ঢাকা: সারা দেশে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু হয় ১৫ মে থেকে। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম মহানগরে ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় ১০ সেপ্টেম্বর। এর মধ্যে বিপুল সংখ্যক ভোটারের বাদ পড়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়ার পর নাম তোলার সময় আরও তিন দিন বাড়ায় কমিশন। তারপরও বাদ পড়ে যায় বিপুল সংখ্যক মানুষ।
এবার ১৮ বছর হয়েছে মগবাজারের নয়াটোলার বাসিন্দা নওশীনের। সেই হিসেবে ভোটার তালিকায় নাম তোলার যোগ্যতা হয়েছে তার। তালিকা হালনাগাদ হচ্ছে, তাই ধরেই নিয়েছিলেন এবার ভোটার তালিকায় নাম তোলা আর জাতীয় পরিচয়পত্রÑ দুটিই হয়ে যাচ্ছে তার। কিন্তু হয়নি।
নওশীন বলেন, ‘শুনেছিলাম তালিকায় নাম তুলতে লোক আসবে আমার বাসায়। তাই এই কয়েকদিন বাড়িতেই ছিলাম, কোথাও বেড়াতে পর্যন্ত যাইনি। কিন্তু এই অপেক্ষার কোনো ফায়দা হলো না। নাম তুলতে কেউ আসেনি বাড়িতে।’
একই এলাকার বাসিন্দা রেশমি, আমিন, আবুল কালাম অজাদও বললেন একই কথা। তারাও জানান, ভোটার তালিকা হালনাগাদ শুরুর বিষয়টি টেলিভিশন এবং পত্রিকা পড়ে জেনেছেন। কিন্তু অপেক্ষা করেও কোনো নাম লিপিবদ্ধকারীকে পাননি তারা। এখন তারা কী করবেন, সে তথ্যও জানা নেই।
ভোটার তালিকায় নাম উঠানো জরুরি নানা কারণে। জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে নিজের মত দেওয়ার সুযোগ থাকে এতে এবং পাওয়া যায় জাতীয় পরিচয়পত্র। ব্যাংক হিসাব খোলা, সরকারের সঙ্গে লেনদেন, পাসপোর্ট করা, চাকরিতে আবেদন এমনকি মোবাইল ফোনের সিম কেনার মতো কাজেও লাগে এই পরিচয়পত্র।
সারা বছরই ভোটার তালিকায় নাম তোলা এবং জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহের সুযোগ থাকলেও কোথায় গেলে, কীভাবে তা করা যায়, সে নিয়ে তথ্যের অভাব আছে মানুষের মধ্যে। কিন্তু ভোটার তালিকা হালনাগাদ শুরু হলে তালিকায় নাম তোলা সহজ হওয়ার কথা। কারণ এই সময় নির্বাচন কমিশনের লোকজন বাড়িতে এসে তথ্য নিয়ে যাওয়ার কথা।
এবার সারা দেশে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু হয় ১৫ মে থেকে। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম মহানগরে ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় ১০ সেপ্টেম্বর। এর মধ্যে বিপুল সংখ্যক ভোটারের বাদ পড়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়ার পর নাম তোলার সময় আরও তিন দিন বাড়ায় কমিশন। তারপরও বাদ পড়ে যায় বিপুল সংখ্যক মানুষ। কেবল রাজধানী নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকেই বাসাবাড়িতে নাম লিপিবদ্ধকারীদের না যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
তালিকা হালনাগাদ করতে সাধারণত নির্বাচন কমিশন এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। এবার রাজধানীতে এ রকম দায়িত্ব পেয়েছেন মোট ৪০০০। দায়িত্বপ্রাপ্তরা আবার স্থানীয় তরুণদের সহায়তায় কাজটি করে থাকেন। প্রতিটি ভোটারের বিপরীতে টাকাও পান তারা। নিয়ম অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময় বাড়িতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহের কথা তাদের। কিন্তু অভিযোগ আছে, বাড়িতে না গিয়েই কিছু মানুষের তথ্য সংগ্রহ করেই কাজ শেষ করছেন তারা। তবে দায়িত্বপ্রাপ্তরা এই অভিযোগ স্বীকার করতে চান না। তাদের দাবি, বাসাবাড়িতে যান বটে, কিন্তু লোক না থাকায় তালিকায় নাম উঠে না অনেকের।
