logo ২৯ এপ্রিল ২০২৫
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি অমীমাংসিত প্রশ্ন
১৮ ডিসেম্বর, ২০১৪ ১২:২০:২৮
image


মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত? এক অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়ে গেছে বাংলাদেশে। যতবার তালিকা করা হয়েছে ততবারই বেড়েছে সংখ্যা। কীভাবে বাড়ল, জানে না মুক্তিযুদ্ধের সমর-নায়কেরাও। অথচ ‘মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধকৌশল ও সামরিক শক্তিবিন্যাস’ নামে যুদ্ধ পরিকল্পনা বিবেচনায় আনলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা কঠিন কিছু নয়। লিখেছেন

আল ফারুক ও হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

যুদ্ধ করে পৃথিবীতে স্বাধীন হয়েছে কয়টা দেশ? সংখ্যাটা বেশি নয় মোটেও। তবে এর একটি যখন বাংলাদেশ, তখন বিশ্বের বুকে এ দেশটি কেন আলাদা হবে, কেন বীরের এলাকা বলে এর পরিচিতি হবে না, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই বীরত্ব, এই গর্ব ধূলিসাৎ হওয়ার দশা হয়েছে কিছু মানুষের অপকর্মের জন্য। যুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিতে গিয়ে যে ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা এ দেশে ঘটেছে, তাতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদেরই মাথানত হওয়ার দশা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছু না করে হাত গুটিয়ে বসেছিলেন বা পাকিস্তানের হয়ে চাকরি করেছেন এমনকি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিলেন, এমন লোকও ’৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে পুরো বিষয়টিকে কলুষিত করেছেন।

মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত? এটা যেন বাংলাদেশের এক চির অমীমাংসিত প্রশ্ন। যতবার তালিকা করা হয়েছে ততবার বলা    হয়েছে, ‘সর্বোচ্চ সঠিক’ তালিকা করা হবে। ততবার বেড়েছে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা। এমনকি চার দশক পরও তালিকা করতে গিয়ে সরকার নতুন করে আবেদন পেয়েছে এক লাখ ৩৩ হাজারটি। তার মানে এরা যুদ্ধ করেছেন কিন্তু কখনও তালিকায় নাম লেখাননি ও সনদ নেননি। আর চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সবশেষ করা তালিকা অনুযায়ী দেশে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখ ১০ হাজারের বেশি।

দেশে এখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ? এর মধ্যে অনেকেই তালিকাভূক্ত হননি। গত চার দশকে যারা মারা গেছেন তাদেরসহ সব মিলিয়ে এই সংখ্যা চার লাখ ছাড়িয়ে যাবে। আসলে কি এত মানুষ যুদ্ধ করেছে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য?

মুক্তিযুদ্ধের সমরনায়কদের সংগঠন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের একটি হিসাব বিবেচনায় নিলে সাড়ে তিন লাখ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাটি মনে হবে অবিশ্বাস্য। ২০১০ সালে ফোরাম ‘মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধকৌশল ও সামরিক শক্তিবিন্যাস’ শিরোনামে একটি নথি প্রকাশ করে। এতে মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত সেক্টর ও তার অধীনে বিভিন্ন বাহিনীর সংখ্যা প্রকাশ করা হয়। সেক্টর কমান্ডারদের এই হিসাব অনুযায়ী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এক লাখ ৬২ হাজারের বেশি নয়।

এরশাদের শাসনামলে বাংলাদেশে প্রথম মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন তালিকায় নাম ওঠে এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জনের। তবে সে সময় প্রচারের অভাব আর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সে রকম উদ্দীপনা না থাকায় সবাই তালিকাভুক্ত হতে পারেননি বলে ধরা হয়। অবশ্য সে সময়ও ভুয়া নাম তালিকাভুক্তির অভিযোগ ওঠে।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা প্রকাশ করে যেখানে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল এক লাখ ৫৪ হাজারের কিছু বেশি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে গঠিত জাতীয় কমিটির অনুমোদিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল দুই লাখ ১০ হাজার ৫৮১ জন। এভাবেই যতবার তালিকা হয়েছে ততবার বেড়েছে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা।

সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম জানিয়েছে, ১৯৭১ সালে প্রবাসী সরকার গঠিত হওয়ার পর কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা নির্ধারণে ১১ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত একটি কর্মশালা হয়। এতে গোটা দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে পরিকল্পনা ঠিক করা হয়। এই সেক্টরগুলোতে সেক্টর বাহিনীর (সেনা, নৌ, বিমান, ইপিআর, পুলিশ) মোট সদস্য করার পরিকল্পনা করা হয় ১৮ হাজারের কিছু বেশি। আর গেরিলা সদস্য নিয়োগের পরিকল্পনা করা হয় মোট এক লাখ ৪৩ হাজার।

মুক্তিযুদ্ধের ৩নং সেক্টরের কমান্ডার, এস ফোর্সের প্রধান ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ মনে করেন, প্রকৃত সংখ্যাটা এর চেয়ে কয়েক হাজার কম হবে। কারণ প্রতিটি বাহিনীতে যে সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছিল প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে কম ছিল। তার ধারণা, ১১টি সেক্টরের অধীনে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দেড় লাখের বেশি হবে না।

অবশ্য সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের এই হিসাবের বাইরেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয় ছিল বেশ কয়টি বাহিনী। যেমন টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী, ফরিদপুর-বরিশাল, খুলনা-যশোর অঞ্চলে হেমায়েত বাহিনীর মতো আরও কিছু বাহিনী সক্রিয় ছিল যাদের সম্মিলিত যোদ্ধা ছিল ২০ থেকে ৩০ হাজার। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট সক্রিয় হয় মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে। বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করেছে ছোট ছোট আরও কিছু বাহিনী যাদের সংখ্যা আনুমানিক ১০ হাজার। এর বাইরে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ এবং ছাত্র ইউনিয়নের আরেকটি গেরিলা বাহিনী প্রশিক্ষণ নিয়েছিল।

এই বাহিনীগুলো বিবেচনায় নিলেও মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখ ছাড়ানোর সুযোগ নেই বলে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতিরা। এর মধ্যে যাদের বয়স তখন ৩০ থেকে ৪০-এর মধ্যে ছিল তাদের একটি বড় অংশই গত চার দশকে পৃথিবী ছেড়েছেন। তাই এখন সংখ্যা দেড় লাখের কম হওয়াই স্বাভাবিক বলে ধারণা তাদের। অথচ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সবশেষ হিসাব অনুযায়ী এখন দেশে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখের বেশি। এর ওপর এক লাখ ৩৩ হাজার নতুন তালিকাভুক্ত হলে তা দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে তিন লাখ।

সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহ মনে করেন, এত মুক্তিযোদ্ধা থাকা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। তিনি জানান, যুদ্ধের পর সেক্টর কমান্ডাররা নিজ নিজ বাহিনীর সদস্যদের সনদ দিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে এই সংখ্যা ছিল এক লাখ ২৮ হাজার থেকে এক লাখ ৩২ হাজারের কিছু বেশি। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৪৩ বছরে অনেক মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছেন। তাই বছর বছর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বৃদ্ধির হিসাব গ্রহণযোগ্য নয়।

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আমীন আহমদ চৌধুরীও বলেছেন একই ধরনের কথা। তিনি জানান, ভারতের ৮২টি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে মোট এক লাখ ৩২ হাজার এফ এফ (ফ্রিডম ফাইটার) প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। আর সামরিক বাহিনীর যোদ্ধা ছিল ১৭ হাজারের কিছু বেশি। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধরত বিভিন্ন বাহিনীর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি হবে না।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তাদের সবাই ফরম পূরণ করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এই তালিকা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয়। ১৯৮৩ সালে এই ফরমগুলোর আলোকে একটি তালিকা করার উদ্যোগ নেন আমীন আহমদ চৌধুরী। সে সময় ৬৯ হাজার ৫০৯টি ফরম থেকে তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়। বাকিগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সেগুলো থেকে তথ্য বের করা সম্ভব হয়নি।

