logo ৩০ এপ্রিল ২০২৫
সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গা, ঢাকায়ও
বিলকিছ ইরানী, ঢাকাটাইমস
২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ১১:১৭:৪৭
image




ঢাকা: মিয়ানমারে দমন-পীড়নের কারণে আশির দশক থেকেই বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছে রোহিঙ্গারা। কক্সবাজারের টেকনাফে তাদের জন্য আশ্রায়ণ শিবির করা হলেও পরে তারা চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। পরিচয় গোপন করে বাঙালিদের বিয়েসহ নানা সামাজিক বন্ধনে জড়াচ্ছে এরা। পাশাপাশি বাঙালি সেজে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিদেশেও শ্রমিক হিসেবে যাচ্ছে তারা।

মিয়ানমারে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ, ক্যাম্প-জীবনের নানা বঞ্চনার কারণে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেশি বলে ধারণা করা হয়। বিভিন্ন দেশে তাদের এই অপরাধপ্রবণতার কারণে বাঙালিদেরও পড়তে হয়েছে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী হওয়ায় সেসব দেশে তারা এ দেশের নাগরিক হিসেবেই স্বীকৃতি পাচ্ছে।

নানা সময় নানা সংস্থার কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার পর রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় নাম উঠানো এবং পাসপোর্ট করা ঠেকাতে নানা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। কিন্তু চেহারা ও শারীরিক গঠনে মিল থাকার কারণে এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বারবার। বাঙালি সেজে বিদেশ যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে নানা সময় আটকও হয়েছে তারা।

এবার ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয় মাঠকর্মীদের। তবে অতীতের নানা অভিজ্ঞতার কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের তথ্য সংগ্রহকারীরা যেভাবে সতর্কভাবে কাজ করেছেন, অন্যান্য জেলাগুলোতে তেমন সতর্কতা ছিল না। আর এই সুযোগে বিভিন্ন জেলায় গিয়ে বাড়ি ভাড়া করে ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের নাম তোলার বিষয়ে অভিযোগ এসেছে নির্বাচন কমিশনে। খোদ ঢাকায় নাম-ঠিকানাসহ এমন অভিযোগ পেয়ে হতভম্ভ নির্বাচন কমিশন।

সম্প্র্রতি দুই মহানগরে ভোটার তালিকা হালনাগাদ নিয়ে কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির এক বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। সভায় বিভাগীয় কমিশনার, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রোহিঙ্গাদের ঠেকানো যাচ্ছে না বলে উদ্বেগ জানান বলে জানিয়েছেন অংশগ্রহণকারী একাধিক কর্মকর্তা।

নির্বাচন কমিশনের কাছে আসা অভিযোগ অনুযায়ী মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকারীরা দুভাবে ভোটার হচ্ছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও ইসির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অনুপ্রবেশকারীরা পাহাড় থেকে সমতলে চলে আসে। সেখানে ভোটার হয়ে আবার পাহাড়ে চলে যায়। অন্যদিকে স্থানীয় ব্যক্তিদের আত্মীয় পরিচয় নিয়ে নিবন্ধন ফরম পূরণের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের চোখকে ফাঁকি দেয় অনুপ্রবেশকারীরা। আর তাদের সহায়তা করে একটি চক্র।

রোহিঙ্গারা যে প্রক্রিয়য় পাহাড় থেকে ছড়িয়ে পড়েছে, সেই প্রক্রিয়ায় ঢাকাতেও কেউ কেউ এসেছে বলে ওই সমন্বয় সভায় জানানো হয়।

নির্বাচন কমিশনের এক কর্মকর্তা জানান, গত ১৫ মে ভোটার তালিকা হালনাগাদ শুরু হওয়ার আগেই কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৪টি এলাকাকে বিশেষ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে কার্যক্রম শুরু করা হয়। রোহিঙ্গারা যাতে ভোটার হতে না পারে সেজন্য এসব এলাকায় দুটি ফরম পূরণের ব্যবস্থাও রাখে কমিশন।

ভোটার তালিকা হালনাগাদ শুরুর পর চট্টগ্রামের পটিয়া থেকে বেশ কিছু অভিযোগ পাওয়ার পর ওই এলাকাটিকে ‘বিশেষ এলাকা’য় অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেন নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক। এরপরও শঙ্কা না কাটায় পুরো বৃহত্তর চট্টগ্রামকেই বিশেষ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এতেও সমস্যার সমাধান হয়নি। বরং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি, পানছড়ি ও রাঙামাটির কাউখালীতে অস্বাভাবিক হারে ভোটার বেড়ে যায়।

এ ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে ২ সেপ্টেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে একটি প্রতিবেদন দেন নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক। এতে তিনি লিখেন, ‘চট্টগ্রামের পটিয়ায় অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। উপজেলা ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা সতর্কতা অবলম্বন করেনি বলেই এমনি হয়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, ‘রোহিঙ্গারা ভোটার হওয়ার চেষ্টা করবে- এটাই স্বাভাবিক। তারা যাতে ভোটার হতে না পারে সেই চেষ্টা করেছি। ঢাকাতেও তারা ভোটার হওয়ার চেষ্টা করেছে বলে আমরা ধারণা করছি। কোনো রোহিঙ্গা ঢাকাসহ সারা দেশে ভোটার হয়েছে কি না তা তদন্ত করতে বিশেষ টিম গঠন করেছি। তদন্ত শেষেই এ বিষয়ে জানা যাবে।’

