ঢাকা: যাবেন?
“কই?
নৌবাহিনীর সদর দপ্তর।
যামু, ভাড়া লাগবো সাড়ে তিন শ টাকা।
মগবাজার থেকে নৌবাহিনীর সদর দপ্তর সাড়ে তিন শ টাকা?
রাস্তায় অনেক জ্যাম। তারপর ওই খান থাইক্যা আইতে হইবো খাইল্যা। তিন শ টাকা হইলে যাইতে পারবেন।
বলেই সিএনজি অটোরিকশাটি চালিয়ে কিছুদূর সামনে চলে গেলেন চালক। ওইদিকে যাত্রী আরিফুল ইসলাম মিঠুও ছুটলেন তার পিছু পিছু। রাস্তায় গাড়ি কম। সিএনজি অটোরিকশাও খুব একটা খালি মিলছে না। তাই বাধ্য হয়ে ফের চালকের মনজয়ের চেষ্টা।
আড়াই শ টাকায় যাবেন?
আর দশ টাকা বাড়ায়া দিয়েন।
উপায় নেই। চালকের কথায় রাজি হয়ে সিএনজিতে চড়ে বসলেন মিঠু।
মগবাজার থেকে সোজাপথে বনানীতে নৌবাহিনীর সদর দপ্তর পর্যন্ত বরজোড় হবে ৯ কিলোমিটার। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ঠিক করে দেওয়া ভাড়া অনুযায়ী এই পথ যেতে সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া হওয়ার কথা ছিল ৭৮ টাকা ৪৮ পয়সা। অথচ এই পথটুকু যেতে মিঠুকে বেশি গুনতে হয়েছে ১৮১ টাকা ৫২ পয়সা। এ চিত্র পুরো রাজধানীতেই। সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া আদায়ে লাগামহীন নৈরাজ্য চলছে। যে যেভাবে পারছে সেভাবেই যাত্রীকে জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। দিনের বেলায় যেমন তেমন, রাত হলে সেই মিটারের চেয়ে চারগুণ বেশি ভাড়া গুনতে হয় হরহামেশাই।
ঢাকায় এমনিতেই গণপরিবহনগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল হওয়ায় উপচেপড়া ভিড় লেগে থাকে বাসগুলোতে। যারা একটু তাড়াতাড়ি কিছুটা স্বস্তিতে গন্তব্যে পৌঁছতে চান তাদের পছন্দ সিএনজিচালিত অটোরিকশা। কিন্তু এখানে যেভাবে যাচ্ছেতাই ভাড়া আদায় হচ্ছে, তাতে রাজধানীতে চলাচল যেন দায় হয়েছে নগরবাসীর।
‘এগুলো দেখার কী কেউ নেই? এত এত দুর্নীতি, অনিয়ম নিয়ে সোচ্চার সবাই, এটা কি কোনো দুর্নীতি নয়? সিএনজি অটোরিকশাচালকরা দিনের পর দিন আইনকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে, আর সবাই চোখ বুঝে আছে?’ আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বেসরকারি একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম। প্রতিদিন মহাখালী থেকে মতিঝিল গিয়ে অফিস করেন এই কর্মকর্তা। প্রায় সময়ই সিএনজি অটোরিকশায় করে যান। আর প্রতিদিনই চালকের সঙ্গে বাকবিত-ায় মেজাজের বারোটা বাজিয়ে অফিসে পৌঁছান। দিনের শুরুর অর্ধেকটাই কাটে চরম বিরক্তিতে।
এভাবে চলছে দিনের পর দিন। কিন্তু ব্যবস্থা নেয় না পুলিশ। শুরুর দিকে এবং মাঝেমধ্যে জরিমানা করা শুরু হলেও এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে তারা। একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, ‘ভাই, আসলে কিছু করার নেই। আমরা সবই জানি।’
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থাপনায় যে ধরনের নৈরাজ্য চলছে তা ধীরে ধীরে শক্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করে কখনও সমাধান পায়নি। ট্রাফিক পুলিশের চোখের সামনেই চালকরা যাত্রীদের প্রতিনিয়তই ঠকাচ্ছে। অভিযোগ করেও লাভ নেই, নিরুপায় যাত্রীরা তাই মুখ বুজে, কেউ বা চালকের সঙ্গে ঝগড়া-ঝাটি করেই ক্ষ্যান্ত হন।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলামের মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর হতে হবে। আইন আছে এর প্রয়োগ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘দুর্ভোগের কথা বলে আর কী হবে। যাদের এসব বিষয়ে সোচ্চার হওয়ার কথা তারাই তো চুপ হয়ে আছেন। সাধারণ মানুষ তো আর সিএনজি অটোরিকশাচালকদের সঙ্গে মারামারি করতে পারেন না। যারা পারছেন গলাকাটা ভাড়া দিয়েই অটোরিকশায় চড়ছেন। আর যারা না পারছেন তারা ঝুলছেন বাসে। এই তো নাগরিক জীবন।’
