বগুড়া সদরের পালশা গ্রামের কৃষক আতাউর রহমান।প্রতি বছর রোজার ঈদের পর চার থেকে পাঁচটি গরু কেনেন। দুই মাস লালন-পালন শেষে সেগুলো বিক্রি করেন কোরবানির হাটে। এতে তার লাভ থাকে ভালোই। এ বছরও কিনেছেন পাঁচটি গরু। একেকটি কিনেছিলেন ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায়। বাড়িতে এসে দালালরা এখন প্রতিটির দাম বলছে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। অল্প সময়ে কী এমন চমক দেখালেন তিনি? জানতে চাইলে বলেন, ‘সাধারণ খাওন দিলে কি আর গরু হাটত তুলবার পারমো? বিদেশি ভিটামিন দেওয়া লাগে খৈল-ভুসির সঙ্গে। মেলাডি ট্যাকা দাম ভিটামিনের। তারপর সুইও দেওয়া লাগে।’ কী সেই ভিটামিন, যা গরুকে দুই মাসের মধ্যেই করে তোলে হৃষ্টপুষ্ট? ‘নাম কবার পারমু না বাবা। কাগোজত লেখা আছে। ডাক্তরের ঘরত গেলে পাওয়া যায়।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, ভিটামিনের নামে আতাউরের মতো অনেক খামারিই গরুকে খাওয়ান ডেকাসন, ডেঙামেথাসন, বেটামেথাসন ও পেরিঅ্যাকটিন জাতীয় ওষুধ। এছাড়া স্টেরয়েডের মতো হরমোন ইনজেকশনও দেওয়া হয় কোরবানির জন্য বিক্রি করা গবাদিপশুকে। গ্রামে অবশ্য এগুলো গরুর ভিটামিন বলেই জানেন তারা। কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন, এসব ওষুধ পশু বা মানুষ যাকেই খাওয়ানো হোক এক সপ্তাহের মধ্যে তার শরীরে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। মোটাতাজা হয়ে উঠবে কম সময়ে। তবে এই পরিবর্তন ক্ষণস্থায়ী। বড়জোর দুই থেকে তিন মাস। মুহূর্তেই মোটাতাজা করে তোলে এই জাতীয় ওষুধ গরুকে খাওয়ালে তার শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। শরীরের দূষিত পানি বের হতে পারে না। এগুলো জমা হয় মাংসে। যে কারণে গরুকে দেখা যায় মোটাতাজা।
ভয়াবহ তথ্য হচ্ছে, এসব গরুর মাংসে জমা হওয়া রাসায়নিক পদার্থ আগুনেও নষ্ট হয় না। এ দূষিত মাংস খেলে লিভার, কিডনি অকেজো, ক্যান্সার, হৃদরোগ ও মস্তিষ্কের জটিল রোগে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে শতভাগ।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ইকবাল কবীর বলেন, ‘গরুকে স্বাভাবিক নিয়মে পুষ্টিকর ও মাংস বৃদ্ধি করে এমন খাবার দিলে এমনিতেই এটি মোটাতাজা হয়, যা পশু এবং মানুষ উভয়ের জন্যই স্বাস্থ্যকর। একটা সময় কোরবানির পশুকে এভাবেই পরিচর্যা করা হতো। কিন্তু এখন দ্রুত বেশি লাভের আশায় কেউ কেউ নানা জাতের হরমোন জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করে গরুকে মোটাতাজা করে।’ তিনি বলেন, ‘খামারিরা এজন্য পুরোপুরি দায়ী নয়। কারণ তাদের কম সময়ে গরু মোটাতাজা করার জন্য ওষুধ প্রয়োগের বুদ্ধি পরামর্শ দেন হাতুড়ে প্রাণী চিকিৎসকরা।’
ক্রেতাকে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘গরুর দিকে তাকালেই বোঝা যায়, এটি স্বাভাবিকভাবে মোটাতাজা হয়েছে, নাকি কৃত্রিমতা আছে। ক্রেতারা একটু সতর্ক হলেই সুস্থ গরু চিনতে পারবেন।’
কেন্দ্রীয় প্রাণিরোগ অনুসন্ধান গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বিধান চন্দ্র দাস জানান, গরুকে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে এমন খবর পেলে এবং তা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের জানালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিন্তু কতজন জানে এই আইনের কথা? জানতে চাওয়া হয়েছিল টাঙ্গাইলের কালিহাতীর চাষি লতিফ মিয়ার কাছে। ‘ডাক্তাররা কয় গরুরে মোটা করতে হরমন সুই দেওন লাগে। তাই দেই। কিন্তু এইডা দিলে যে জেল-জরিমানা হইব এইডা তো কেউ কয় নাই।’
