ঢাকা: সচি্বালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এসি ল্যান্ডদের বিরুদ্ধে অভিযোগের স্তুপ জমা পড়েছে।এর মধ্যে জেলা প্রশাসকদের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ থেকে বাদ যায়নি বিভাগীয় কমিশনাররাও।
এসব অভিযোগের তদন্তের নামে চলছে টাকার খেলা। জনপ্রশাসনসূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ডিসি, ইউএনও ও সহকারী কমিশনারদের বিরুদ্ধে এ ধরনের শত শত অভিযোগ জমা পড়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ সেলে।
মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র ঘেটে দেখা যায়, মাঠ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগসমূহের মধ্যে উৎকোচ আদায়, প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, তহবিল তছরুপ অন্যতম।
মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নামে শত শত অভিযোগ জমা পড়লেও এসবের বিচার হয় কমই।কিছু অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত হলেও অদৃশ্য কারণে এগুলো হাওয়াও মিলিয়ে যাচ্ছে।অনেক অভিযোগের নিষ্পত্তি হচ্ছে শাস্তি ছাড়াই।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, মাঠ প্রশাসন একটি বিশাল পরিবার। তবে কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলে তা তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সচিব আরও বলেন, অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণিত হয় না। অনেক সত্য ঘটনাও উপযুক্ত সাক্ষীর অভাবে তদন্ত করা সম্ভব হয় না। তবে প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী আত্মসাৎ কিংবা দুর্নীতি করবেন অথচ তাদের শাস্তি হবে না, এমনটি ভাবা ঠিক নয়।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শৃংখলা শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আসে, তার বেশির ভাগেরই সত্যতা পাওয়া যায় না। এমনও দেখা যায়, অনেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অভিযোগ পাঠায়। এগুলো বিবেচনায় নিলে কর্মকর্তারা সাহস নিয়ে কাজ করতে পারবেন না। তবে কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিচার না হওয়ায় প্রশাসনে দুর্নীতি বেড়ে গেছে। কোনো অফিসে কাজের জন্য গেলে ঊর্ধ্বতন কর্তার অজুহাত দিয়ে দিনের পর দিন ফাইল আটকে রাখা হয়।আবার ওই অফিসের কর্তার সঙ্গে গোপনে দেখা করে তাকে খুশি করলে দিনে দিনে ফাইল নিষ্পত্তি হয়। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রতি নির্দেশ আছে, সপ্তাহে অন্তত একদিন জনগণের ভোগান্তির কথা শুনতে হবে। এ নির্দেশনা কখনও প্রতিপালন হয় না।
সূত্র জানায়, গত এক বছরে বেশির ভাগ অভিযোগ এসেছে ডিসি, ইউএনও ও সহকারী কমিশনারের (ভুমি)বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের বেশির ভাগই দুর্নীতি ও অনিয়ম এবং সরকারি অর্থ আত্মসাতের।
খুলনা জেলা প্রশাসক আনিস মাহমুদের বিরুদ্ধে জনপ্রশাসনের প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরার কাছে একগাদা লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন এলাকাবাসী ।খুলনা আসার আগে নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় এনজিও মহিলাদের সাথে তাঁর অপকর্মের জড়িয়ে পড়ার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে নেত্রকোনায় নানা মুখরোচক কথা চালু রয়েছে।
এছাড়া মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভুমি) রমেন্দ্র নাথ বিশ্বাসের বিরুদ্ধেও অভিযোগের অন্ত নেই।ভুমি অফিসে রেকর্ড হালনাগাত করতে গিয়ে তার বিরুদ্ধে লাখ লাখ ঘুষ নেয়ার লিখিত অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া বগুড়া জেলার শাজাহানপুর উপজেলার নির্বাহী অফিসার মো. আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ জমা পড়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে।অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়।তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় রাজশাহীর অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক)মুহাম্মদ মুনির হোসেনকে। দীর্ঘ তদন্তের পর কমিটি অর্থ লেনদেনের প্রমাণও পায়। তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার নির্বাহী অফিসার সাজেদুর রহমানের বিরুদ্ধেও অভিযোগের অন্ত নেই। এর আগে তিনি খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসাবে কাজ করেন।