logo ৩০ এপ্রিল ২০২৫
সাঈদী খুনি, ধর্ষক

আল ফারুক
২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ১১:৫৪:৪৭
image


মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধের জন্য কুখ্যাত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সমর্থকের অভাব নেই দেশজুড়ে। মুক্তিযুদ্ধের পর পর আত্মগোপনে থাকলেও পরে সুযোগ বুঝে মানুষের ধর্মীয় আবেগের দুর্বলতা লুফে নিয়ে তিনি এমন এক ধরনের ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন যাতে অনেকটাই চাপা পড়ে যায় একাত্তরের অপরাধ। আর পেশিশক্তির জোরে সুবিধামতো সময়ে একাত্তরে ক্ষতিগ্রস্তদের এলাকা এমনকি দেশ ছাড়া করেছে সাঈদীর সমর্থকরা। আর একাত্তরে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ে না থাকায় দালিলিক প্রমাণও ছিল না তার বিরুদ্ধে। এসব কারণেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামিদের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক অভিযোগ আনার পরও তার বেশিরভাগেরই প্রমাণ হয়নি বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা। তবে এতকিছুর পরও তার বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণের মতো আটটি অভিযোগ প্রমাণও বড় হিসেবেই দেখছে রাষ্ট্রপক্ষ।

২০১১ সালের ৩ অক্টোবর প্রথম ব্যক্তি হিসেবে সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগ আমলে নেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ১৫টি খ-ে তার বিরুদ্ধে মোট  ৪৪৭৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দেয়। এগুলোতে অভিযোগ আনা হয় মোট ৩১টি। তবে ১১টি অভিযোগ আমলে নেয়নি ট্রাইব্যুনাল।

২০টি অভিযোগের মধ্যে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি খুনের দুটি অভিযোগে জামায়াতের নায়েবে আমিরকে মৃত্যুদ- দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। লুট, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন, ধর্ষণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার আরও ৬টি অপরাধ প্রমাণ হওয়ার পরও সেগুলোতে সাজা দেয়নি ট্রাইব্যুনাল। তবে আপিল বিভাগ সাঈদীকে সাজা দিয়েছে মোট ৫টি অভিযোগে। ট্রাইব্যুনালে ৮টি অভিযোগ প্রমাণ হলেও ৩টি অভিযোগ প্রমাণ হয়নি আপিল বিভাগে।

এই রায়ের পর খালাস চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেন সাঈদী, আর প্রমাণ হওয়ার পরও সাজা না দেওয়া অপরাধে সাজা চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।  প্রায় দেড় বছর পর বুধবার রায় দেয় আপিল বিভাগ। ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদ-ের সাজার বদলে সাঈদীকে আমৃত্যু কারাগারে বন্দি রাখার নির্দেশ দেয় আপিল বিভাগ।

আপিল বিভাগের এই রায়ের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন করে আসা বিভিন্ন সংগঠন এবং লাখো মানুষ হতাশা এবং ক্ষোভ জানিয়েছেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, তারা এই রায়ে সন্তুষ্ট নন। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের রায় মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।

সাঈদীর ফাঁসি না হলেও তার বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুটের মতো মানবতারিরোধী অপরাধের অভিযোগ সর্বোচ্চ আদালতে প্রমাণ হওয়াকেও বড় পাওয়া হিসেবে দেখছে রাষ্ট্রপক্ষ। আলাপকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘এখন সাঈদীকে নিশ্চিতভাবে খুনি, ধর্ষক বলা যাবে। কারণ দেশের সর্বোচ্চ আদালতে তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে, এর জন্য সাজাও দেওয়া হয়েছে।’