গোড়ায় গলদ

মুক্তিযুদ্ধের পর পর তালিকা করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ নিয়ে কখনো বিতর্ক হবে তা নিয়ে ভাবেনি কেউ। তখন প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানীর প্রতিস্বাক্ষর করা সনদ তৎকালীন জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে জেলায় জেলায় পাঠিয়ে দেওয়া হতো। সনদ দেওয়ার সময় নাম-ঠিকানা বসিয়ে দেওয়া হতো। এই সনদ বিতরণের ক্ষেত্রে সে সময় নানা অনিয়ম হয়েছে। যুদ্ধ না করেও রাজনৈতিক যোগাযোগের কারণে সে সময় সনদ নিয়ে গেছেন অনেকে। সে সময় তিন লাখের বেশি সনদ বিতরণ হয়। কিন্তু তখনও মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো তালিকা করা হয়নি।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করার পর প্রথম তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সময় যারা আবেদন করেছেন তাদের সবাইকেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই তালিকায় এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জনের নাম ওঠে। তবে সামরিক সরকারের অধীনে তালিকা করতে অনেক মুক্তিযোদ্ধাই তখন আবেদন করেননি।

১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকারের আমলে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) তৎকালীন মহাপরিচালক আ জ ম আমিনুল হককে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের আহ্বায়ক করা হয়। তিনি সংসদ নির্বাচনের জন্য একটি ভোটার তালিকা করেন। বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা সে তালিকায় নাম তোলেননি। ওই তালিকায় নাম ছিল ৮৮ হাজার।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম জাতীয়ভাবে যাচাই-বাছাই করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করে এক লাখ ৮৬ হাজার ৭৯০ জনকে নির্বাচন করা হয়। আরেক দফা যাচাই-বাছাইয়ের পর এক লাখ ৫৪ হাজারের কিছু বেশি মুক্তিযোদ্ধার একটি তালিকা প্রকাশ করা হয় যা মুক্তিবার্তা নামে পরিচিত। এ তালিকাটিকেই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কম বিতর্কিত বলে মনে করা হয়।

তবে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আরেকটি তালিকা করা হয়। সে সময় সিদ্ধান্ত হয়, এরশাদের জাতীয় তালিকা, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তালিকা, ১৯৯৩ সালের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভোটার তালিকা ও মুক্তিবার্তার মধ্যে দুই জায়গায় যার নাম পাওয়া যাবে তাকেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ধরা হবে। এই প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে এক লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯ জনে দাঁড়ায়। তবে এই নীতিমালার বাইরেও আরও অনেকের নাম ঢুকানো হয়। ওই সরকারের আমলে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লাখ ১০ হাজার ৫৮১ জন। এই তালিকায় স্বাধীনতাবিরোধী এমনকি পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা অনেকের নামও তোলা হয়। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর জেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের নামও পাওয়া যায় সেখানে।

২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের কাছে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম তালিকাভুক্তির জন্য আরও ৬০ হাজার আবেদন জমা পড়ে। এই শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর পর নতুন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। আর আলোচিত হয়ে ওঠে সচিব পর্যায়ে ভুয়া নাম তালিকাভুক্তি। এ নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখির পর দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তেও প্রমাণ পাওয়া যায় পাঁচ সচিবের কেলেঙ্কারির কথা। এমনকি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক সচিবও এই কাজ করেছেন। এই বিতর্কে এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন এক সচিব। আরও তদন্ত চলছে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে।

কাঠগড়ায় সরকারি কর্মকর্তারা

চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা দেননি রাজউকের চেয়ারম্যান জি এম জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া। চাকরির শেষ জীবনে এসে অবশ্য মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন। ২০১৩ সালে শেষ হয়েছে চাকরির মেয়াদ। তবে মুক্তিযোদ্ধা সনদের জোরে চাকরি করেছেন গত ৫ এপ্রিল পর্যন্ত। এখন রাজউকের চেয়ারম্যান হয়েছেন এক বছরের চুক্তিতে। তার মতো এমন অনেক ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা আছেন, যারা চাকরিতে ঢোকার সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলেননি। অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়স দুই বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পর ঠিকই জুটিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা সনদ। এই সুযোগে যারা মুক্তিযোদ্ধা নন তারাও চেয়েছেন সুবিধা নিতে। সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী, স্বাস্থ্যসচিব এম এম নিয়াজউদ্দিন, পিএসসি সচিব এ কে এম আমির হোসেন এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব আবুল কাশেম তালুকদারের মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে। এই অপরাধে কাউকে বাধ্যতামূলক আবার কেউ ‘স্বেচ্ছায়’ সরে গেছেন চাকরি থেকে। এদের বাইরে এখনও প্রশাসনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আছেন, যাদের মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে প্রশ্ন আছে। জবাবে জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়ার সোজাসাপ্টা কথা, ‘চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় প্রয়োজন হয়নি; এখন হয়েছে তাই নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা দিয়েছি।’

