মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরে এ দেশে গণহত্যা করার পরও ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের সুযোগে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল হিসেবে আবার তৎপরতা শুরু করে জামায়াতে ইসলামী। শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থাকলেও ধর্মকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার পাশাপাশি রাষ্ট্রযন্ত্রকে নানা কৌশলে ব্যবহার করেছে দলটি। আর এ কারণে বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারীদের বিরোধিতার মুখেও টিকে গেছে দলটি।
তবে শীর্ষ নেতাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর দৃশ্যত চাপে পড়েছে দলটি। শক্তি ক্ষয়ের লক্ষণও স্পষ্ট। তবে জামায়াতকে একেবারে নিশ্চিন্ত করতে আদর্শিক লড়াই জরুরি বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এই আদর্শিক লড়াই রাষ্ট্রকেই শুরু করতে হবে বলে মনে করেন তারা। কিন্তু রাষ্ট্র আদর্শিক লড়াই করবে দূরের কথা, উল্টো রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যবহার করেই নিজ আদর্শ প্রচার করছে জামায়াত।
বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার সুযোগে মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্যক্রমে নিজেদের নানা কর্মকা-ের প্রচার শুরু করে জামায়াত। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসার পরও বিষয়টি রয়ে যায় দৃষ্টির আড়ালে। তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন সম্প্রতি আলিয়া মাদরাসার পাঠ্যক্রম পর্যালোচনা করে যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাকে বিস্ময়কর বলছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, মাদরাসার পৌরনীতি, ইসলামের ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে জামায়াতের নানা কর্মকা-ের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এটি একটি আদর্শিক ইসলামী দল- এমন বক্তব্যও পড়ানো হয় ছাত্রদের। জামায়াতের বিরোধীরা ইসলামের বিরোধী- এমন শিক্ষা কৈশর আসার আগেই মনন মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের।
মাদরাসায় পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে জামায়াতের পক্ষে অবস্থান জোরালো বলে মনে করা হয়। পাঠ্যক্রমে এমন বিষয়গুলো থাকলে এটাই স্বাভাবিক বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যবহার করে জামায়াতের আদর্শ প্রচারে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
পাঠ্যক্রমে যা আছে
আলিয়া মাদরাসার পাঠ্য বইয়ে প্রকাশ্যেই পড়ানো হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর গুণকীর্র্তন ও মওদুদীবাদ। ব্যাংকিং-ব্যবস্থায় ইসলামী ব্যাংকের নানা কার্যক্রমের বিষয়েও উল্লেখ আছে মাদরাসার পাঠ্য বইয়ে। নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ মাদরাসা বোর্ডের হেয়ালিপনা ও তদারকির অভাবে বছরে পর বছর একটি নির্দিষ্ট দলের আদর্শ প্রচারে ব্যবহার হচ্ছে মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্যক্রম।
মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের আলিম শ্রেণির পাঠ্য বই ‘ইসলামি পৌরনীতি’। এই বইটি একাধিক প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বেসরকারি এসব প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত বই ঘেঁটে দেখা গেছে, ইসলামি পৌরনীতির সিলেবাস এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীদের খেলাফত রাষ্ট্র কায়েমের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন, জামায়াতে ইসলামী, মওদুদীবাদের প্রকাশ্য প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সুকৌশলে স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীকে তুলে ধরা হয়েছে পুরোপুরি ইতিবাচক হিসেবে। গুণগান গাওয়া হয়েছে দলটির ব্যাপারে। এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে একাত্তরে দলটি শত্রুপক্ষের হয়ে অস্ত্র ধরেছিল, সেই কথাও। বরং রাজনীতির পাশাপাশি জামায়াত ‘সমাজসেবা’ করছে বলে দাবি করা হয়েছে সরকারি পাঠ্য বইয়ে। ব্যবহার করা হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাজাভোগ অবস্থায় মারা যাওয়া গোলাম আযমের উদ্ধৃতিও।