নির্বাচন কমিশনের সচিব সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘রোহিঙ্গারা ভোটার হয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে পাসপোর্ট তৈরি করে দেশের বাইরে চলে যায়। এভাবে তারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে পারে। তাই মাঠ প্রশাসনের গাফিলতির কারণে যেন কোনো বিদেশি ভোটার না হয়, সে বিষয়ে তীক্ষè দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

১৫ মে থেকে সারা দেশে ভোটার তালিকা হালনাগাদ শুরু হয়েছে। এই কার্যক্রম শেষ হবে ১৫ নভেম্বর।

রোহিঙ্গাদের সংখ্যা কত?

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা কত সে বিষয়ে সরকারের কাছে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে দেশটির সঙ্গে সরকারের আলোচনা বারবার ব্যর্থ হওয়ার পেছনে এটাও একটা কারণ বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষকরা। পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসিকে জানিয়েছেন, স্থানীয় প্রশাসন এবং ইউনিয়ন পরিষদের সহায়তা নিয়ে সরকার রোহিঙ্গাদের সংখ্যা জানতে জরিপ শুরু করবে। কয়েক মাসের মধ্যে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু হবে বলেও জানান তিনি।

কক্সবাজারে দুটি শিবিরে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে। এ ছাড়া আড়াই লাখ রোহিঙ্গার হিসাব আছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের। তবে এটা আনুষ্ঠানিক হিসাব। এর বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ বা তার চেয়েও বেশি বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাসিন্দাদের সঙ্গে চেহারায় মিল থাকার কারণে এদের শনাক্ত করা বেশ কঠিন। আর দীর্ঘদিন বাংলাদেশে থাকলে ওই অঞ্চলের ভাষাও রপ্ত করে ফেলে তারা।

বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের একাংশ মাদকপাচারসহ বিভিন্ন গুরুতর অপরাধে জড়িত।

নব্বই দশকের শুরুর দিকে মিয়ানমার থেকে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছিল। সে সময় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এদের বেশির ভাগকে স্বদেশ ফেরত পাঠানো গিয়েছিল। কিন্তু দেশটিতে নানা সময় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বৌদ্ধদের সংঘর্ষ-সংঘাতে বারবার সাগর পাড়ি দিয়ে এ দেশে এসেছে তারা।

বর্তমানে কক্সবাজারের কুতুপালং ও নয়াপাড়ায় এলাকায় দুটি শিবির আছে রোহিঙ্গাদের। বাংলাদেশ সরকার বারবার চাপ দিয়ে এলেও ২০০৫ সাল থেকে তাদের প্রত্যাবাসন বন্ধ আছে।

মিয়ানমার থেকে মূলত নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে ঢোকে রোহিঙ্গারা। স্থানীয়রা জানায়, সীমান্ত এলাকার বেশ কিছু দালাল এমনকি বিজিবির সদস্যরা টাকার লোভে তাদের সহায়তা করছে এই কাজে। কক্সবাজারের হ্নীলার জাদিমুরার জাইল্যাপাড়া আর চৌধুরীপাড়া পয়েন্ট দিয়েই বেশি অনুপ্রবেশ ঘটছে। বাংলাদেশে  ঢ়োকার পর তারা নয়াপাড়া, লেদা, মচনিসহ আশপাশের এলাকায় অবস্থান করে। পরে তারা সুবিধা অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকায় চলে যায়।

মাদক চোরাকারবারিরা এসব রোহিঙ্গাকে কম টাকায় ব্যবহার করে বলে অভিযোগ আছে। তারাই এদের দেশে আসতে সহায়তা দেয় বলে অভিযোগ আছে।

ভোটার তালিকা হালনাগাদে অনিয়ম

এবারের ভোটার তালিকা হালনাগাদে অনেক অনিয়মই লক্ষ করা গেছে।

ঢাকার বাইরে এবারের ভোটার তালিকায় আশঙ্কাজনক হারে নারী ভোটার কম হয়েছে। কী কারণে নারী ভোটার কম হয়েছে তা তদন্ত করতে ইসি একটি তদন্ত কমিটি ইতিমধ্যেই গঠন করেছে।

ঢাকা মহানগরীতে তথ্য সংগ্রহের জন্য নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ করা দুই হাজার ৬৪৯ জন তথ্যসংগ্রহকারী ও ৫৩৯ জন সুপারভাইজারকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তথ্য সংগ্রহ করার দায়িত্ব দিলেও তারা বাড়ি বাড়ি যাননি বলে অভিযোগ এসেছে নির্বাচন কমিশনের কাছে। এতে অনেকেরই ভোটার হওয়ার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাদ পড়ে যান। এ ছাড়া নিজের উদ্যোগে তথ্য সংগ্রকারীরদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজের তথ্য দিয়ে এসেছেন অনেক ভোটার।

উল্লেখ্য, সারা দেশে ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার ভোটার ছিল। এবার হালনাগাদ আরো ৪৬ লাখ নতুন ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে ইসির।

(ঢাকাটাইমস/২৫সেপ্টেম্বর/ইরা/এআর/ ঘ.)