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. সা’দত হুসাইনের দৃষ্টিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পরপরই এ নিয়ে হরিলুট শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, ‘নিজেদের স্বার্থ হাসিলে মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করেছেন অনেকে। এটা গর্হিত অপরাধ। দেশের মহান এই অর্জনকে যারা ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার করে নিয়েছেন, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।’

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার এ বিষয়ে বলেন, ‘ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি যেভাবে পেরেছে সেভাবেই রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে কাটাছেঁড়া দুঃখজনক।  এখন  যাদের  বিরুদ্ধে  সনদ জালিয়াতির প্রমাণ মিলবে তাদের কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে।’

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের মহাসচিব (প্রশাসন)  এমদাদ হোসেন মতিন বলেন, ‘কারো মুক্তিযোদ্ধা সনদের ব্যাপারে অভিযোগ পাওয়া গেলে আমরা তা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলকে জানাই। তারা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।’

যে কারণে সরকারি কর্মকর্তাদের সনদ নেওয়ার পাল্লা

সাধারণ মানুষের চেয়ে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাই মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতিতে জড়িয়েছেন বেশি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে হাতিয়ে নিয়েছেন সনদ। কেউ সনদের জোরে সুবিধা ভোগ করেছেন। আবার কেউ সুবিধা নেওয়ার আগেই ধরা পড়েছেন।  

২০১০ সালের ৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন অথবা যাদের নাম মুক্তিবার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাদের নাম গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যারা প্রধানমন্ত্রীর সই করা সনদ নিয়েছেন, তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাড়তি এক বছর চাকরি করার সুযোগ পাবেন।

২০১১ সালের ৬ মার্চ একই ধরনের আরেকটি চিঠি জারি করা হয়। এরপরও মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে দুটি আদেশ জারি করে। গত ৪ আগস্ট জারি করা আদেশে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা চাকরিতে প্রবেশের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন এবং মুক্তিযোদ্ধা সনদ রয়েছে জানালে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুবিধা পাবেন।

এরপর জনপ্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে জানান, এই প্রজ্ঞাপনের ফলে মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। পরে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, চাকরি গ্রহণকালে ও পরবর্তী সময়ে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেদের ঘোষণা দেননি বা মুক্তিযোদ্ধার কোটায় চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ নেননি, তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাড়তি সুবিধা দেওয়া হবে কি না, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা প্রয়োজন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১১ সেপ্টেম্বর নিজের হাতে ওই সারসংক্ষেপের ওপর লেখেন, ‘যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তারা যে অবস্থায়ই হোক, সুবিধা পাবেন।’ ওই সারসংক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ১ অক্টোবর জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নির্দেশনা উল্লেখ করে বলেছে, এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জারি করা ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর এবং ২০১১ সালের ৬ মার্চ জারি করা চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীর নির্ণায়ক হিসেবে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা অনুসরণ করতে হবে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধা কর্মচারীদের চাকরির বয়সসীমা প্রথমে দুই বছর ও পরে এক বছর বাড়িয়ে দেয়। এরপরই পাল্লা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়া শুরু হয়।

যাচাই-বাছাই চলছে ৫০ হাজারের বেশি নাম

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়, চারদলীয় জোট সরকারের আমলের করা তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা হঠাৎ লাফ দেওয়ার পরপরই এই তালিকা নিয়ে বিতর্ক ওঠে। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই তালিকার ৫২ হাজার ২৫০ জনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ আসে মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু সব নাম যাচাই-বাছাই সম্ভব হয়নি এতদিনেও।

সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবোজ্জ্বল অর্জন নিয়ে কেউ যেন ছিনিমিনি খেলতে না পারে সে জন্য সরকার কঠোর হচ্ছে। এখন থেকে প্রতিটি এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করা হবে। স্থানীয় কমান্ডারদের নেতৃত্বে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে এই তালিকা তৈরি করা হবে। যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই অপর মুক্তিযোদ্ধার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবেন।  এছাড়া  শহীদ  ও  যুদ্ধাহতদের   তালিকাও তৈরি করা হবে। সবার সামনেই হবে এই সাক্ষ্যদান প্রক্রিয়া। এতে কারো বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে সুযোগ হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ মিললে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাতিল করা হবে ভুয়া তালিকা।