রাজধানীর বিমানবন্দর, বনানী, মহাখালী, ফার্মগেট, মগবাজার, কাকরাইল ও প্রেসক্লাব এলাকায় বেশ কয়েকজন অটোরিকশাচালকের সঙ্গে কথা বলে প্রায় একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রশ্ন ছিল নিয়ম হচ্ছে মিটার মেনে ভাড়া আদায়, কিন্তু আপনারা যাচ্ছেতাই ভাড়া নিচ্ছেন কেন? বেশির ভাগ চালকের জবাব ছিল, মিটার কাজ করে না, নষ্ট।
নষ্ট মিটার ঠিক করেন না কেনÑএই প্রশ্নের পর মুখটাকে এই প্রতিবেদকের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে চালক ইব্রাহিম খলিল বলেন, ‘অতো বুইঝা কাম নাই। মিটারে গাড়ি চালাইলে ভাত খাওন লাগবো না।’ পাশেই এসে থামলো আরেকটি অটোরিকশা।
চালক লোহার খাঁচার ভেতর থেকেই মুখ এগিয়ে জানতে চাইলেন, ‘কই যাইবেন?’
- যাবো বাংলামোটর। ভাড়া কত?
গন্তব্যের কথা শোনার পর এক মুহূর্ত দেরি না করে প্রেসক্লাবের সামনে থেকে ওই চালক চলে গেল। বোঝা গেল এত কম দূরত্বে তিনি যেতে চাইছেন না। নীতিমালার ঘ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘চালকরা যেকোনো গন্তব্যে যাত্রী পরিবহনে বাধ্য থাকবেন। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা যাবে না।’ ঢাকার রাস্তার সিএনজি অটোরিকশাচালকরা নীতিমালা থোড়াই কেয়ার করেন। নিজেদের মনঃপূত না হলে তারা কোথাও যান না। সবই চালকের মর্জি।
শাহবাগে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকের অদূরে এক যাত্রীর সঙ্গে চালকের রীতিমতো হাতাহাতি চলছে। দৌড়ে গিয়ে কারণ জানতে চাইলে যাত্রী আনিসুল ইসলাম বলেন, ‘আরে ভাই দেখেন না কী মগের মুল্লুক পাইছে। এখান থেকে মোহাম্মদপুরের ভাড়া চাচ্ছে চার শ টাকা। বললাম, ভাই রোগী নিয়ে যাবো। শুনে যেন আরও বেঁকে বসেছে...।’
মিটারে যাচ্ছেন না কেন? চালককে এই প্রশ্ন করার পর তার ক্ষুব্ধ জবাব, ‘আমাগো মিটার নিয়ে এত কথা কেন? মিটার তো আছে। কিছু কইতে হইলে মালিকগো বলেন। হেরা তো ৬০০ টাকার জমা চৌদ্দ শ টাকা নেয়। তাগো তো কিছু কন না।’
এখানে দেন-দরবার মিটিয়ে চালক সর্বশেষ তিন শ টাকায় মোহাম্মদপুর যেতে রাজি হলেন। যাত্রী ভেতরে তুলে দরজা লাগাতে লাগাতে বললেন, ‘রাস্তায় টেরাফিক ধরলে কইবেন মিটারে যাইতাছি।’ উপায় নেই, তাই চালকের অন্যায় শর্তেই নিমরাজি ইব্রাহিম। আর যাই হোক অসুস্থ মাকে নিয়ে তো আর রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, সরকার থেকে প্রতিটি অটোরিকশার দৈনিক ভাড়া ঠিক করে দেওয়া হয়েছে ৬০০ টাকা। আর যাত্রীদের জন্য প্রথম দুই কিলোমিটারের ভাড়া ২৫ টাকা এবং পরের প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ৭ টাকা ৬৪ পয়সা ঠিক করা আছে।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও আইন অমান্যের বিরুদ্ধে বিআরটিএ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে বলে দাবি করেন বিআরটিএর উপ-পরিচালক মাহবুব-ই রাব্বানী। তিনি বলেন, ‘দুই-তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে তো আর সব জায়গায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা যায় না। জনবল সংকট তো আর উপেক্ষা করা যাবে না। তার পরও বিআরটিএর আইন প্রয়োগকারী শাখা যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করে যাচ্ছে।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বিআরটিএর পরিচালক (ইনফোর্সমেন্ট) বিজয় ভূষণ পালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘গণপরিবহনগুলো আইন অমান্য করলে তাদের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কেউ অন্যায় করলে আমরা তো চুপ করে বসে থাকি না। যার যেটা শাস্তি তাকে সেটা দেওয়া হয়।’