দেদার মেলে ক্ষতিকর উপাদান
কোরবানির গরু নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে এক ধরনের মিথ চালু আছে যে, পশু হৃষ্টপুষ্ট হলে পুণ্য বেশি। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে কোনো পশু কম সময়ে এত মোটাতাজা হতে পারে কি না সেই কথাটি বিবেচনায় থাকে না সব সময়। তাই না জেনে কেউ কেউ জড়াচ্ছে এই কাজে। আর পশু ওষুধ খেলে মানুষের ক্ষতি হবে, এই ভাবনাটিও আসে না অনেকের মনে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ক্যাটাফস, বার্গাফ্যাট, বায়োমিঙ্গ জাতীয় ওষুধ সহজেই পাওয়া যায়। বিশেষ করে গ্রামের হাট-বাজারগুলোতে এগুলো দেদার বিক্রি হয়। এসব ওষুধ বিক্রিতে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞার কথাও শোনেনি অনেকে। নেই কঠোর নজরদারি। যে কারণে টাকা হলে সহজেই খামারির হাতে পৌঁছে যাচ্ছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক এসব বিষ।
বগুড়া সদরের পশু চিকিৎসক আলতাফুর রহমান বলেন, ‘ক্যাটাফস, বায়োমিঙ্গ, ইউরিয়া সেবন করালে গরুর লিভার ও কিডনিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। গরু অবলা প্রাণী বলে কিছু বলতে পারে না। আসলে এই ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় গরুর দেহ থেকে পর্যাপ্ত পানি স্বাভাবিক নিয়মে বের হতে পারে না। এগুলো জমা হয় চামড়ার নিচে এবং মাংসে। গরুর খাওয়া-দাওয়ায় অরুচি চলে আসে। মুখ দিয়ে লালা ঝরে। অনেক পশু টিকতে না পেরে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটে।’
বিষমুক্ত নিরাপদ খাদ্যবিষয়ক জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব লেনিন চৌধুরী জানান, গরুকে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ খাওয়ালে তা মাংসে জমা হয়। এই মাংস মানুষ খেলে তার বিপাকক্রিয়া কমে যায়, যা থেকে নানা ধরনের রোগের সৃষ্টি হয়।
ভারতীয় গরুতেও বিষ!
বেসরকারি সংগঠন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনÑপবার এক হিসাব মতে, দেশে বর্তমানে প্রতি বছর ৪২ লাখ গরু এবং ১ কোটি ৮০ লাখ ছাগল জবাই হয়। এর ৪০ ভাগই কোরবানির সময় জবাই হয়। গরুর মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ আসে ভারত থেকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত থেকে যেসব গরু বাংলাদেশে ঢুকছে এগুলোকেও অতিরিক্ত মাত্রায় ওষুধ সেবন করানো হয়। কারণ ভারতীয়দের মূল উদ্দেশ্যই ব্যবসা। ব্যবসা ভালো করতে তারা এ কাজ করে। কিন্তু আজ থেকে ৫ বছর আগেও ভারতীয় গরু দেখতে রোগাটে ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ভারত থেকেও বিশাল আকৃতির মোটাতাজা গরু আসছে। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, বেশি দাম পাওয়ার আগে গরুগুলোকে রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগে কৃত্রিমভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলা হচ্ছে।
পবার সাধারণ সম্পাদক আবদুস সোবহান বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশেই মানুষের খাবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে ঢুকতে দেওয়া হয় না। একমাত্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই যেন বিষয়টি ব্যতিক্রম। সীমান্ত দিয়ে ট্রাকে করে লাখ লাখ গরু ঢুকছে। অথচ এগুলোর কোনোটিই স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে না।’
নিষিদ্ধ ওষুধ আসে ভারত-পাকিস্তান থেকে