শুধু সঠিক তালিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না এই কার্যক্রম। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা তৈরির পর এগুলো একাধিকবার যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করবে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। পরে তালিকাগুলো যার যার উপজেলায় দৃশ্যমান জায়গায় টাঙিয়ে দেওয়া হবে। যে কেউ চাইলেই যেন তার এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে জানতে পারে।

সরকারের এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে সহযোগিতা চেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের কাছে চিঠি দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সই করা ওই চিঠিতে তুলে ধরা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের নানা পদক্ষেপ ও পরিকল্পনার কথা।

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কমিটি এই তদন্তের কাজ করবে। কোনো মুক্তিযোদ্ধা ভুয়া প্রমাণিত হলে শাস্তির ব্যবস্থা করবে মন্ত্রণালয়।’ তিনি জানান, অভিযোগ পাওয়া গেলে লাল মুক্তিবার্তার তালিকায় থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারেও তদন্ত হবে। এছাড়া ২৬ মার্চ যাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে ছিল, এমন ২০০ মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীর ব্যাপারেও তদন্ত করবে সরকার।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ঢাকা জেলা ইউনিটের কমান্ডার আবু সাঈদ মিয়া বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা দেশের গৌরব। তারা দেশের অহংকার। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে শক্তি যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই এর ওপর আঘাত হেনেছে। সরকারের সঙ্গে সঙ্গে তালিকাও পরিবর্তন হয়েছে। অনেক অমুক্তিযোদ্ধা রাজাকার নাম লেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাকে কলুষিত করেছে। এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমান। আমাদের জন্য লজ্জারও।’

নতুন আবেদন এক লাখ ৩৩ হাজার

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য এক লাখ ৩৩ হাজার নতুন আবেদন জমা পড়েছে। এসব আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য উপজেলা পর্যায়ে পাঠানোর কাজ শুরু হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য আবেদন করার শেষ তারিখ ছিল গত ৩১ অক্টোবর। এর মধ্যে অনলাইনে আবেদন জমা পড়েছে এক লাখ ২৩ হাজার। সরাসরি জমা পড়েছে ১৩ হাজার আবেদন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য আবেদনকারীদের অধিকাংশই নতুন হলেও কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন, যারা এর আগে কোনো না কোনো সময় গেজেটভুক্ত হয়েছেন।

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) গত সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত ২৪তম সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে একাত্তরের ট্রেনিং ক্যাম্পে  প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের ভারতীয় তালিকা, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের লাল মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত তালিকা ও প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরিত সনদ ছাড়া অন্য সব গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সনদের সত্যতা প্রমাণের জন্য উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটির মুখোমুখি হতে হবে।

এছাড়া ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর সদস্যরাও   তালিকাভুক্তির   জন্য   এবারপ্রত্যেকে আলাদাভাবে আবেদন করেছেন। এর আগে দলগতভাবে আবেদন করায় তাদের আবেদন বাতিল হয়ে গিয়েছিল।

জামুকার মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব শ্যামাপদ দে জানিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য যেসব আবেদন জমা পড়েছে সেগুলো যাচাই-বছাইয়ের জন্য উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছানো হয়েছে। একই সঙ্গে উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটিও গঠিত হয়েছে।

গত ১৩ অক্টোবর জামুকার সভায় মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য ন্যূনতম বয়স ১৫ বছর নির্ধারণ করা হলেও এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ায় তা প্রজ্ঞাপন হিসেবে এখনও জারি হয়নি।

