ঢাকা: মুক্তিযোদ্ধা সনদ থাকলে পাওয়া যায় নানা সুযোগ- সুবিধা। তাই যুদ্ধ করেনিÑ এমন মানুষও এই সনদ নিতে আশ্রয় নিয়েছে নানা কৌশলের। এই প্রতারকদের মধ্যে যখন সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নামও ওঠে এসেছে, তখন হতচকিত হয়ে গেছে সরকার। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে ‘প্রতারকদের’দের বের করে দিতে এবার সাঁড়াশি অভিযানে নামছে সরকার।
যতবার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা হয়েছে ততবার বেড়েছে এদের সংখ্যা। সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৯০ জন। নতুন করে আবেদন পড়েছে আরও প্রায় ১ লাখ। এটা মোটেও স্বাভাবিক নয়। তাই নতুন করে সহজে কাউকে সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতার পাশাপাশি পুরনো তালিকার সন্দেহভাজনদের ধরতেও মাঠে নামছে সরকার।
গেজেটভুক্ত ৫০ হাজারেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধার সনদের ব্যাপারে তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ভুয়াদের তালিকা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে উপজেলা পর্যায়েও। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ব্যবহার করে অন্যায় ও অনৈতিক সুবিধা যারা নিয়েছেন তাদের তালিকাও করা হবে।
সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র ঢাকাটাইমসকে জানায়, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবোজ্জ্বল অর্জন নিয়ে কেউ যেন ছিনিমিনি খেলতে না পারে সে জন্য সরকার কঠোর হচ্ছে। এখন থেকে প্রতিটি এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করা হবে। স্থানীয় কমান্ডারদের নেতৃত্বে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে এই তালিকা তৈরি করা হবে। যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা অপর মুক্তিযোদ্ধার ব্যাপারে সাক্ষী দেবেন। এছাড়া শহীদ ও যুদ্ধাহতদের তালিকাও তৈরি করা হবে। সবার সামনেই হবে এই সাক্ষ্যদান প্রক্রিয়া। এতে কারো বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে সুযোগ হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ মিললে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাতিল করা হবে ভুয়া তালিকা।
শুধু সঠিক তালিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না এই কার্যক্রম। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা তৈরির পর এগুলো একাধিকবার যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করবে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। পরে তালিকাগুলো যার যার উপজেলায় দৃশ্যমান জায়গায় টানিয়ে দেওয়া হবে। যে কেউ চাইলেই যেন তার এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে জানতে পারে।
সরকারের এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে সহযোগিতা চেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের কাছে চিঠি দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সই করা ওই চিঠিতে তুলে ধরা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের নানা পদক্ষেপ ও পরিকল্পনার কথা।
জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ কল্যাণের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া তাদের প্রাপ্য মর্যাদা নিশ্চিতের ব্যাপারেও গুরুত্ব দেওয়া আছে। এসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আগামী প্রজন্মকে গড়ে তুলতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’
তদন্ত হবে গেজেটভুক্তদের ব্যাপারেও
দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঠিক কতজন সরাসরি অংশ নিয়েছে তার প্রকৃত তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই। যুদ্ধের সময় ভারতে প্রশিক্ষণের তালিকা, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পত্রিকা লাল মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত তালিকা আর প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর করা তালিকা মিলিয়ে আছে প্রায় দেড় লাখ মুক্তিযোদ্ধা। এছাড়া গেজেটে প্রকাশ হয়ে আরো ৫০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা আছে দেশে। তবে সচিব পর্যায়ে জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ার পর এখন গেজেটে প্রকাশ হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে আরো তদন্ত করবে মন্ত্রণালয়। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৫ বছরের নিচে বয়স ছিল এমন প্রায় ২০০ মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীর ব্যাপারেও তদন্ত হবে।
সরকারি হিসাবে দেশে এখন প্রায় দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা আছে। এছাড়া অনলাইনে আরো লাখের বেশি ব্যক্তি নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে সনদের জন্য আবেদন করেছে। তাদের তালিকা তৈরিও শেষ হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম ওঠানোর সময় শেষ হবে এ মাসেই। আর নভেম্বর মাসের মধ্যে যাচাই বাছাই সম্পন্ন হবে।
জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘সচিবদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ভুয়া প্রমাণের পর গেজেটভুক্ত ৫০ হাজারেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধার সনদের ব্যাপারে আবারও তদন্ত হবে। দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কমিটি এই তদন্তের কাজ করবে। কোনো মুক্তিযোদ্ধা ভুয়া প্রমাণিত হলে শাস্তির ব্যবস্থা করবে মন্ত্রণালয়।’ তিনি জানান, অভিযোগ পাওয়া গেলে লাল মুক্তিবার্তার তালিকায় থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারেও তদন্ত হবে। এছাড়া ২৬ মার্চে যাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে ছিল, এমন ২০০ মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীর ব্যাপারেও তদন্ত করবে সরকার।
জমা পড়েছে আরও এক লাখের বেশি আবেদন
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নতুন করে নাম তোলার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে বর্তমানে এক লাখ দুই হাজার ৫০১টি আবেদনপত্র জমা পড়েছে। এসব আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই করতে এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ঠিক করতে দেশের প্রতিটি উপজেলায় স্থানীয় সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম তোলা যাবে।
চারদলীয় জোট আমলে গেজেট প্রকাশ শুরু
২০০১ সালের নভেম্বরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের পর ২০০৩ সাল থেকে চারদলীয় জোট সরকার গেজেট প্রকাশ শুরু করে। মন্ত্রণালয় গঠনের পর আলাদা দুটি তালিকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সংগ্রহ করা হয়। একটি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট সংরক্ষিত ভারতীয় ভলিউম বুক। এ তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৬৯ হাজার ৮৩৩ জন। এর আগে এরশাদ সরকারের আমলে যে তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছিল তাতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জন। ১৯৯৪ সালে প্রণয়ন করা তালিকায় ৮৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম ছিল।
১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের খসড়া তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা ছিল ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৮০ জন। আবার চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯ জন। তবে ওই সময় গঠিত জাতীয় কমিটির তালিকা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল দুই লাখ দশ হাজার। আর বর্তমানে সরকারের তথ্য মতে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৯০ জন।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ঢাকা জেলা ইউনিটের কমান্ডার মো. আবু সাঈদ মিয়ার দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তছনছ হয়েছে। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা দেশের গৌরব। তারা দেশের অহংকার। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই এর ওপর আঘাত হেনেছে। সরকারের সঙ্গে সঙ্গে তালিকাও পরিবর্তন হয়েছে। অনেক অমুক্তিযোদ্ধা রাজাকার নাম লেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাকে কলুষিত করেছে।’
আবু সাঈদ মিয়া বলেন, ‘যে বা যারাই মুক্তিযোদ্ধাদের অর্জনকে অসম্মান করেছে, তাদের শাস্তির মুখোমুখি দাঁড় করতে হবে। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর এসে এভাবে মুক্তিযুদ্ধকে কলুষিত করার চেষ্টা রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমান। এটা আমাদের জন্য লজ্জারও।’
মানা হচ্ছে না চার মানদ-
মুক্তিযোদ্ধা সনদ পাওয়ার চারটি মানদ- ঠিক করা হয়েছিল। এগুলো হচ্ছেÑ সরকারের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিতে যোগদানের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন অথবা যাদের নাম মুক্তিবার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাদের নাম গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যারা প্রধানমন্ত্রীর সই করা সনদ নিয়েছেন; অথচ নিয়ম না মেনেই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বা সংসদ সদস্যদের সুপারিশ নিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা সনদ।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আরও উদ্যোগ
মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের পরিবারের কল্যাণে আরও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। জাতীয় সম্মাননা পাওয়ার দাবিদার মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভূমিকাসহ তালিকাও তৈরি করা হবে। উপজেলাভিত্তিক যুদ্ধকালীন সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখা, বধ্যভূমি ও মুখোমুখি যুদ্ধের স্থানগুলোর তালিকাও করা হচ্ছে। বিনামূল্যে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং শহীদ, যুদ্ধাহত বা মুক্তিযোদ্ধাদের নামে স্থানীয় রাস্তার নামকরণ করা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে জনমত গঠনের পাশাপাশি ধর্ম ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করার কাজ করছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
এর বাইরে দেশের প্রতিটি স্কুল, মাদ্রাসা ও কিন্ডারগার্টেন স্কুলে জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও জাতীয় পতাকা তোলার ব্যবস্থাও করবে সরকার। ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি দেওয়া হচ্ছে কি না তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণও করা হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের মাধ্যমে আয় ও ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিতের প্রতিও গুরুত্ব দিচ্ছে মন্ত্রণালয়।
(ঢাকাটাইমস/ ২১ অক্টোবর/ এইচএফ/ জেডএ.)