মাদরাসা শিক্ষার দুটি ধারা- একটি সরকারি নিয়ন্ত্রণে আলিয়া, অন্যটি সনাতন কওমি। এখানে পড়ানো হয় না সরকারি কোনো পাঠ্যক্রম। বিজ্ঞান, ইংরেজি, সাহিত্য ইদানীং পড়ানো শুরু হলেও তা একেবারেই ন্যূনতম পর্যায়ে। আর এসব বইয়ে থাকা নানা বিষয়বস্তু কতটা মানসম্মত তা নিয়েও প্রশ্ন আছে । কিন্তু এর যেন কোনো সমাধান নেই।
তাই বলে এই মাদরাসায় শিক্ষা যে সহজ তা নয়, বরং শিক্ষার্থীদের শিশুকাল থেকে অনেক বেশি চাপে থাকতে হয়। তবে শিক্ষাজীবন শেষে তাদের সনদের কোনো দামই নেই। কারণ সনদের কোনো স্বীকৃতি নেই। ফলে পড়াশোনা শেষে চাকরি করার জন্য আবেদনও করতে পারে না কেউ।
এই শিক্ষার স্বীকৃতির বিষয়ে সরকার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এই মাদরাসার নিয়ন্ত্রকরা সরকারের ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণ বা অর্থায়ন নিতে রাজি হয়নি। আবার আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে সনদের স্বীকৃতি নেওয়ার বিষয়ে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে প্রবল আপত্তির কারণেও বিষয়টি ঝুলে আছে ৫ বছরের বেশি সময় ধরে।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ক্ষমতায় এসে কওমি মাদরাসার আধুনিকায়ন ও এই শিক্ষাকে মূল ধারায় নিয়ে আসার চেষ্টা করে সরকার। কওমি আলেমদের মধ্যে সর্বজন শ্রদ্ধেয় শাহ আহমদ শফিসহ (বর্তমানে হেফাজতে ইসলামের আমির) শীর্ষ আলেমদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। কীভাবে এই স্বীকৃতি দেওয়া যায় সে নিয়ে একটি কমিশনও করা হয় সরকারের সঙ্গে বৈঠকে। কিন্তু এরপর নিজেদের মধ্যে বিরোধ আর রাজনৈতিক নানা সমীকরণ মিলাতে না পেরে এই কমিশন কোনো প্রতিবেদন দিতে পারেনি।
এর আগে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলের নেতারা ক্ষমতায় এসে এই সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার আশা করেছিলেন। ভোটের সুবিধা নেওয়ার আশা ছিল নেতাদের। কিন্তু আবার নিজেদের মধ্যে বিরোধে ৫ বছরে প্রক্রিয়া আগায়নি তেমন।
পড়া শেষ, কিন্তু চাকরি কোথায়?
সনদের স্বীকৃতি নেই, তাই কওমি মাদরাসায় পড়াশোনা শেষে অন্য কোথাও চাকরি করতে না পেরে শিক্ষার্থীরা মূলত মসজিদে ইমামতি, ব্যবসা বা কওমি মাদরাসায় শিক্ষকতা করে থাকেন। কিন্তু এতে আয় হয় খুব কম। তাই এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে পড়েন শিক্ষার্থীদের একাংশ। এই হতাশা থেকে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
রাজধানীর মিরপুরের একটি কওমি মাদরাসার এক ছাত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘১৬ বছরের পড়া শেষে দেখি কোনো দাম নেই, তাই আদর্শিক বিরোধ থাকলেও ভর্তি হয়েছি আলিয়া মাদরাসায়। কারণ সেখান থেকে বের হলে অন্তত চাকরি পাব। নইলে লেপ- তোষকের ব্যবসা করা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না।’
এভাবেই কি চলবে? এমন মন্তব্যের জবাবে ওই ছাত্র বলে, ‘আমরা এবং শিক্ষকগণও বিষয়টি জানেন। কিন্তু এর সমাধান কোথায় তা জানা নেই।’
কওমি মাদরাসার দাবি, তারা ভারতবষের্র ঐতিহাসিক ইসলামিক বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দের পাঠ্যসূচি অনুসরণ করেন। দেওবন্দের পাঠ্যসূচি অনুযায়ী পরিচালিত দেশের কওমি মাদরাসাগুলো মূলত আরবি, ফারসি এবং উর্দু ভাষা শিক্ষার ওপর জোর দেয়। এছাড়া বাধ্যতামূলক হিসেবে সীমিত পর্যায়ে বাংলা, ইংরেজি ও অঙ্ক শিক্ষাও দেওয়া হয় কওমি মাদরাসায়।