সাঈদী গত তিন দশক ধরে নিজেকে ধর্ম প্রচারক হিসেবে দাবি করে এসেছেন, সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ে মানুষের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে কী প্রভাব ফেলতে পারে জানতে চাইলে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘তিনি পড়াশোনা করেছেন মাদ্রাসায়। আর কণ্ঠস্বর ছিল আকর্ষণীয়। বক্তব্য উপস্থাপনের ভঙ্গিও ধর্মভীরু মানুষকে আকৃষ্ট করত। আর চতুর সাঈদী একে ব্যবহার করে নানা বক্তব্য দিয়ে বেড়াতেন। আর এসব কারণেই মুক্তিযুদ্ধের সময় তার নির্মমতা ভুলিয়ে দিয়ে নতুন ভাবমূর্তি তৈরি করতে পেরেছিলেন সাঈদী। এখন প্রমাণ হয়েছে ধর্মের মুখোশ ব্যবহার করে তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধ ঢাকার চেষ্টা করেছেন। তার সমর্থকরা বিষয়টি সহসাই মেনে না নিলেও দীর্ঘমেয়াদে মানুষের মধ্যে এখন এই বোধ আসবে যে, সাঈদী আসলে একজন ভ- এবং অপরাধী।’

ফাঁসি না হওয়ায় দেশজুড়ে ক্ষোভ

সাঈদীর আপিল শুনানি শেষ হয়েছিল ১৬ এপ্রিল। প্রায় পাঁচ মাস ধরে রায়ের অপেক্ষার মধ্যে সরকারের সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতার গুজব ছড়ায়। এই সময়ে ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধেও মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেক মামলায় শুনানি শেষেও রায় আটকে আছে। ২৪ জুন রায়ের দিন সকালে নিজামীর অসুস্থতার চিঠি আসে ট্রাইব্যুনালে। আসামি হাজির হতে না পারায় আটকে যায় রায়। এরপর নিজামীর সুস্থতার চিঠি ট্রাইব্যুনালে গেলেও রায়ের নতুন দিন ঘোষণা হয়নি।

এর মধ্যে আপিল বিভাগ সাঈদীর মৃত্যুদ-ের সাজার বদলে আমৃত্যুকারাদ- দেওয়ার পর পরই দেশজুড়ে শুরু হয় সমালোচনা। গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা রাজপথে নেমে এসে প্রতিবাদ জানায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে জামায়াতের সঙ্গে সরকারের আঁতাতের অভিযোগ আনে হাজার হাজার মানুষ। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অবশ্য এসব সমালোচনা উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, জামায়াতের সঙ্গে সরকারের কোনো ধরনের যোগাযোগের কারণ নেই। কারণ জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করে সরকারের কোনো দিক থেকে লাভ নেই।

আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন মনে করেন, সাঈদীর ফাঁসির রায় না হওয়ায় জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি হতেই পারে। তবে এই বিভ্রান্তি কেটে যাবে বলে মনে করেন তিনি। লেনিন বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমঝোতা হতে পারে না কোনো দিক থেকেই। কারণ মুক্তিযুদ্ধ, এমনকি এর আগে থেকেই তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের শত্রুতা। আওয়ামী লীগ অস্ত্র তুলে নিয়েছে দেশের স্বাধীনতার জন্য, আর এই দেশের মানুষকে হত্যা করে স্বাধীনতার স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিতে চেয়েছিল জামায়াত। মুক্তিযুদ্ধের পরও বাংলাদেশবিরোধী ও আওয়ামী লীগবিরোধী তৎপরতা চালিয়ে গেছে জামায়াত। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক করলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি থাকে কিÑ এই প্রশ্নও তোলেন দলটির সভাপতিম-লীর এই সদস্য।

তবে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা এসব যুক্তি মানতে নারাজ। সাঈদীর ফাঁসির বদলে আমৃত্যু রায়ের পেছনে ষড়যন্ত্র আছেÑ এই বিশ্বাস মঞ্চের কর্মীদের। মঞ্চের সমন্বয়ক ইমরান এইচ সরকারের দৃঢ় বিশ্বাস, জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আঁতাতের ফলেই সাঈদীর মামলায় এই রায় হয়েছে।