মগবাজারের নয়াটোলার নজরুল শিক্ষালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ ইসহাক এই এলাকায় নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ভোটারদের তথ্য সংগ্রহ কাজ তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পেয়েছেন। শেষ দিন পর্যন্ত অনেকে বাদ পড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাড়ি বাড়ি যাওয়া হয়নি তা সত্য নয়। অনেকের বাসায় গিয়ে তাদের পাওয়া যায়নি। কোনো কোনো বাড়ি বা ফ্ল্যাট তালাবদ্ধ পাওয়া গেছে।’ কোথাও কোথাও বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি। মোহাম্মদ ইসহাক বলেন, ‘সিঁড়ি ভেঙে পাঁচতলা, এমনকি সাততলা উঠে দেখা গেছে ভোটার হওয়ার মতো কেউ নেই সেখানে। এই অবস্থায় আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা অন্যায়।’ কোনো বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া না গেলে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া লিফলেটের পেছনে তত্ত্বাবধায়কের নম্বরসহ ঠিকানা দরজার নিচ দিয়ে রেখে আসার দাবিও করেছেন মোহাম্মদ ইসহাক।
তবে নয়াটোলার বাসিন্দা আশিক আহমেদ বলেন, ‘আমার জাতীয় পরিচয়পত্র দরকার। অপেক্ষায় ছিলাম কখন তারা বাড়ি আসবে। তারা আসেনি আর আমরা কোনো লিফলেটও পাইনি। যখন দেখলাম কেউ আসছে না, তখন নিজেই ফোন নম্বর যোগাড় করে নির্দিষ্ট স্কুলে গিয়ে নাম ও তথ্য দিয়ে আসলাম।’
এটা কেবল একটি এলাকার চিত্র নয়। এমন ঘটনা অনেক এলাকায় হয়েছে। মোহাম্মদপুরে মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেডের এক নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে থাকেন সানিম। এবার প্রথম ভোটার হওয়ার যোগ্যতা হয়েছে তার। প্রথমবারের মতো ভোটার হওয়ার আনন্দ ছিলো তার মনে। কিন্তু কেউ আসেনি এখানে। এখন কীভাবে ভোটার হতে হবে তাও জানেন না তিনি।
অভিযোগ গেছে নির্বাচন কমিশনেও
ভোটার তালিকায় নাম লিপিবদ্ধ করতে বাড়িতে লোক না যাওয়ার অভিযোগ নির্বাচন কমিশনেও গেছে। বিপুল সংখ্যক মানুষের বাদ পড়ে যাওয়ার কারণে নাম লিপিবদ্ধ করার সময় আরও তিনদিন বাড়িয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করে নির্বাচন কমিশন। তবে কাজ এখানেই শেষ হচ্ছে না, ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হবে ছবিসহ নিবন্ধন। ভোটার হতে আগ্রহীদের নিবন্ধন কেন্দ্রে গিয়ে তুলতে হবে এই ছবি।
নির্বাচন কমিশনের উপসচিব পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক এলাকায় বাড়ি বাড়ি না গিয়ে নির্দিষ্ট স্কুলে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে বলেও তথ্য পেয়েছেন তারা।
ভোটার তালিকা হালনাগাদের এই বেহাল দশায় হতাশ জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অণুবিভাগ। বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যেভাবে করতে চাচ্ছি সেভাবে এগুচ্ছে না কাজ। নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমে হতাশ আমরা। লক্ষ্য অর্জনে পরিশ্রম করে যাচ্ছি আমরা। অথচ নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো তদারকি বা কার্যকর পর্যবেক্ষণের উদ্যোগ নেই। এ কারণেই তথ্যসংগ্রহকারীরা গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো আবু হাফিজ বলেন, ‘ভোটার তালিকায় নাম তুলতে জনগণকে উৎসাহ করতে আমরা নানা ধরনের প্রচারণা চালাচ্ছি। তথ্য সংগ্রহকারীদেরও বলেছি বাড়ি বাড়ি যেতে। এই কাজ করতে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব লোক নেই, অন্যের ওপর ভরসা করতে হয় আমাদের।’ কোনো কারণে তথ্য সংগ্রহকারীরা বাড়ি না গেলে নির্বাচন কমিশনের নির্দিষ্ট ক্যাম্পে এসে ভোটার হওয়া যাবে বলেও জানান এই নির্বাচন কমিশনার।
নতুন নারী ভোটার অস্বাভাবিক কম
নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত সারা দেশে নতুন তিন পুরুষ ভোটারের বিপরীতে নারী ভোটার হচ্ছেন দুইজন। বাংলাদেশে প্রতি ১০৩ পুরুষের বিপরীতে ১০০ নারী থাকার পরও নতুন ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে অনেক কম হওয়া অস্বাভাবিক হিসেবেই দেখছে নির্বাচন কমিশন। লিপিবদ্ধকারীরা বাড়ি বাড়ি না যাওয়াতেই এমনটি হয়েছে বলে মনে করছেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারাই।
কমিশনের হিসাব অনুযায়ী চলতি হালনাগাদ কার্যক্রমে এখন পর্যন্ত ভোটার হয়েছে ২৩ লাখ ৪৬ হাজার ৪০৫ জন। এদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ১৩ লাখ ৩৮ হাজার ২৩, যার শতকরা হার ৫৭ শতাংশ। আর নারী ভোটার ১০ লাখ ৮ হাজার ৩৭৬ জন, যার শতকরা হার ৪৩ শতাংশ।
এই পরিসংখ্যান অস্বাভাবিক মনে করে মাঠ পর্যায়ে তিন দফা নির্দেশনা পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নারীরা কেন বাদ পড়ছে বা তারা কেন ভোটার হতে আগ্রহী হচ্ছে না তা খুঁজে বের করতে তিনটি অনুসন্ধান কমিটিও করেছে কমিশন। সবচেয়ে কম ভোটার হয়েছে এমন উপজেলায় কাজ করবে তারা। গত ৭ সেপ্টেম্বর এ নিয়ে কমিশনে একটি বৈঠকও হয়। বৈঠকে অনুসন্ধানকারীদের ১৫ দিনের মধ্যে কমিশনে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচন কমিশনের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তার নেতৃত্বে চলবে গোটা কাজ। আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠন করা হবে একটি কমিটি। আরেকটি কমিটি হবে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার নেতৃত্বে বা সমন্বয়ে।
কমিশনের তথ্যমতে, নারী ভোটার অস্বাভাবিকভাবে কমেছে কক্সবাজারের পেকুয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলায়। এ তিন উপজেলায় শতকরা ১০ শতাংশ ভোটার এলাকা চিহ্নিত করে তাদের বাড়ি বাড়ি যাবে অনুসন্ধানকারী দল। ওইসব বাড়িতে কোনো নারী আছেন কি না, যদি থাকে তারা কেন ভোটার হননি, হালনাগাদের সময় ইসির তথ্যসংগ্রহকারী সেখানে গিয়েছিল কি না, তা খতিয়ে দেখবে অনুসন্ধান কমিটি।
সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৭২ হাজার ৩৩৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৭ কোটি ৪৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৮৬ জন, যার শতকরা হার ৫০ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। আর নারী রয়েছে ৭ কোটি ৪৭ লাখ ৯১ হাজার ৯৭৮ জন, যার শতকরা হার ৪৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
(ঢাকাটাইমস/১৬সেপ্টেম্বর/ইরা/এআর/ ঘ.)