মিরপুরের জামিউল উলুম মাদরাসার মুহতামিম (প্রধান) মুফতি মাওলানা আবুল বাশার নোমানী বলেন, ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি ও অঙ্ক ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দিয়ে থাকি।
তিনি বলেন, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের (বেফাক) সিলেবাস অনুযায়ী এই সব তৈরি করা হয়েছে।
মিরপুরের জামিউল উলুম মাদরাসার মুহতামিম (প্রধান) মুফতি মাওলানা আবুল বাশার নোমানী বলেন, ‘আমাদের মাদরাসায় কম্পিউটারের ল্যাব আছে যেখান থেকে ছাত্রছাত্রীদের স্বল্পপরিসরে প্রযুক্তির শিক্ষা দেওয়া হয়।
তবে কওমি মাদরাসার নিয়ন্ত্রণ কোনো একক শিক্ষাবোর্ডের হাতে নেই। বিভিন্ন অঞ্চলের মাদরাসাগুলো চলে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাবোর্ডের অধীনে। আবার একই এলাকায় একেকটি মাদরাসা একেকটি বোর্ডের অধীনে চলার মতো ঘটনাও ঘটেছে। রাজনৈতিক বিরোধও এর একটি কারণ। কোনো একটি বিশেষ আদর্শের অনুসারীরা এক ধরনের মাদরাসা চালান তো অন্য একটি বিশ্বাসের অনুসারীরা চালান অন্য ধরনের মাদরাসা।
দরিদ্রদের অবলম্বন
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কওমি মাদরাসার বেশির ভাগ শিক্ষার্থী দরিদ্র পরিবারের সন্তান। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা অবৈতনিক হলেও মাদরাসায় দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের থাকা-খাওয়া-শিক্ষা কোনোটিরই ব্যয় লাগে না। মূলত এ কারণেই শিশুদের শিক্ষিত করার আশায় মাদরাসায় দেন অভিভাবকরা। কিন্তু মাদরাসায় থাকা-খাওয়া বা শিশুদের বিকাশে ন্যূনতম ব্যয় করার সামর্থ্য নেই বেশিরভাগের। কারণ, মানুষের দান-দক্ষিণায় চলা মাদরাসাগুলো জানে না আগামী মাসে তাদের কত আয় হবে। আবার জঙ্গি অর্থায়ন রোধে সরকারের নজরদারির পর বিদেশ থেকে টাকা আসায়ও ভাটা পড়েছে। সেটাও বিপাকে ফেলেছে এই মাদরাসাগুলোতে।
সরকার অবশ্য নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনে মাদরাসাগুলোকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কওমি আলেমদের বিরোধিতায় তা হয়নি। কওমি শিক্ষাবোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে বড় বেফাকুল মাদরাসিল আরাবিয়া- বেফাকের মহাসচিব মাওলানা আবদুল জাব্বারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকার চলে সুদভিত্তিক ব্যবস্থায়। তাই আমরা সরকারের কাছ থেকে টাকা নিতে চাই না। তাছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে লেনদেন হলে ঘুষের সমস্যা থাকে। এটাও আমরা নিতে চাই না।’
সরকারের টাকা না নেওয়ার এই যুক্তি দিলেও দানের টাকার উৎস সম্বন্ধে কখনো জিজ্ঞেস করার সুযোগ থাকে না এই আলেমদের। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চরমোনাইয়ের পীরের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলনের এক নেতা বলেন, ‘কে কীভাবে টাকা আয় করেছে তা জানার সুযোগ তো আমাদের হয় না। আল্লাহর পথে ভালোবেসে টাকা দেয় মানুষ, আর আমরা তা নিয়ে আল্লাহর শিক্ষা দেই।’
শিক্ষার্থী ও মাদরাসার সংখ্যা কত?