তোয়াক্কা নেই নীতিমালার
সিএনজিচালিত অটোরিকশার নীতিমালায় বলা আছে, ভাড়ার মিটার সব সময় সচল থাকতে হবে। রাস্তায় চলাচলের সময় মিটার নষ্ট, কারসাজি, ভুল তথ্য পাওয়া গেলে চালকের ক্ষেত্রে লাইসেন্স এবং মালিকের ক্ষেত্রে গাড়ি চলাচলের অনুমতি বাতিল হবে। বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই সিকিভাগও। ট্রাফিক পুলিশ আইন ভাঙার দায়ে সিএনজি অটোরিকশা আটকে দেন ঠিকই। কিন্তু ছাড়তেও বেশি সময় লাগে না। নগদ উৎকোচ মিললে পথ থেকে সরে দাঁড়ান তারা। এই অভিযোগ সিএনজি অটোরিকশাচালকদেরই।
বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকা। ঘটনা গত বৃহস্পতিবারের। রাস্তার পাশে থাকা ট্রাফিক হাত উঁচিয়ে একটি সিএনজি অটোরিকশাকে থামালেন। কাছে গিয়ে বললেন, ‘স্যার কাগজ দেখবেন। কাগজ দেন।’ চালক কাগজ হাতে বেরিয়ে এলেন মোটরসাইকেলের ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাফিক সার্জেন্টের কাছে। মিনিট পাঁচেক কথা হলো চালক ও সার্জেন্টের মধ্যে। এক পর্যায়ে চালক পকেটে হাত দিয়ে কিছু একটা মুঠো করে বের করলেন। তারপর সেটি কাগজের ভাজে রেখে আবার সার্জেন্টের হাতে দিলেন। সার্জেন্ট কাগজের ভাজ থেকে কিছু একটা নিয়ে সোজা প্যান্টের পকেটে হাত দিলেন। চালক কাগজগুলো নিয়ে দৌড়ে এলেন অটোরিকশার কাছে। কী সমস্যা? জানতে চাইলে বলেন, ‘সমস্যা কিছুই নয়। পাত্তি। পাত্তি দিছি সব সমস্যা সমাধান হইয়্যা গেছে।’
যাত্রীর স্বার্থ চালকদের কাছে কোনো গুরুত্ব না পেলেও মালিকদের স্বার্থ ঠিকই রাখছে সরকার। গত জুন মাসে ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের বৈঠকে যোগাযোগমন্ত্রী সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বাড়ানো হচ্ছে না বলে জানান। একই সঙ্গে পরিষদের দাবি মেনে তিনি অটোরিকশার মেয়াদ ১১ থেকে ১৫ বছর করার কথা মেনে নেন। কিন্তু এতে যাত্রীদের দুর্ভোগ কমেনি মোটেও।
অবৈধ ধূসর অটোরিকশা
সবুজ রঙের সিএনজি অটোরিকশার পাশাপাশি ঢাকার রাস্তায় প্রায়ই চোখে পড়ে ধূসর রঙের ‘প্রাইভেট’ অটোরিকশা। নামে ‘প্রাইভেট’ হলেও এগুলো ভাড়ায় চলে। মিটারের পরিবর্তে যাচ্ছেতাই ভাড়া আদায়ের জন্য অভিনব এই কৌশল বেছে নেওয়া হয়েছে বলে পরিবহন মালিকরা জানিয়েছেন। বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, এসব প্রাইভেট অটোরিকশা ভাড়ায় চালানোর কোনো নিয়ম নেই। কেউ যদি এটা করে তাহলে অবশ্যই চালকের লাইসেন্স ও চলাচলের অনুমতিপত্র বাতিল করা হবে।
এ বিষয়ে বিআরটিএর উপ-পরিচালক মাহবুব-ই রাব্বানী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আগে প্রাইভেট সিএনজি অটোরিকশার অনুমোদন দেওয়া হতো। হাইকোর্টের নির্দেশনার পর অনুমোদন বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে প্রাইভেট সিএনজি অটোরিকশা যদি কেউ ভাড়ায় চালায় আর এটার প্রমাণ পাওয়া যায় তবে অবশ্যই চলাচলের অনুমতিপত্র বাতিল করে হবে।’
(ঢাকাটাইমস/ ১০ডিসেম্বর/ এইচএফ/ জেডএ.)