানাতে। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বাবলুর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ বলে ধরা হয়। তাকে বিরোধীদলীয় উপনেতা করে এরশাদ সরকারপ্রধানের কাছ থেকে কিছু সুযোগ-সুবিধা নিতে চান বলেও কথা চাউর আছে জাতীয় পার্টিতে। তবে এ নিয়ে জিয়াউদ্দিন বাবলু এখনও মুখ খুলেননি গণমাধ্যমে।
সম্প্রতি রওশন এরশাদ স্পিকারকে চিঠি দিয়ে কাজী ফিরোজ রশীদকে উপনেতা করার কথা জানিয়েছেন। অন্যদিকে পাল্টা চিঠি দিয়ে এরশাদ স্পিকার শারমিন চৌধুরীকে জানান, দলের গঠনতন্ত্রের ২০ ধারায় দেওয়া প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বিরোধীদলীয় উপনেতা, চিফ হুইপ ও হুইপ নির্বাচিত হবে তার সিদ্ধান্তে। এ অবস্থায় বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন স্পিকার। এ কারণে বিরোধীদলীয় উপনেতা নির্বাচনের বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের পদ হারাতে পারেন তাজুল
জাতীয় পার্টির সূত্র জানায়, সভাপতিম-লীর সদস্যের পর যেকোনো সময় বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের পদও হারাতে পারেন তাজুল ইসলাম চৌধুরী। পার্টির চেয়ারম্যানকে উপেক্ষা করে একের পর এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, প্রকাশ্যে তার বিরোধিতা করা, আনুষ্ঠানিক কোনো সভা না হলেও তা সংসদীয় দলের সভা বলে চালিয়ে দেওয়া, বিভেদ সৃষ্টিসহ একের পর এক বিতর্কিত কর্মকা-ের কারণে তাকে এ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। সোমবার বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের উপস্থিতিতে তার কার্যালয়ে জাতীয় পার্টির কয়েকজন সংসদ সদস্য নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
তাজুল ইসলাম চৌধুরী এই আলোচনাকে সংসদীয় দলের সভা এবং সংসদীয় দলের বৈঠক বলে মিডিয়ায় প্রচার করেন। এছাড়া তিনি এ সময় পার্টি চেয়ারম্যানের কঠোর সমালোচনা করেন। বিষয়টি নিয়ে দলের ভেতরে নতুন করে তোপের মুখে পড়েন তিনি। এর আগে ৩১ আগস্ট জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের সভায় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ সবার উপস্থিতিতে তাজুল ইসলাম চৌধুরীর সমালোচনা করে বলেন, ‘তুমি দলের ভেতরে থেকে ষড়যন্ত্র করছো।’ এরশাদ তাকে সংযত আচরণের পরামর্শ দেন বলে জানা গেছে।
জাতীয় পার্টির সূত্রগুলো জানিয়েছে, দলের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন ছাড়া পার্টিতে এরশাদের ক্ষমতা খর্ব করার কোনো সুযোগ নেই। সংসদীয় দলের প্রধান হিসেবে ক্ষমতার অংশে রয়েছেন স্ত্রী রওশন আর দলীয় প্রধান হিসেবে ক্ষমতা এরশাদের হাতে। ফলে মামলা ও সরকারের চাপে এরশাদের জাতীয় পার্টির নিয়ন্ত্রণ যে এখন কার হাতে সেটাই দলটির নেতা-কর্মীদের কৌতূহলের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুগ্ম মহাসচিব পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, ‘দুই তিনজন লোক ম্যাডামকে স্যারের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে। তারা ম্যাডামের কাছে স্যারের নামে উল্টাপাল্টা কথা বলে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাইছে।’
সরকারে থাকতে আগ্রহী জাতীয় পার্টির মন্ত্রীরা
সম্প্রতি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে এরশাদ বলেছেন, জাতীয় পার্টি সংসদে সত্যিকারের বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে চায়। সরকারে থেকে এই ভূমিকা পালন আদৌ সম্ভব কি না সে কথা উঠছে এরই মধ্যে। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রকাশ্যেই বলেছেন, সরকারে থেকে সরকারের সমালোচনা করা শোভা পায় না। এ জন্য এরশাদ সরকারে না থাকার বিষয়ে তার আগ্রহের কথা কয়েকজন নেতাকে জানিয়েছেন।
তবে যে নেতারা সরকারে যোগ দিয়েছেন তারা মন্ত্রিত্ব ছাড়তে রাজি হচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন এরশাদের ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই নেতা জানান, এরশাদ যত কথাই বলুন না কেন, আপাতত মন্ত্রিসভা থেকে আমাদের দলের কারও সরে আসার সুযোগ আমি দেখছি না।
মন্ত্রিসভায় বর্তমানে জাতীয় পার্টির একজন পূর্ণমন্ত্রী এবং দুইজন প্রতিমন্ত্রী আছেন। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে আছেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এছাড়া প্রতিমন্ত্রী হিসেবে আছেন শ্রম ও কর্মসংস্থানের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুজিবুল হক চুন্নু এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে মশিউর রহমান রাঙ্গা।-এই সময়ের সৌজন্যে।