২০০৮ সালে কওমি মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর একটি গবেষণা সমীক্ষা চালায় বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)। ওই গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, প্রায় ৫ হাজার ২০০ কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী সংখ্যা আনুমানিক ১৪ লাখ। কিন্তু সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছে, এখানে প্রকৃত তথ্য উঠে আসেনি।
লালবাগ জামিয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া মাদরাসার প্রয়াত প্রিন্সিপাল মাওলানা ফজলুল হক আমিনী দাবি করতেন, এই ধারার শিক্ষার্থী প্রায় ৪০ লাখ।
ওই গবেষণায় কওমি শিক্ষা ব্যবস্থাকে দেশের প্রচলিত অন্যান্য শিক্ষাব্যবস্থার মতো সরকারের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটি হয়নি।
২০১০ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে মিলে ব্যানবেইস কওমি মাদরাসার ওপর একটি নমুনা জরিপ পরিচালনা করে। ওই জরিপে ৬ বিভাগের (তখন রংপুর বিভাগ হয়নি) ৭টি জেলার ৫৪৪টি মাদরাসার ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়। তাতে দেখা যায়, ৮০ দশমিক ৭০ শতাংশ মাদরাসাই মফস্বল এলাকায় অবস্থিত। বাকি ১৯ দশমিক ৩০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান আছে শহরে। স্বাধীনতার পর ১৯৮৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কওমি মাদরাসা সবচেয়ে বেশি ৪৪ দশমিক ০৪ শতাংশ বেড়েছে। এই সময়ে মফস্বলে ৪২ দশমিক ৭০ শতাংশ, পৌর এলাকায় ৫২ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং মহানগর এলাকায় ৪৩ দশমিক ০৮ শতাংশ মাদরাসা গড়ে উঠে। ২০০০ সালের পর থেকেও পৌর এলাকায় মাদরাসা বেড়েছে। ওই জরিপ অনুযায়ী মাদরাসাগুলোর মধ্যে ৭৫ ভাগ মাদরাসায় শুধু ছেলেরা পড়ে এবং ২১ দশমিক ৬৯ শতাংশে শুধু ছাত্রীরা পড়ে। তিন দশমিক ৩১ শতাংশ মাদরাসায় ছেলে ও মেয়েদের একসঙ্গে পড়ার সুযোগ আছে। জরিপ বলছে মাদরাসায় শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ১০ দশমিক ২১ শতাংশ নারী শিক্ষক।
ব্যানবেইসের কর্মকর্তারা বলছেন এই নমুনা জরিপ দিয়ে মাদরাসা ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর প্রকৃত সংখ্যা জানা সম্ভব নয়। কারণ হিসেবে একেক মাদরাসায় একেক ধরনের চিত্র দেখা যাচ্ছে। তবে এই জরিপের ভিত্তিতে একটি সাধারণ ধারণা পাওয়া সম্ভব। ওই জরিপে বলা হয়, বেশকিছু বোর্ড সমন্বয়হীনভাবে চলছে এবং কিছু প্রতিষ্ঠান একেবারেই স্বাধীনভাবে চলছে। এর মধ্যে ৭০ দশমিক ৫৯ শতাংশ মাদরাসা বোর্ডের অধীন এবং ২৯ দশমিক ৪১ শতাংশ মাদরাসা কোনো বোর্ডের অধীনে নেই। এটাকে একটা বড় দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়েছে জরিপের ফলাফলে। জরিপে তদারক ব্যবস্থা উন্নত করা এবং জবাবদিহিতা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়।
কওমি মাদরাসা শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ১৫ হাজার কওমি মাদরাসা গড়ে উঠেছে। কওমি মাদরাসা শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে ৬টি শর্তে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
এর মধ্যে প্রথমটি হলো কওমি মাদরাসার নেসাব বা নেজামে তালিমে কোনো রকম হস্তক্ষেপ করা চলবে না। দ্বিতীয়টি হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা সম্পূর্ণভাবে অক্ষুণœ রাখতে হবে। তৃতীয়টি হলো মাদরাসা পরিচালনা পদ্ধতিতে কোনো হস্তক্ষেপ চলবে না। চতুর্থটি হলো মাদরাসা কখনো এমপিওভুক্ত হবে না। পঞ্চমটি হলো কোনো মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় সরকার কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতে পারবে না এবং সর্বশেষ শর্তটি হলো মাদরাসাগুলো তাদের স্ব স্ব বিধান অনুযায়ী চলবে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, কওমি মাদরাসার স্তর হবে ৬টি। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরটি হবে ইবতিদাইয়্যাহ, নিম্নমাধ্যমিক স্তর হবে মুতাওয়াসসিতাহ, এসএসসি স্তরের নাম হবে সানাবিয়্যাহ আম্মাহ, এইচএসসির স্তরটি সানাবিয়্যাহ খাস্সাহ, স্নাতক (সম্মান) স্তর হবে মারহালাতুল ফজিলত এবং দাওরায়ে হাদিস বা স্নাতকোত্তর মারহালালতুত তাকমিল নামে পরিচিত হবে। বর্তমানে অবশ্য এভাবেই চলছে মাদরাসার পাঠ প্রক্রিয়া।