রায়ে হতাশা জানিয়েছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠনও। তবে ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত বলেন, ট্রাইব্যুনালে সাঈদীর বিরুদ্ধে আমরা যেসব অভিযোগ প্রমাণ করেছি সেগুলো আপিল বিভাগেও প্রমাণ হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম আপিল বিভাগ সর্বোচ্চ সাজা দেবে। কিন্তু সেটি হয়নি। তারপরও সাঈদী যে নিরপরাধ নয়, সেটা প্রমাণ হওয়াও বড় পাওয়া।   

প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া

আপিল বিভাগে সাঈদীর মামলার রায়ের পরদিন সংসদে এ নিয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘সাঈদীর ফাঁসি হলেই বাংলাদেশের মানুষ খুশি হতো।’ তৃতীয় অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই রায় কারো কাছে কাক্সিক্ষত ছিল না। সাঈদীর ফাঁসি হলে দেশের মানুষ খুশি হতো। দেশের আদালত স্বাধীন, বিচার বিভাগ স্বাধীন। এই রায় নিয়ে বলার কিছু নেই।’

আপিল বিভাগের রায়ের পর সাঈদীকে মানুষ অন্যভাবে চিনবে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সাঈদী ধর্মগুরু, ধর্ম প্রচারক হিসেবে নাম করে নিয়েছিল। এখন তাকে একজন খুনি, ধর্ষক, অপরাধী, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে জনগণ মনে রাখবে।’



প্রমাণ হয়েছে যেসব অভিযোগ

জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে আনা ২০টি অভিযোগের মধ্যে ৮টি প্রমাণ হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং আপিল বিভাগে। এর মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় পিরোজপুর সদর উপজেলার চিলতিয়া গ্রামের মানিক পসারীর বাড়িতে হানা দিয়ে তার ভাই ইব্রাহিম কুট্টিকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা এবং সে সময়কার ইন্দুরকানি থানার উমেদপুর গ্রামে হানা দিয়ে হিন্দুপাড়ার ২৫টি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর বিসাবালীকে নারকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যার অভিযোগে সাঈদীকে মৃত্যুদ- দেয় ট্রাইব্যুনাল।

ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যার পাশাপাশি সেদিন লুট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। তবে এসব অভিযোগের অংশবিশেষ থেকে সাঈদীকে খালাস দিয়ে বাকি অংশবিশেষে তাকে ১২ বছরের কারাদ- দেয় আপিল বিভাগ। আর বিসাবালীকে হত্যার অভিযোগে আমৃত্যু কারাদ- দেয় আপিল বিভাগ।

সাঈদীকে আমৃত্যুকারাদ- দেওয়া হয় আরও দুটি অভিযোগে। এর একটি আটকে রেখে ধর্ষণ এবং অপরটি জোর করে ধর্মান্তরিত করার।

মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলামের বাড়িতে হানা দিয়ে তার বাবাকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া এবং বাড়ি লুট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে ১০ বছরের কারাদ- দেওয়া হয় সাঈদীকে।

তবে ট্রাইব্যুনালে প্রমাণ হলেও লুট, হামলা এবং ধর্ষণের আরও তিনটি অভিযোগ থেকে সাঈদীকে খালাস দেয় আপিল বিভাগ। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আপিল বিভাগে এই রায়ের জন্য ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা এবং প্রসিকিউশনের দুর্বলতাকে দোষারোপ করেছেন। তবে ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত এই মন্তব্য ঠিক নয় বলে মনে করেন। এই সময়কে তিনি বলেন, ‘যেসব অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে সাঈদীর সাজা দেওয়া হয়েছে সেগুলোতেই আপিল বিভাগ সাজা দিয়েছে। প্রসিকিউশনের দুর্বলতা থাকলে এটা কীভাবে সম্ভব হতো।’