আবেদন যাচাই-বাছাই করতে ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিরূপণে ১৪ সেপ্টেম্বর জামুকার সভায় প্রতি উপজেলায় স্থানীয় সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সাত সদস্যের এ কমিটির প্রধান হবেন সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য। তাকে অবশ্যই বীর মুক্তিযোদ্ধা হতে হবে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা না হলে সে ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে ইতিপূর্বের যেকোনো মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সদস্য সভাপতি হবেন। তা পাওয়া না গেলে সে ক্ষেত্রে যুদ্ধকালীন কমান্ডার কমিটির সভাপতি হবেন। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের একজন প্রতিনিধি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিটের জেলা কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ উপজেলা ইউনিটের উপজেলা কমান্ডার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মনোনীত একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি, বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত জামুকার সদস্য কর্তৃক মনোনীত একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি এবং সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। এরই মধ্যে সাত সদস্যের এই কমিটি বিভিন্ন উপজেলায় কাজ শুরু করেছেন। যারা উপজেলা পর্যায়ের সাত সদস্যের যাচাই-বাছাই কমিটির অনুমোদন পাবেন, তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত হবেন। পাবেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ সব সুযোগ-সুবিধা। যাচাই-বাছাইয়ের পর চলতি বছরের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধার চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের অভিযোগ, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির হাত ধরেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ছয়-নয় শুরু হয়েছে। তিনি এই সময়কে বলেন, ‘কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত হবে। যদি ভুয়া প্রমাণিত হয় তাহলে অবশ্যই তাকে শাস্তি পেতে হবে।’ তিনি দাবি করেন, নতুন করে যারা মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য আবেদন করেছেন তাদের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করে সনদ দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় উপজেলা কমান্ড কাউন্সিলের মতামতকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। তারা স্থানীয়দের সামনে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই করবেন।’

তদন্ত হবে গেজেটভুক্তদের ব্যাপারেও

দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ঠিক কতজন সরাসরি অংশ নিয়েছেন তার প্রকৃত তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই। যুদ্ধের সময় ভারতে প্রশিক্ষণের তালিকা, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পত্রিকা লাল মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত তালিকা আর প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর করা তালিকা মিলিয়ে আছে প্রায় দেড় লাখ মুক্তিযোদ্ধা। এছাড়া গেজেটে প্রকাশিত আরো পঞ্চাশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা আছে দেশে। তবে, সচিব পর্যায়ে জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ার পর এখন গেজেটে প্রকাশ হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে আরো তদন্ত করবে মন্ত্রণালয়। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৫ বছরের নিচে বয়স ছিল এমন প্রায় ২০০ মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীর ব্যাপারেও তদন্ত হবে।

মানা হচ্ছে না চার মানদন্ড

মুক্তিযোদ্ধা সনদ পাওয়ার চারটি মানদ- ঠিক করা হয়েছিল। এগুলো হচ্ছেÑ সরকারের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিতে যোগদানের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন অথবা যাদের নাম মুক্তিবার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাদের নাম গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যারা প্রধানমন্ত্রীর সই করা সনদ নিয়েছেন। অথচ নিয়ম না মেনেই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বা সংসদ সদস্যদের সুপারিশ নিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা সনদ।

সুযোগ-সুবিধার কারণেই সনদ জালিয়াতি?

সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের বেশকিছু সুযোগ সুবিধা দেয়। যেমন মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি হাসপাতালে সব রকম স্বাস্থ্য পরীক্ষা বিনামূল্যে করাতে পারেন। ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধা রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড আছে। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি ও আসনের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা সরকারের নির্দেশনায় বলা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। পাশাপাশি সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সংস্থায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরির পদ সংরক্ষণ করা আছে। এ ছাড়া দুস্থ মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল থেকে চিকিৎসা, সন্তানদের লেখাপড়া ও মেয়ের বিয়ের জন্য আবেদনসাপেক্ষে অনুদানও পান। এসব কারণেও নাম অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে আগ্রহ বাড়ছে বলে জানান কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যসচিব এমদাদ হোসেন।

সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের চেয়ারম্যান কে এম সফিউল্লাহ বলেন, ‘বিনিময় পাওয়ার জন্য তো মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে নেননি। চাওয়া ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। এখন যদি রাষ্ট্র চিরসম্মানিত মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে কিছু করে তা নিয়ে জালিয়াতি করার কী আছে? কেন অন্যায়ভাবে সনদ নিয়ে সুবিধা ভোগের জন্য মুক্তিযোদ্ধা সাজতে হবে? এতটুকু নৈতিকতা তো আমাদের থাকা উচিত। তা না হলে দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পালন করবেন কারা?’- সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।