আধুনিকায়নের উদ্যোগ ব্যর্থ
প্রযুক্তিগত শিক্ষাব্যবস্থা মাদরাসা শিক্ষার্থীদের উন্নত ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতকরণ এবং পেশাগত কাজে তাদের প্রায়োগিক ও ব্যবহারিক দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্যই কওমি শিক্ষা উন্নতকরণের লক্ষ্যে ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিশন গঠন করেছিল। এ ক্ষেত্রে বিতর্ক এড়ানোর জন্য এবং কওমি শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের চেয়ারম্যান ও হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে চেয়ারম্যান করে কমিশন গঠন করা হয়।
১৭ সদস্যের কমিশন একটি খসড়া নীতিমালা করে। এতে বলা হয়, শিক্ষা কর্তৃপক্ষের কার্যালয় ঢাকায় থাকবে। এর একজন চেয়ারম্যান ও ৯ জন সদস্য থাকবেন। এর মধ্যে ৭ জন কওমি শিক্ষা ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় আলেম, যুগ্মসচিব কিংবা তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার একজন সদস্য এবং মহিলা কওমি মাদরাসার একজন প্রতিনিধি। কর্তৃপক্ষ একজন সচিব নিয়োগ দেবেন। চেয়ারম্যান ও অন্যান্য সদস্য চার বছরের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। চেয়ারম্যান অথবা কোনো সদস্যের প্রতি কর্তৃপক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য অনাস্থা প্রকাশ করলে সরকার তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদান করতে পারবে। আবার চেয়ারম্যনের পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে তিনি দায়িত্ব পালন করতে অসমর্থ হলে শূন্যপদে নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান দায়িত্বভার না নেওয়া পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে মনোনীত কোনো সিনিয়র সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন।
বেফাকুল মাদারিস বাংলাদেশ, ইত্তেহাদুল মাদারিস চট্টগ্রাম, এদারায়ে তামিল সিলেট, তানজিমুল মাদারিস উত্তরবঙ্গ, গওহরডাঙ্গা বেফাক বোর্ড ফরিদপুরÑ এ পাঁচটি বোর্ডের প্রধান বা সচিবরা পদাধিকার বলে কর্তৃপক্ষের সদস্য হবেন।
কমিশনের খসড়া নীতিতে কওমি শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রাথমিক, নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তরÑ এই ৬ পর্যায়ে বিভক্ত করে প্রতি পর্যায় শেষে পরীক্ষা গ্রহণ ও পরীক্ষা পাসের সনদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়াও অন্তত উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক এবং সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষার পাঠ্যসূচিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এই খসড়া নীতি প্রণয়নের ভিত্তিতে দেশের কওমি মাদরাসাগুলোকে সুনির্দিষ্ট নিয়মের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ‘কওমি মাদরাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ’ নামে একটি নতুন সংস্থা গঠন করতে চায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই উদ্দেশ্যে মন্ত্রণালয়টি একটি নতুন আইনের প্রস্তাবনাও তৈরি করেছে।
এই প্রস্তাবনাটি গত বছরের ২৮ অক্টোবর অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট তারিখের একদিন আগেই হেফাজতে ইসলামের প্রবল আপত্তি ও হুমকির মুখে মন্ত্রণালয় খসড়া উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে।