প্রাণী ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ওষুধ আমদানিতে সরকারের বাধ্যবাধকতা থাকলেও কোনো কাজে আসছে না। ঠিকই চোরাই পথে কিংবা বিভিন্ন নামে-বেনামে দেশে ঢুকছে নিষিদ্ধ ওষুধ। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তান থেকে অবৈধ পথে দেশের বাজারে চলে আসছে কৃত্রিমভাবে গরু মোটাতাজা করার ওষুধ। এগুলো সচরাচর বিক্রি হচ্ছে গো-খাদ্য বিক্রেতার দোকানেই। সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া, শেরপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, জামালপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, যশোর, বেনাপোল, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অহরহ পাওয়া যাচ্ছে গরু মোটাতাজা করার ওষুধ। মূলত এসব অঞ্চল থেকেই বেশি গরু আসে রাজধানীসহ আশপাশের হাট-বাজারে।
যেসব রোগের ঝুঁকি বাড়ে
নিষিদ্ধ ওষুধ খাইয়ে গরুকে মোটাতাজা করলে ওই গরুর মাংস খাওয়ার পড় মানবদেহে বিভিন্ন ধরনের রোগ দেখা দিতে পারে। চিকিৎসকরা বলেন, গরুর শরীরে প্রয়োগ করা রাসায়নিক দ্রব্যগুলো এতটাই ভয়াবহ হয় যে, আগুনের তীব্র তাপেও এগুলোর কার্যকারিতা পুরোপুরি ধ্বংস হয় না। যে কারণে এসব গরুর মাংস খেলে হৃদরোগ, কিডনি ও লিভার বিকল, উচ্চ রক্তচাপ, চর্মরোগ, শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের জটিল রোগ দেখা দেয়। হতে পারে ক্যান্সারও।
জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের রেসপিরেটরি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক উত্তম কুমার বড়–য়া বলেন, ‘স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার হয় হাঁপানি রোগের চিকিৎসায়। কিন্তু এটি গরুকে খাওয়ালে যা হওয়ার তাই হয়। গরুর শরীর তো আর এসব ওষুধ সেবনের উপযোগী নয়। তাই এটির বিক্রিয়া গরুকে ভেতরে ভেতরে অসুস্থ করে তোলে।’ তিনি বলেন, ‘নিষিদ্ধ ওষুধ খাইয়ে মোটাতাজা করা গরুর মাংস মানুষ খেলে তার স্বাস্থ্যঝুঁকি অনিবার্য। অনেক সময় দেখা যায়, গরুর মাংস খেয়ে অনেকে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এর পেছনে কারণ এটাই। তাই যতটুকু সম্ভব দেখেশুনে পশু কেনা ও মাংস খাওয়া উচিত।’
স্বাভাবিক খাবারেই গরু হবে নাদুসনুদুস
রাসায়নিক খাবার খাওয়ালে গরুর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। গরুর আয়ুও কমে আসে। নানা ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। প্রাণী বিজ্ঞানীরা বলছেন, সবুজ ঘাস, খড়, খৈল, দানাদার খাবার, ভুসি নিয়মিত এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে গরুকে খাওয়ালে এমনিতেই গরু নাদুসনুদুস হবে। তবে রোগ হলে অবশ্যই তাকে প্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়াতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে।
আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণ সম্পর্কে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপালন অনুষদের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোজাফফর হোসেন জানান, প্রয়োজনীয় উপাদান ও পদ্ধতি মেনে তিন মাসের মধ্যে গরুকে মোটাতাজা করা যায়। অনেক সময় চার থেকে ছয় মাসও লাগতে পারে। গরু মোটাতাজা করার জন্য সুবিধাজনক সময় হচ্ছে বর্ষা এবং শরৎকাল। কারণ এই সময়গুলোতে প্রচুর পরিমাণে কাঁচা ঘাস পাওয়া যায়। চাহিদার ওপর ভিত্তি করে কোরবানি ঈদের কিছুদিন আগ থেকে গরুকে উন্নত খাদ্য ও ব্যবস্থাপনা দিয়ে মোটাতাজা করা স্বাস্থ্যসম্মত ও লাভজনক।-এই সময়ের সৌজন্যে