দেশে হঠাৎ ভারতের মতো ধর্ষণ বেড়ে গেছে। প্রতিদিনই অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। বাদ যাচ্ছে না ছোট বাচ্চারাও। গ্রামগঞ্জে, শহরে, রাস্তাঘাটে, ঘরেবাইরে, বাসে-লঞ্চে কোথাও নিরাপদ নয় নারীরা। ঘরে ঢুকে বাবা-মা কিংবা স্বামীকে বেঁধে রেখে ধর্ষণ, রাস্তা আটকিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে পিঠমোড়া বেঁধে ধর্ষণ, বেড়াতে গেলে ফুঁসলিয়ে চকলেট দিয়ে বাচ্চাকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। ধর্ষণের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রতিকারের নেই কোনো উদ্যোগ। বিস্তারিত জানাচ্ছেন বিলকিছি ইরানী
২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে (মানিকগঞ্জ এলাকায়) চলন্ত বাসে এক পোশাককর্মীকে ধর্ষণ করে দুই বাসকর্মী। ধর্ষণের দায়ে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জের একটি আদালত ওই বাসচালক দীপু মিয়া ও হেলপার কাশেম আলীকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেন।
মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরের এক কলেজছাত্রীর সঙ্গে এক মাস আগে পরিচয় হয় রতনলাল ওরফে সুমন নামে ৪০ বছরের এক ব্যক্তির সঙ্গে। কলেজে আসা-যাওয়ার পথেই তাদের পরিচয়। সে হিসেবে মাঝেমধ্যে রতনের সঙ্গে তার কথা হয় ফোনে। কথা বলতে বলতে একসময় রতন পরিচিত হয়ে উঠে। ২৪ অক্টোবর রতন ওই কলেজ ছাত্রীকে ঢাকায় বেড়াতে নিয়ে আসার কথা বলে ধর্ষণ করে।
২৩ অক্টোবর মানিকগঞ্জ সদর উপজেলায় সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর গলায় চাকু ঠেকিয়ে ধর্ষণ করেছে সজিব হোসেন ওরফে সবজেল (৩০)। তবে এলাকাবাসী তাকে আটক করে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে।
এর আগে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় আলম ফকির (৪৫) তার শাশুড়িকে ধর্ষণ করার ঘটনা ঘটে। লজ্জায় ওই মহিলা আত্মহত্যা করেছেন।
১৬ মে কিশোরগঞ্জে ঘুমন্ত মায়ের পাশ থেকে ৪ বছরের শিশু আফরোজাকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শাহআলম (২২) নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
২৯ জুন কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় ৬ বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণ করে রাসেল মিয়া (১৮) নামে এক যুবক। তাকে গত এক জুলাই গ্রেফতারও করা হয়েছে।
এ ধরণের অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা প্রতিদিনই অহরহ ঘটছে বাংলাদেশে। ধর্ষিতা সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হয় এবং বিয়ে হয় না বলে নানা দিক থেকে প্রতিবাদ করেও চুপসে যাচ্ছে অনেকে। কিছু কিছু পরিবার প্রথমে মামলা করলেও হুমকি, লজ্জা ও ভয়ের কারণে থামিয়ে দিচ্ছে তাদের মামলা।
শিশুরা যেমন যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে তেমনি সবচেয়ে বেশি ধর্ষিত হচ্ছে তারাই। প্রথমে যৌন হয়রানি কিংবা কু-প্রস্তাব, পরে ধর্ষণ। বাদ যাচ্ছে না বয়স্করাও। স্কুল-কলেজ-মাদরাসার ছাত্রীরাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। প্রেমিকের কাছে প্রেমিকা, ভাইয়ের কাছে বোন, শ্বশুরের কাছে ছেলের বউ এমনকি বাবার কাছে মেয়েও এখন আর নিরাপদ নয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশের আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া এক তথ্যে জানা গেছে, ধর্ষকদের টার্গেট শিশু ও কিশোরী। অর্থাৎ সাত থেকে ১২ বছরের শিশুরা বেশি ধর্ষিত হচ্ছে। যে বয়সে তারা পুতুল খেলে, ধর্ষণ কী তাও জানে না, বোঝার মনমানসিকতাও গড়ে উঠেনি, সে বয়সেই তাকে ধর্ষিত হতে হচ্ছে।
২০১৩ ও ২০১৪ সালের আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক জরিপে দেখা যায়, গত বছরের তুলনায় এ বছর ধর্ষণের হার কিছুটা কমলেও ধর্ষণজনিত কারণে আত্মহত্যা বেড়েছে। সেই জরিপ থেকে দেখা যায়, ২০১৩ সালে গড়ে প্রতি মাসে ৬৮ জন ধর্ষিত হয়েছিল। আর ২০১৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫১ জনে। তবে এ কমে যাওয়ায় আশ্বস্ত হতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশে ধর্ষণকে শূন্যের কোঠায় সবাই দেখতে চায়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান জানান, ধর্ষণ আগেও ছিল এখনো আছে। আগে গণমাধ্যমে প্রকাশ কম হতো। এখন বেশি হচ্ছে। তাছাড়া লজ্জা ভয় থেকে বেশিরভাগ ধর্ষণের বিষয়ে গোপন করে যায়। তাই আমরা সঠিক হিসাবটা এখনো পাচ্ছি না। তিনি বলেন, এই ক্ষেত্রে অবহেলা বেশি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। মামলা নিতে চায় না। এসব দূর করতে হবে।