তুলসী বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তির জমির খতিয়ান খুলে দেওয়ার নাম করে তার কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেন।অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় খুলনার অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার রফিকুল ইসলামকে। অধিকতর তদন্ত করেন সাবেক বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল জলিল। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। পরে লঘুদণ্ড দিয়ে তাকে বদলি করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মহালছড়ির উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু সাহেদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটিও গঠিত হয় এবং তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ ফরহাদ হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন এলাকার এমপি শিবলী সাদিক। তার অভিযোগ, ইউএনও নৈশপ্রহরী নিয়োগ দিয়ে দেড় কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন।অভিযোগের প্রমাণাদি সংযুক্ত করে একটি ডিও লেটারও প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে জমা দিয়েছেন ওই এমপি। এর পরও ওই ইউএনওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সর্বশেষ এ নিয়ে ওই এলাকায় ইউএনওর লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
ঠাকুরগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সালেহ মো. ওবায়েদ উল্লাহর বিরুদ্ধে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি কাম নৈশপ্রহরী নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ফেব্রুয়ারিতে ওই এলাকার মো. আবদুস ছালাম, খোকন বর্মণ, মো. মামুন সরকার, মো. আবাইদুল ইসলাম, বাঁধন অধিকারী ও মো. আমিনুল ইসলাম লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। তাদের অভিযোগ, লিখিত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া প্রার্থীদের বাদ দিয়ে কম নম্বর পাওয়া প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্যের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তিনি এসব অপকর্ম করেছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
মুলাদী উপজেলার সাবেক নির্বাহী অফিসার মো. মোস্তাফিজুর রহমান চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলায় সহকারী কমিশনার ভুমি থাকা অবস্থায় মো. রাসেল নামের এক ব্যক্তিকে ভূমি অফিসে চাকরি দেওয়ার নাম করে তার কাছ থেকে চার লাখ টাকা ঘুষ নেন। সরকারী কমিশনার ভূমিকে ঘুষ দেওয়ার সময় নূর মোহাম্মদ ও মো. মুজিবুর রহমান নামের দুই ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখেন রাসেল। সহকারি কমিশনার ভুমি সোনালী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে রাসেল টাকা জমা দেন। পরে ওই সহকারী কমিশনার ভুমিকে শুধু বদলি করা হয়। লিটন প্রতিকার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ ও জনপ্রশাসন সচিবের দপ্তরে আবেদন করেন।
এছাড়া রাউজান উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়েছে তিনি প্রতিমা পুজামন্ডপের বরাদ্দের টাকা বিতরণ না করে নিজেই আত্নসাত করেছেন বলে স্থানীয় বাসিন্দার নীহার রঞ্জন দত্ত লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে শুনানির ব্যবস্থা করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। শুনানি শেষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে রায় দেওয়া হবে। এ বিধিমালা অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে চাকরি থেকে বরখাস্ত করারও বিধান রয়েছে। তবে বরখাস্ত করার নজির তেমন একটা নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খানক বলেন, কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে তার বিচার না হওয়ার পেছনে রয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনীহা ও অবহেলা। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তার তদন্তের দায়িত্ব বর্তায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ওপর। ওই কর্মকর্তা ইচ্ছা করেই তার অধীন কর্মকর্তার অভিযোগ আমলে নিতে চান না। তিনি বলেন, কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে তদন্ত করা যেতে পারে। তাহলে সঠিক তদন্ত ও বিচার হতে পারে।
স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ গুলো তদন্ত করা যায় কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা বার্তা চলছে।
(ঢাকাটাইমস/০৩ নভেম্বর/এইচআর/এআর)