আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর প্রথম রায় আসে গত বছরের ২১ জানুয়ারি। রায়ে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য মৃত্যুদ- দেওয়া হয় জামায়াতের সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদকে। এর কয়েক মাস আগ থেকেই পলাতক আযাদ। তার মতো আরও পাঁচজন পালিয়ে আছে দেশ-বিদেশে। যাদের মধ্যে দুইজনকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদ- দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। বাকিদের বিচার চলছে।
বিদেশে পলাতকদের দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যেসব আসামি বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব বা রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছে তাদের শনাক্ত করে ফিরিয়ে আনার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। পলাতকরা কোন দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশে অবস্থান করছে সেই তথ্য জানার চেষ্টা চলছে।
সরকারে উচ্চ পর্যায়ের সূত্র আরও জানায়, রায় ঘোষণার পর থেকেই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা পলাতকদের ওপর নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য ইন্টারপোলসহ আন্তর্জাতিক পুলিশের সহায়তাও চাওয়া হয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকেও এ ব্যাপারে সজাগ করা হয়েছে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যও নির্দেশনা দেওয়া আছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকার বিদেশে পলাতক যুদ্ধাপরাধীদের ফিরিয়ে আনতে অনেক আগ থেকেই জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতেও অনেক আগে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।
বিদেশে পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনতে এ বছরের জানুয়ারির শেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একটি প্রস্তাব পাঠায় মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি মনিটরিং সেলও গঠন করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে পুলিশ সদর দপ্তর, পররাষ্ট্র, আইন মন্ত্রণালয়, এনএসআই, ডিজিএফআই, ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি ও তদন্ত সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এ তদারকি সেল গঠন করা হয়।
সম্প্রতি এই সেলের প্রথম সভা হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত একটি সূত্র জানায়, সভায় পলাতক অপরাধীদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আলোচনা হয়। কীভাবে দ্রুত আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর করা যায় সে ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বাস্তবায়নে স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে মনিটরিং সেলের সভাপতি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক) কামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত এবং বিচারকালে যারা পলাতক রয়েছে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা মনিটরিং সেলের অন্যতম কাজ। এই কাজ চলছে। কাজগুলো দ্রুত শেষ করে আনার জন্য কিছু কর্মকৌশল ঠিক করা হয়েছে।’
কোথায় আছে সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদ- পাওয়া আসামি আবুল কালাম আযাদ পাকিস্তানে লুকিয়ে থাকতে পারেন বলে তথ্য আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র জানায়, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার অবস্থান চিহ্নিত করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেপ্তার করে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ পুলিশ অধিদপ্তরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
১৮ বুদ্ধিজীবীকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদ- পাওয়া আলবদর নেতা চৌধুরী মঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে আছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আছেন একই মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়া আশরাফুজ্জামান খান। এই দুজনই বিদেশে নাগরিকত্ব নিয়েছে। তাদের নাগরিকত্ব বাতিলের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে সোচ্চার কিংবা একাত্তরে স্বজন হারিয়েছেন এমন যারা সংশ্লিষ্ট দেশে আছেন এমন কাউকে দিয়ে মামলা করানোর কথা চিন্তা করছে সরকার।
গত বছর ৩ নভেম্বর মৃত্যুদ-াদেশ দেওয়া হয় মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে। তারা দুজনই মাইনরিটি কমিউনিটির নেতা। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র আরও জানায়, এই দুজনের বিরুদ্ধেই ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি রয়েছে। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের বহিঃসমর্পণ চুক্তি আছে। এর আওতায় তাদের আনার চিন্তা চলছে। যত দ্রুত সম্ভব অপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর করতে সরকার তৎপর আছে।
আরও যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে
সাজা ঘোষণা হয়েছে এমন আসামির পাশাপাশি একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচার চলছে এ রকম অনেকেই গা-ঢাকা দিয়ে আছে। তাদের গতিবিধিও নজরদারির মধ্যে রেখেছে গোয়েন্দা সংস্থা। দেশি এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে নিয়মিত যোগাযোগও রাখছে তারা।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আসামি জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল জব্বারের বিচার চলছে। বিচার চলছে কিশোরগঞ্জের রাজাকার কমান্ডার সৈয়দ মো. হাসান আলীরও। তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছে প্রসিকিউশন। গত ২১ আগস্ট এই অভিযোগ জমা দেওয়া হয়। কিন্তু এই দুইজনও পলাতক।
ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র ও বিএনপি নেতা এম এ জাহিদ হোসেন ওরফে খোকন সুইডেনে লুকিয়ে আছেন বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা। তারা জানায়, সম্প্রতি মনিটরিং সেলের সভায় তাকে নিয়ে আলোচনা হয়। খোকন যেন সুইডেনে রাজনৈতিক আশ্রয় না নিতে পারেন এজন্য ওই দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। খোকনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ করা মামলার কার্যক্রম শেষ। যেকোনো দিন এ ব্যাপারে আসতে পারে ঘোষণা। -ই সময়ের সৌজন্যে