আগে থেকে ধর্ষণ কিছুটা কমেছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্যক্রমে হয়ত এখন কম বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু অপরাধ কখনো কমে না। সময়ের সঙ্গে তা বাড়তে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে কম মনে হলেও সচেতনতা বৃদ্ধির অভাবে হয়ত বাড়তে পারে। তবে ধর্ষণ কম বা বেশি সেটা কথা নয়। কথা হচ্ছে ধর্ষণ কেন হবে? নারী কেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে? ধর্ষণের বিরুদ্ধে কাজ করে, আইনকে শক্ত করে ধর্ষণের হার শূন্যের কোঠায় আনতে হবে।
জানা যায়, জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ, মিলিটারি, আর্মি ও র্যাব সদস্য দ্বারাও অনেক নারী ও শিশু ধর্ষিত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইম্যান অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান তানিয়া হক বলেন, ধর্ষণ হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। ইদানীং পত্রিকা খুললেই ধর্ষণের চিত্র চোখে পড়ে। শিশুরা বেশি ধর্ষিত হচ্ছে কারণ তারা বুঝেই না ধর্ষণ কি। তাদের ভয় দেখানো সহজ। এ ব্যপারে শিশুদের বোঝাতে হবে।
ধর্ষণ প্রতিরোধে তিনি বলেন, আমার মতে নি¤œবিত্তরা ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজে বেশি ঝুঁকে পড়ছে। যাদের মধ্যে নেই কোনো নীতি, শিক্ষা কিংবা আইনি কোনো ধারণা। অনেক ক্ষেত্রে তাদের বিনোদনের ক্ষেত্রটাও সীমিত। ফলে বিনোদনের জন্য নারীকে উত্ত্যক্ত করা কিংবা ধর্ষণকেই বেছে নেয়। আমরা এটা তুলে ধরছি যে ধর্ষণ হচ্ছে। কিন্তু কোথায় বেশি হচ্ছে, কোন শ্রেণির লোকেরা ধর্ষণ করছে, এ বিষয়ে দেশে এখনো জরিপ করা হয়নি। এ বিষয়ে জরিপ করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, তাছাড়া সরকারকে আরো শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে। একসময় অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা বেশি ছিল বাংলাদেশে। সরকার ও জনগণের কঠোর পদক্ষেপে তা এখন নেই। সেভাবে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। জনগনকে সোচ্চার হতে হবে।
অনেক সময় ধর্ষিতার পক্ষ থেকে আইনি সহায়তা পেতে হয়রানির শিকার হতে হয়। নানা কটূক্তি ও ভয় প্রদর্শন করা হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকেই। এ বিষয়ে যেসব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা কমিশনাররা তাদের সঠিক দায়িত্ব পালন না করবেন তাদের বহিষ্কার করতে হবে। আইন দ্রুত প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশের ও বিদেশের সংস্কৃতি এক নয়। দেশের মানুষ বিনোদনের জন্য বিভিন্ন চ্যানেলের ওপর নির্ভরশীল। অশ্লীল দৃশ্য সম্বলিত বিদেশি চ্যানেলগুলো নিয়ন্ত্রণে আনার কথা বলেন তিনি।
ধর্ষণের হার
২০১৪ : বিভিন্ন পত্রিকা, মামলা ও অভিযোগের ভিত্তিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র নিবন্ধিত তথ্য থেকে জানা যায়, এ বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার ৪৫৫ জন। শিশু ধর্ষণ ১৩৫। এর মধ্যে ৬ বছরের নিচে রয়েছে ২৩, ১২ বছরের নিচে ৭১ এবং ৪২। ২ শিশু ও ১৮ বছরের নিচে ২৭ জনসহ গণধর্ষণের শিকার ১৬৬ জন। গণধর্ষণে ১৯ জনসহ মারা গেছে ৪৩ জন। মৃতের সংখ্যা ১৮ বছরের নিচে ছিল ১৫ জন। সে সময় লজ্জায় আত্মহত্যা করেছে ১১ জন। এছাড়া ৬ বছরের নিচে শিশুসহ ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৭২ জনকে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে এ বছর মামলা হয়েছে ২৯১টি। তবে অধিকাংশ মামলারই সুরাহা হয়নি বলে জানা যায়।
২০১৩ : গত বছরের জরিপে দেখা যায় ধর্ষণের সংখ্যা ৮১৩। শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ২৬৭। যার মধ্যে ৬ বছরের নিচে বাচ্চা রয়েছে ৫৬টি। ১২ বছরের নিচে রয়েছে ১১৭ এবং ১৮ বছরের নিচে রয়েছে ৯৪। ২ শিশু ও ১৮ বছরের নিচে ৫৮ জনসহ গণধর্ষণের শিকার করা ২৫৬ জন। গণধর্ষণে ৩৩ জনসহ মোট মারা গেছে ৮৭ জন। মৃতের সংখ্যা ১৮ বছরের নিচে ছিল ৪২। সে সময় লজ্জায় আত্মহত্যা করেছে ১৪ জন। এছাড়া ৬ বছরের নিচে শিশুসহ ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১৮৫ জনকে। মামলা হয়েছিল ৫৫৩টি।