সরকারের নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন এবং সংবিধান পরিবর্তনের প্রতিবাদ করতে ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। এরপর শাহবাগে আন্দোলনকারীদের ‘নাস্তিক’ আখ্যায়িত করে আন্দোলনের ডাক দেওয়ায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় হেফাজত ইসলাম। পরবর্তী সময়ে ৬ এপ্রিল রাজধানী অভিমুখে লংমার্চ ও মহাসমাবেশ এবং ৫ মে শাপলা চত্বরে অবস্থানকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনায় হেফাজত দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করে।
প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালের আগস্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রধান খালেদা জিয়া কওমি মাদরাসার জন্য ‘দাওরা ডিগ্রি’ নামের একটি নতুন ডিগ্রি ও সনদ ঘোষণা করেন। সে সময় বেশ কিছু ইসলামিক দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়েছিল, মানবিক বিভাগের ইসলামিক স্টাডিজ কিংবা আরবি সাহিত্যের মতো যেকোনো বিষয়ের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমানের হবে এই ‘দাওরা ডিগ্রি’। কিন্তু এই ঘোষণাটি যতটা না মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়ন ঘটানোর লক্ষ্যে দেওয়া হয়েছিল, তারচেয়েও এর পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছিল সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি। অর্থাৎ নিতান্তই নির্বাচনী কৌশল হিসেবে এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। ফলে বাস্তবে এই ঘোষণার কোনো ফলাফল আর দৃষ্টিগোচর হয়নি।
কওমি মাদরাসার ইতিহাস
ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ ও শাহারানপুরে মাওলানা কাসেম নানুতবী এবং রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী উপমহাদেশে ১৮৬৬ সালে কওমি মাদরাসা গড়ে তোলেন। কওমি মাদরাসা সাধারণত সরকারি আর্থিক সহায়তার পরিবর্তে সাধারণ মানুষের সহায়তায় পরিচালিত হয়। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে কওমি মাদরাসা বহুল প্রচলিত। ভারত উপমহাদেশের পাশাপাশি বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও কওমি মাদরাসা রয়েছে। তবে উপমহাদেশের বাইরে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সাধারণত দারুল উলুম বা দেওবন্দি মাদরাসা নামে পরিচিত।
কওমি মাদরাসা সাধারণত সরকারি অনুদানের পরিবর্তে পুরোপুরি জনসাধারণের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এর কর্মকা-ে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
স¤্রাট আকবরের সময় মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে, সব ধর্মের শিক্ষার্থীদের মাদরাসা উন্মুক্ত করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাদরাসা পাঠ্যক্রমেও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন গৃহীত হয়। ফলে সংস্কৃত, ফার্সি এবং আরবি ভাষা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে মাদরাসাগুলোতে প্রতিটি শিক্ষার্থীই সংস্কৃত ভাষা শিখত।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর দেওবন্দে পুনরায় মাদরাসা শিক্ষা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ইংরেজ পরিচালিত মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার বিরোধিতা করে তারা ধর্মভিত্তিক পাঠ্যক্রম সম্বলিত নতুন বিদ্রোহী মাদরাসা ব্যবস্থা পরিচালনা করেন। যুগোপযোগী প্রয়োজনীয় সংস্কার গ্রহণ না করে, প্রাচীন পাঠ্যপুস্তকের ভিত্তিতে তারা যে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করলেন তা যুগের প্রয়োজন পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল।- সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে