logo ৩০ এপ্রিল ২০২৫
এরাই নিয়ন্ত্রণ করেন উচ্চশিক্ষা!

মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস
১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ২২:২২:২৫
image


ঢাকা: দেশের উচ্চশিক্ষা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। এই অভিযোগ ঘুষ লেনদেন থেকে শুরু করে কর্মকর্তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও। এসব নানা অভিযোগে ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেখভালের দায়িত্বে থাকা এই প্রতিষ্ঠানটি।

গত ২১ জুলাই একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অতিরিক্ত পরিচালক ফেরদৌস জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

গত ৩০ জুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের পাস করিয়ে দেওয়া পর্যন্ত লেনদেন হয়। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এ বিষয়ে তথ্য চায়। তাতে কুমিল্লায় অবস্থিত ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে জানায়, ফেরদৌস জামানকে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছে।

উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে থাকা সংস্থাটিতে যারা কর্মরত রয়েছেন তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো বালাই নেই। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থেকে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা বনে গেছেন অনেকেই। কেউ আবার অষ্টম শ্রেণি পাস করে পাড়ি দিয়েছেন অনেক পথ। শিক্ষাগত যোগ্যতা কম থাকলেও এভাবেই তারা পদোন্নতি পেয়ে অফিসের বড় পদে বসেছেন। আর এরাই নিয়ন্ত্রণ করছেন দেশের উচ্চশিক্ষার মান।

ইউজিসির এই অবস্থায় হতাশ শিক্ষাবিদরা। তারা বলেছেন, দেশের উচ্চশিক্ষার মাননিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাটির কর্মকর্তাদের অবস্থা যদি নাজুক হয় তাহলে তারা উচ্চশিক্ষার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না কোনোভাবেই। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে আগে মাননিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার মান নিশ্চিত করতে হবে বলেও মনে করেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, ‘উচ্চশিক্ষার দেখভালের দায়িত্বে থাকা ইউজিসিতে অবশ্যই শিক্ষিত জনবল নিয়োগ দেওয়া উচিত। যদিও প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ-পদোন্নতিতে অভ্যন্তরীণ নীতিমালা থাকে। এই নীতিমালার আলোকেই পদোন্নতি বা নিয়োগ দেওয়া হয়।’   

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেন, ‘উচ্চশিক্ষার মান রক্ষা করা যাদের দায়িত্ব সেখানেই যদি গলদ থাকে তাহলে সেটা জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য। এভাবে চলতে থাকলে উচ্চশিক্ষা হুমকির মুখে পড়বে। যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কর্মকর্তারা ঘুষ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছেন এটা অবশ্যই আমাদের জন্য অশনি সংকেত।’   

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা খুবই মর্মাহত। আমাদের উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে যে সংস্থাটি আছে সেটিই যদি কলুষিত হয় তাহলে  তো আর রক্ষা নেই। অবিলম্বে উচ্চশিক্ষা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাটি কলুষমুক্ত করতে হবে। অন্যথায় এই সমস্যা আরও গভীরতর হবে।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘নীতিমালার আলোকে যদি কেউ পদোন্নতি পেয়ে থাকে তাহলে সেখানে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু কেউ যদি অযোগ্য বা অদক্ষ হওয়া সত্ত্বেও অন্য কোনো উপায়ে পদোন্নতি পেয়ে থাকে তাহলে সেটাকে অবশ্যই অনৈতিক এবং দুর্নীতি বলতে হবে। সেটা ইউজিসির মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য কাম্য নয়।’

ইউজিসির সচিব মোহাম্মদ খালেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের আলাদা নীতিমালা থাকে। সেই নীতিমালার আলোকেই পদোন্নতি দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নিজস্ব নীতিমালা রয়েছে। সেই নীতিমালার আলোকে পদোন্নতি হয়েছে। কোনো ধরনের অনিয়ম এবং দুর্নীতি হয়নি।’

এক প্রশ্নের জবাবে ইউজিসির সচিব বলেন, ‘কম লেখাপড়া লোক যদি দক্ষ হয় তাহলে তার পদোন্নতি হওয়ায় সমস্যা কোথায়? আর যাদের পদোন্নতি হয়েছে নীতিমালা মেনেই হয়েছে। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাদের বিরুদ্ধে ইউজিসি ব্যবস্থা নিলে তারা আদালতে চলে যাবে।’

২০০৮ সালে ইউজিসির নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগের নীতিমালায় একজন অষ্টম শ্রেণি বা এসএসসি পাস কর্মচারী পদোন্নতি পেয়ে সহকারী পরিচালক বা উপপরিচালক হওয়ার সুযোগ থাকলেও এখন আর সেই সুযোগ নেই।

ইউজিসির চেয়ারম্যান এ কে আজাদ চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘আগের কমিশনগুলোর বিভিন্ন সময় পূর্ণ কমিশনের সভায় এমন পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। নীতিমালার আলোকেই এসব করেছে। তবে এখন আর এগুলো করা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।’

সেই সব কর্মকর্তা

প্রশাসন বিভাগের সৈয়দ এহতেশাম আলী পিয়ন থেকে সহকারী সচিব হয়েছেন। তিনি পেরিয়েছেন মাধ্যমিকের গ-ি। এছাড়া প্রশাসন বিভাগের সহকারী সচিব আনোয়ার হোসেন এইচএসসি পাস করেছেন। এই তালিকায় রয়েছেন প্রশাসন শাখার এনামুল হকও। গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহকারী পরিচালক শফিকুল ইসলাম, অর্থ ও হিসাব বিভাগের সহকারী পরিচালক জাকির হোসেন পাটোয়ারী, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের সহকারী পরিচালক মুন্সি দাউদ হোসেন ও প্রশাসন বিভাগের সহকারী সচিব শাহজাহান মিয়াও এইচএসসি পাস।

এছাড়া পিয়ন হিসেবে যোগদান করেছেন আবদুল ওয়ারেছ। ইউজিসি সূত্র জানিয়েছে, তিনি এসএসসি পাস। তিনি সহকারী সচিব হিসেবে কর্মরত আছেন। বর্তমানে তিনি চেয়ারম্যানের প্রটোকলের দায়িত্ব পালন করছেন।  

ইউজিসির শীর্ষ কর্মকর্তাদেরও অনেকে তৃতীয় বিভাগে পাস করেছেন। অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক মুহম্মদ ইব্রাহীম কবির এসএসসি ও বিকমে তৃতীয় বিভাগধারী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক মো. সামসুল আলমও এইচএসসিতে তৃতীয় বিভাগে পাস করেছেন।

সহকারী সচিব জালালউদ্দিন আহমেদের শিক্ষাজীবনে তিনটি তৃতীয় বিভাগ রয়েছে। অর্থ ও হিসাব বিভাগের উপপরিচালক মো. শাহ আলম বিএ পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগ পেয়ে পাস করেছেন। এভাবে আরও যাদের শিক্ষা জীবনে তৃতীয় শ্রেণি রয়েছে তাদের মধ্যে আছেন গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সিনিয়র সহকারী পরিচালক আলমগীর তালুকদার, প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী সচিব মোরশেদ আলম খন্দকার, পরিকল্পনা ও উন্নয়নের উপপরিচালক নূর মোহাম্মদ মোল্লা, প্রশাসন বিভাগের উপসচিব মো. ফজলুল রহমান।

এছাড়া যারা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী পদ থেকে ইউজিসির উচ্চতর পদে বসেছেন তাদের মধ্যে রয়েছে ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে যুগ্ম সচিব এস এম মনিরুজ্জামান, রিসিপশনিস্ট থেকে উপপরিচালক নাহিদ সুলতানা, টাইপিস্ট থেকে সিনিয়র সহকারী পরিচালক দেওয়ান গোলাম সারোয়ার, ক্যাশিয়ার থেকে সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর তালুকদার, উচ্চমান সহকারী থেকে সিনিয়র সহকারী পরিচালক আবদুল জলিল মিয়া, মো. জালালউদ্দিন ও মো. রফিকুল ইসলাম, নিম্নমান সহকারী কাম টাইপিস্ট থেকে সিনিয়র সহকারী পরিচালক শঙ্কর কুমার চক্রবর্তী, কম্পিউটার অপারেটর থেকে সিনিয়র সহকারী সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা থেকে সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. শফিকুর রহমান, অফিস সহকারী থেকে সিনিয়র সহকারী সচিব জালাল আহম্মদ, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা থেকে সিনিয়র সহকারী সচিব রাবেয়া খন্দকার, ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. সুলতান মাহমুদ, উচ্চমান সহকারী থেকে সহকারী সচিব মোহাম্মদ শরিয়ত উল্লা, মো. আনোয়ার হোসেন ও সহকারী পরিচালক মো. গিয়াস উদ্দিন, টাইপিস্ট থেকে সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ লিয়াকত হোসেন ও কম্পিউটার অপারেটর থেকে পদোন্নতি দিয়ে সুরাইয়া ফারহানাকে সহকারী সচিব করা হয়েছে। তিনি এখন শিক্ষা ছুটিতে আছেন।

ইউজিসি চেয়ারম্যানের দপ্তরে কর্মরত সহকারী সচিব মো. আবদুল ওয়ারেছের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানিয়েছেন, ‘আমি এসএসসি পাস নই। আমি এইচএসসি পাস করেছি। দুইবার ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়েছি। দুইবারই ফেল করেছি।’

তবে কেউ যদি এসএসসি পাস করে পদোন্নতি পেয়ে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হন তাতে দোষের মনে করেন না আবদুল ওয়ারেছ। তিনি বলেন, ‘আগের এসএসসি পাস আর এখন এমএ পাসের সমান। ত্রিশ বছর পর যদি কেউ পদোন্নতি পায় তাহলে সেটা কি অপরাধ? আর এটা প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন মেনেই করা হয়।’ শিক্ষার চেয়ে অভিজ্ঞতার মূল্য অনেক বেশি বলে জানান তিনি।

রিসিপশনিস্ট থেকে উপপরিচালক হওয়া নাহিদ সুলতানা চাকরিতে যোগদানের দুই বছরের মধ্যেই সেকশন অফিসার হন। এরপর পাঁচ বছরে হয়ে যান সহকারী পরিচালক। ৮ বছরের মাথায় তিনি পদোন্নতি পান উপপরিচালক হিসেবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যা হয়েছে সব কিছু নিয়ম মেনেই হয়েছে। এর বেশি কিছু আমি বলতে পারব না।’

ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে যুগ্ম সচিব হওয়া এস এম মনিরুজ্জামানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ সাংবাদিকদের সঙ্গে আমাদের কথা বলা নিষেধ আছে। আপনি আমাদের সচিব স্যারের সঙ্গে কথা বলেন।’- এই সময়ের সৌজন্যে