এ ছাড়া ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, দ্বিজাতি তত্ত্ব, ইসলামী নেতৃত্বের যোগ্যতা, গুণাবলি, দেশের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ শ্রেণির প্রাধান্য, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি প্রতিষ্ঠা ও মুসলিম রাজনীতি বিলোপের চেষ্টা। ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের কল্প-কাহিনিও আছে ‘ইসলামি পৌরনীতি’তে। পাশাপাশি জামায়াতের তহবিলে পরিচালিত রাবেতা আলম আল ইসলামীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, ইসলামী ব্যাংকের কার্যাবলি, ইসলামী শাসনতন্ত্র ইত্যাদিও আছে আলিম শ্রেণির সিলেবাসে। রাষ্ট্র ও সামরিক বাহিনী পরিচালনায় নারীকে একেবারে অক্ষম হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে মাদারাসা বোর্ডের পাঠ্যক্রমে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, এভাবে দিনের পর দিন এসবই পড়ানো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। যে কারণে মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত একটি ছেলে কিংবা মেয়ে শিক্ষাজীবন থেকেই ভুল তথ্য ও ধারণা নিয়ে বড় হচ্ছে। ব্যক্তি, সমাজ ও কর্মজীবনেও এই গ-ি থেকে বের হতে পারে না তারা। যারা নিজে থেকে শেখা ও জানার চেষ্টা করে তারা হয়তো কিছুটা খোলস ছাড়তে পারে। তবে এ সংখ্যা খুবই কম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মুহাম্মদ নাজমুল হক বলেন, ‘একটি গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য মাদরাসা শিক্ষাকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। এর ব্যাপারে আরো আগেই সচেতন হওয়া দরকার ছিল।’ তিনি বলেন, ‘ছেলেমেয়েদের যদি প্রকৃত সত্য জানতে দেওয়া না হয়, তা হলে তারা তো অন্ধকারেই থেকে যাবে। সব জ্ঞানই তো মানুষের মনে আলো জ্বালাতে পারে না। আলোকিত মানুষ করে তুলতে পারেন না। এ বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। যারা এগুলো পড়ছে তাদের তো কোনো দোষ দেওয়া যাবে না। কিন্তু যাদের কথা ছিল এসব তদারকি করার, তারা কী করছে? তাদের ভূমিকা এত দিন কী ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার সময় এসেছে।’
আলিয়া মাদরাসা পাঠ্যক্রম পর্যালোচনা করেছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক শামীম মোহাম্মদ আফজাল। তিনি জানান, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড শুধু আলিম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ের পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করে থাকে। তারা নিজেরা কোনো বই প্রকাশ করে না। মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের পাঠ্যক্রমের আলোকে বাইরের প্রকাশকরা বই প্রকাশ করে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেন। বাইরের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের এসব বই পাঠ্যক্রমে অনুযায়ী হয়েছে কি না বা অন্য কোনো বিষয় যোগ করা হয়েছে কি না তা মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে অনুমোদন দেয় কি না তা স্পষ্ট নয়।
তবে মাদরাসার পাঠ বইয়ে স্পষ্ট লেখা থাকে ‘বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে কর্তৃক অনুমোদিত।’ কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানকে বই প্রকাশের জন্য অনুমোদনপত্রও দিয়েছে মাদরাসা বোর্ড। আবার কোনো কোনো বইয়ে লেখা থাকে, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের সর্বশেষ পাঠ্যক্রমে অনুযায়ী রচিত। এসব বইয়ে পাঠ্যক্রমবহির্ভূত যেসব বিষয় অন্তর্র্ভুক্ত রয়েছে তা দেখে বোঝা যায় যে, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড সিলেবাস প্রণয়ন ও বই প্রকাশের অনুমোদন দেওয়ার পর তা পাঠ্যক্রম অনুযায়ী হয়েছে কি না তা তদারকি করে না। অথচ বইগুলোতে ঠিকই মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের নাম ব্যবহার করা হয়।
পাঠ্য বইয়ের মাধ্যমে দিনে পর দিন জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খোদ মাদরাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান এ কে এম সাইফ উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আমি বইগুলো পড়েছি। জামায়াত ও মওদুদীবাদের বিষয়গুলো যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে তা পুরোপুরি দলীয় আদর্শ প্রচারের নগ্ন কৌশল।’ চেয়ারম্যান বলেন, ‘ইসলামি পৌরনীতি বইটি আলিমের পাঠ্যক্রম থেকে আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। বোর্ডের নজরে বিষয়টি আসার পর থেকে মাদরাসার পাঠ্যক্রম আবার পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে।’ প্রকাশনা সংস্থার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বইয়ের বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর পরও যেসব জায়গায় বিক্রির অভিযোগ পাওয়া যায় সেখানে অভিযান চালানো হয়। তবে সমস্যা হচ্ছে যারা এসব বই ছেপেছে সেসব প্রকাশনাকে যথাযথ ঠিকানায় গিয়ে পাওয়া যায় না। আমরা একাধিকবার পুলিশ নিয়ে অভিযান চালিয়েছি।’
চারদলীয় জোট আমলে করা এই পাঠ্যক্রম এত দিন কেন পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি? জবাবে এ কে এম সাইফ উল্লাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কীভাবে দিনে পর দিন এসব বই পড়ানো হয়েছে, তা চিন্তা কূল পাওয়া যাবে না। আমি তো বোর্ডের দায়িত্ব নিয়েছে বছরখানেক হচ্ছে। আমি এসেই এসব পর্যালোচনা করে এগুলো পরিবর্তন, পরিমার্জনের উদ্যোগ নিয়েছি। আমার আগে যারা ছিলেন তারা কী করেছে, কে জানে।’
মাদরাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান জানান, যদি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এসব বই পাঠ্য করার প্রমাণ পাওয়া যায়, তা হলে তার এমপিও বাতিলের জন্য সব ধরনের সুপারিশ করা হবে।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসির মামুন মনে করেন, এসবের দায় পুরোপুরি মাদরাসা বোর্ড ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। তাদের চোখের সামনে কীভাবে জামায়াতের রাজনৈতিক আদর্শ প্রচার হচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি বলেন, ‘এসব নিয়ে লিখতে ও বলতে গিয়ে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এর দায় কোনোভাবেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় এড়াতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা গলা ফাটালেও কোনো লাভ নেই, যতক্ষণ সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগী না হবে তত দিন কোনো কাজ হবে না।’
চারদলীয় জোট আমলে মাদরাসা শিক্ষায় করা পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের সময় এসেছে উল্লেখ করে মুনতাসির মামুন বলেন, ‘ছয়-সাত বছর ধরে সরকার এ ব্যাপারে অনেকটা নীরব ছিল। এখন যতদ্রুত সম্ভব পাঠ্যক্রমে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ জামায়াত দীর্ঘমেয়াদি সুফলের কথা চিন্তা করে এসব অপকর্ম করেছে। তাদের এই কৌশল ঠেকানো না গেলে মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়ন করা সম্ভব হবে না।’
জানতে চাইলে শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্যক্রম নিয়ে অনেক পর্যালোচনা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। সরকার এ ব্যাপারে আন্তরিক। অতীতে এই শিক্ষাব্যবস্থাকে যেভাবে কুলষিত করা হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে না এলে মাদরাসা শিক্ষার মান বাড়ানো যাবে না।’ তিনি জানান, একটি যুগোপযোগী মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা চালুর জন্য সরকারের বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় এক হয়ে কাজ করছে।
পাঠ্য বইয়ে জামায়াতের গুণগান
আলিয়া মাদরাসার পাঠ্য বইয়ে কোনো ধরনের রাখঢাক না রেখেই গুণগান গাওয়া হয়েছে একাত্তরে প্রকাশ্যে স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষে অস্ত্র ধরা জামায়াতে ইসলামীর। বাংলাবাজারের ইসলামিয়া কুতুবখানা থেকে প্রকাশিত হয়েছে আলিম শ্রেণির ‘ইসলামি পৌরনীতি’। বইটির ৫৯১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীনিতে সর্বাধিক বড় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামি। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদী। তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ইসলামি রাজনীতিকে এ উপমহাদেশের মানুষের সামনে তুলে ধরতে প্রয়াস পেয়েছেন। ইসলামের বিভিন্ন দিকের উপর তাঁর অনেক রচনাবলি আছে। জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক কার্যাবলি ছাড়াও সমাজসেবায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্গত মানবতার পাশে সব সময়ই জামায়াতে ইসলামী এগিয়ে আসে। এদেশে ইসলামি অর্থনীতি চালুর প্রচেষ্টায় জামায়াতে ইসলামীর বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় জামায়াতের বলিষ্ঠ ভূমিকা মুখ্য। জামায়াতে ইসলামী শিক্ষাক্ষেত্রে অনবদ্য অবদান রেখেছে। জামায়াতে ইসলামী পরিচালিত বিভিন্ন ট্রাস্ট বা সমিতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। পুস্তক প্রকাশনা, ফোরকানিয়া মাদরাসার পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রভৃতি প্রণয়নে জামায়াতে ইসলামী পরিচালিত ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটি বিশেষ অবদান রেখেছে। তা’মীরুল মিল্লাত ট্রাস্টের অধীনে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে তা’মীরুল মিল্লাত মাদরাসা পরিচালিত হচ্ছে। মাদরাসাটির শিক্ষাদানের মান বেশ উন্নত। প্রতিবছর বোর্ডে পরীক্ষায় ছাত্ররা বেশ ভালো ফল করে।’
একই বইয়ের ৩৫৬ নম্বর পৃষ্ঠায় জামায়াতে ইসলামীর আরেকটি প্রতিষ্ঠানের গুণকীর্তন তুলে ধরা হয়। যেখানে বলা হয়, বাংলাদেশ রাবিতাতুল আলম আল ইসলামির ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার জামায়াতিদের একটি প্রতিষ্ঠান। এখানে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘মুসলিম বিশ্বে যে ইসলামি গণচেতনা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলো সদা সচেষ্ট রয়েছে। খ্র্রিস্টান ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলোর হীন প্রচেষ্টা মোকাবিলা করার জন্য রাবেতা অনবদ্য ভূমিকা পালন করে আসছে।’
আওয়ামী লীগকে তুলে ধরা হয়েছে ইসলামবিদ্বেষী হিসেবে
একই বইয়ে ৫৮২ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘ধর্ম বিষয়ে সরকারি উদ্যোগ’ শিরোনামের নিচে দেওয়া বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭৫ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠান করে, কিন্তু ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে কাজ করতে না দেওয়ায় ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বরবরাই তিক্ত ও বিদ্বেষপূর্ণ ছিল। বিএনপি সরকার মরহুম জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭২ সনের সংবিধানের মূলনীতি সংশোধন করে বিসমিল্লাহ সংযোজিত হয় এবং অন্যতম মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতার কথা লিখিত হয়। বিএনপি সরকারের আমলে স্বায়ত্তশাসিত বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড চালু হয় এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়। ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দলের নীতি স্বীকৃত হয়।’
চারদলীয় জোট সরকারের শরিক জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোট ‘অনেক চড়াই-উতরাই’ পার হয়ে সাফল্য পেয়েছে বলেও দাবি করা হয় বইটিতে। একই পৃষ্ঠায় লেখা হয়, ‘এ চারদলীয় ঐক্যজোটের অন্যতম দুটি দল হলো জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ঐক্যজোট। তাই বলা হয়, এ দেশে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠাকরণের ক্ষেত্রে ইসলামী দলগুলো অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। সময়ের বিবর্তনে এ দেশের হয়তো একদিন তাওহীদের পতাকা উত্তোলিত হবে- এমন ধারণা এ দেশের ইসলামপ্রিয় জনগণের।’
পাঠ্যবইয়ে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারণা বড় ধরনের শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন। তিনি বলেন, ‘যখন এটি করা হয়েছে তখন যারা সরকারে ছিলেন তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে বিশ্বাস করে না। যে কারণেই মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের পাঠ্য বইয়ে এসব অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। তবে এর দায় বর্তমান সরকারের নয়। তবে যত দ্রুত সম্ভব এসব পাঠ্য বই নিষিদ্ধ করা দরকার।’
মওদুদীবাদের প্রচার, জাতীয়তাবাদের সমালোচনা
সুকৌশলে সরকারি পাঠ্য বইয়ে মওদুদীবাদের প্রচার করা হচ্ছে। মওদুদীর উক্তিকে উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে আলিম শ্রেণির বইয়ে। বাংলাবাজারের আল-বারাকা লাইব্রেরি প্রকাশিত ‘ইসলামি পৌরনীতি’ বইয়ে ‘কওমিয়াত-জাতীয়তাবাদ’ শিরোনামে লেখা নিবন্ধে মওদুদীর উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়েছে। ‘জাতীয়তাবাদ ইসলামি আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়’ বলেও এখানে উল্লেখ আছে। বইটির ৭০ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে- ‘সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী (রহ.)-এর মতে, ‘জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম উভয়ে মতাদর্শ হিসেবে পরস্পরের বিপরীত।’ তাঁর মতে, ‘মুসলমানদের হৃদয় ও মনের এক প্রান্ত দিয়ে যখন জাতীয়তাবাদের চেতনা অনুপ্রবেশ করে, তখন অন্য প্রান্ত দিয়ে ইসলাম নিষ্ক্রান্ত হয়। যে মুসলিক নিজেকে জাতীয়তাবাদের ধারক বলে জাহির করেন, তিনি ইসলামের আলোকবর্তিকা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ইসলামের বিশ্বজনীন আদর্শের বিপরীতে জাতীয়তাবাদ মানুষে মানুষে বিভক্তি আনে। জাতিতে জাতিতে হিংসা, বিদ্বেষ, লড়াই ও সংঘাত জাতীয়তাবাদেরই পরিণাম।’
এ বিষয়ের আলোচনায় জাতীয়তাবাদকে বিশ্বে মানবতার ‘বিপর্যয়’ ও ‘বিপদের’ কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এখানেও মওদুদীর ভাষায় ‘জাতীয়তাবাদ হচ্ছে, বর্তমান বিশ্বে মানবতা যেসব বিপর্যয় ও বিপদাপদে নিপতিত তার মূল কারণ।’ দিল্লি থেকে মাকতাবা জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশিত মওদুদীর ‘প্রসেস অব ইসলামিক রেভ্যুলেশন’ বই থেকে এই উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে।
আলিম শ্রেণির ‘ইসলামী পৌরনীতি’র এ বইটির ৮০ নম্বর পৃষ্ঠায় মওদুদীকে ‘বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, বিংশ শতাব্দীর ইসলামি পুনর্জাগরণ আন্দোলনের নেতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ বইয়ের ৮৫ ও ৮৬ পৃষ্ঠায় ‘ইসলামি রাষ্ট্রের সংজ্ঞা’য় মওদুদী, গোলাম আযম, মোহাম্মদ আসাদ, আবুল কাসেম ছিফাতুল্লাহর উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী (রহ.)-এর মতে, ‘ইসলামী রাষ্ট্র একটি আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র। ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নই এ রাষ্ট্রের লক্ষ্য। মানবজীবনের সব দিককে এ রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে চায় বলে এটিকে সর্বাত্মক রাষ্ট্রও বলা যায়।’ ইসলামী রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় আরও বলা হয়, অধ্যাপক গোলাম আযম-এর মতে, ‘যে রাষ্ট্রের আইন রচনা, শাসনকার্য ও বিচারব্যবস্থা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা চূড়ান্তভাবে নিয়ন্ত্রিত তারই নাম ইসলামি রাষ্ট্র।’ মুহাম্মদ আসাদ-এর মতে, ‘একটি রাষ্ট্রকে তখনি ইসলামি রাষ্ট্র বলা যায়, যখন ইসলামের সমাজ রাষ্ট্র, সম্পর্কিত বিধানগুলো জাতির জীবনে সক্রিয়ভাবে প্রয়োগ করা হয় এবং দেশের মৌলিক শাসন সংবিধানে সেগুলো অন্তর্র্ভুক্ত করা হয়।’ একই প্রসঙ্গে ‘আবুল কাসেম ছিফাতুল্লাহর মতে-‘যে ভূখ-ে ঐশী সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্য, সরকার, জনগণ ও আল্লাহর আইন তথা কুরআন ও সুন্নাহর পরিপূর্ণ নীতির বুনিয়াদ এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গোটা ব্যবস্থাকে পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাকেই বলা হয় ইসলামি রাষ্ট্র।’
ছাত্রশিবিরের প্রচারণাও পাঠ্য বইয়ে!
চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে করা মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের আলিম শ্রেণির পাঠ্যক্রম এখনো চলছে। ওই পাঠ্যক্রম অনুযায়ী আলিম শ্রেণির বইয়ে অনেক সূক্ষ্ম কৌশল মেনে ইসলামী ছাত্রসংঘ, ছাত্রশক্তি এবং ছাত্রশিবিরের প্রচার করা হয়েছে। আল ফাতাহ পাবলিকেশন্সের প্রকাশিত ‘ইসলামি পৌরনীতি’ বইয়ের ৫৬ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে- ‘যুগে যুগে ব্যক্তি সমষ্টি তথা সমিতি, সংঘ, দল প্রভৃতিও ইসলামী মূল্যাবোধের অনুশীলনে যথেষ্ট অবদান রাখছে। বর্তমান শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্বে বহু দেশে বহু সংঘ বা দল সমাজে ইসলামী মূল্যবোধে জাগ্রত করার চেষ্টা করছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইখওয়ানুল মুসলেমীন, ইন্দোনেশিয়ান শরীয়ত পার্টি, মালয়েশিয়ায় প্যান মালেয়ান ইসলামী অ্যাসোসিয়েশন, ভারতীয় উপমহাদেশে ও আফগানিস্তানে জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি রাজনৈতিক দল এবং ছাত্রদের মধ্যে সাবেক ইসলামী ছাত্রসংঘ, ছাত্র শক্তি পরে ইসলামী ছাত্রশিবির প্রভৃতি ছাত্রসংগঠনের যৌথ প্রচেষ্টায় মুসলিম সমাজে অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বা হচ্ছে।’
ধর্মনিরপেক্ষবাদের সমালোচনা
ধর্মনিরপেক্ষবাদ নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে আল-বারাকা পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত ‘ইসলামি পৌরনীতি’ বইটিতে। ৩৮৭ নম্বর পৃষ্ঠায় বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি প্রতিষ্ঠা শিরোনামের লেখা প্যারায় বলা হয়েছে-‘কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই ধর্মনিরপেক্ষতা জুড়ে দেওয়া হলো শতকরা ৯০ জন মুসলিম রাষ্ট্রের সংবিধানে। রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে ধর্মহীনতাকে প্রতিষ্ঠা করা হলো, যা রাষ্ট্রের সর্বত্র অশান্তির দাবানল প্রজ্জ্ব¡লিত করেছিল।’ এর পরেই ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয়ে বলা হয়েছে- ‘এই প্রশ্নের জবাবে এতটুকুই বলা যথেষ্ট যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কোনো কল্যাণমূলক মতবাদ পৃথিবীতে নেই। ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতার নামান্তর। ধর্মকে ধ্বংস করার কৌশল হিসেবে রচিত একটি অপতন্ত্র। কেননা ধর্মনিরপেক্ষতার মূলকথা হলো, কোনো ধর্মই স্বয়ংসম্পর্ণ নয়। সুতরাং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো ধর্মকেই মডেল হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। প্রত্যেক ধর্ম থেকে কিছু কিছু মূলনীতি গ্রহণ করে মূলনীতিগুলো মানব রচিত মতবাদ থেকে গ্রহণ করত রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। এটি ইসলামি ধর্ম বিশ্বাসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।’ একই বইয়ের ৪৯১ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘এ দেশে সরকারি উদ্যোগে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের কাজ তেমনটা হয়নি।’ একই বিষয়ে টেনে আনা হয়েছে মওদুদীকেও। বলা হয়েছে-‘ইসলামি সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামি চেতনা ও সংস্কৃতির বিকাশে অনবদ্য অবদান রাখেন এ উপমহাদেশে সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ.)। ইসলামী অর্থব্যবস্থা, ব্যাংকিং, জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ, রাজনৈতিক দর্শন প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
একই পৃষ্ঠার অন্য জায়গায় বলা হয়েছে, ‘রাজনৈতিক শক্তি ছাড়া ইসলামি আইন চালু হতে পারে না বলেই জামায়াত রাজনৈতিক ময়দানে কাজ করে। সমাজ সেবা ও সামাজিক সংশোধনের জোর তাগিদ ইসলাম দিয়েছে বলেই জামায়াত সমাজ সেবা ও সমাজ সংস্কারে মনোযোগ দেয়। তাই জামায়াতে ইসলামি একাধারে ধর্মীয় সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দল। এ অর্থেই জামায়াতে ইসলামি একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি আন্দোলন ও ইসলামি বিপ্লবের পতাকাবাহী কাফেলা।’ একই পৃষ্ঠার শেষ দিকে ‘জিহাদে’ উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘ইকামাতে দ্বীনই মুসলিম জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। জিহাদই (সংগ্রাম) আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের একমাত্র পথ।’
নারী রাষ্ট্র পরিচালনায় ‘অক্ষম’!
নারীকে রাষ্ট্র পরিচালনায় পুরোপুরি ‘অক্ষম’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে মাদরাসার পাঠ্য বইয়ে। ইসলামিয়া কুতুবখানা থেকে প্রকাশিত ‘ইসলামি পৌরনীতি’ বইয়ের ৩৩৪ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘নারীর দৈহিক ও প্রাকৃতিক কারণে পুরুষের তুলনায় অক্ষম। ফলে রাষ্ট্রীয় ও সামরিক পদে নারী নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা প্রায় সর্বজন স্বীকৃত। আর এ কারণে বলা হয়েছে নেতৃত্বেদান কেবলমাত্র পুরুষদের পক্ষেই সম্ভব।’
পাঠ্য বইয়ে শিশু কিশোররা নারীবিদ্বেষী কথা পড়লে সারা জীবনেই তার প্রভাব থাকে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানিয়া হক। তিনি বলেন, ‘শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই যদি শিশু-কিশোরদের নারীদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা দেওয়া হয় তবে তারা বড় হয়েও এই চিন্তাকেই ভেতরে লালন করে। এটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। এ জন্য পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র দায়ী।’ তিনি বলেন, ‘মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড নয়, অন্যান্য শিক্ষামাধ্যমের পাঠ্য বইয়েও যদি নারীদের ব্যাপারে বিরূপ ধারণার কিছু লেখা হয় তা হলে দ্রুত তা বাদ দিতে হবে। নারীদের ব্যাপারে এই সমাজের ধ্যান-ধারণা পরিবর্তন না হলে দেশের সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন হবে না।’
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানও জামায়াতের
বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড শুধু আলিম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ের পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করে। তারা নিজেরা কোনো বই প্রকাশ করে না। পাঠ্যক্রমের আলোকে বেসরকারি প্রকাশকরা বই ছাপায়। এর মধ্যে আছে আল-বারাকা লাইব্রেরি, ইসলামিয়া কুতুবখানা, আল ফাতাহ পাবলিকেশন্স, পাঞ্জেরী প্রকাশনী, কামিয়াব প্রকাশনী, আল-মদিনা প্রকাশনী, মিল্লাত প্রকাশনী, ইমতেহান প্রকাশনী, মাদরাসা লাইব্রেরি, আল-আরাফা প্রকাশনী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব প্রকাশনীর সিংহভাগই জামায়াতপন্থী ব্যবসায়ীদের। যারা ব্যবসার আড়ালে দলীয় প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্যবইকে। যে কারণে, প্রায় সব প্রকাশনীর বইয়ে একই ধরনের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের অনুদানও দেওয়া হয় এসব প্রকাশনীকে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, মাদরাসা বোর্ড একটি পাঠ্যক্রম করে দিয়েই তাদের দায় শেষ, এমন ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। প্রকাশনীগুলো পাঠ্যক্রমভাবে মানছে কিনা তাও কঠোরভাবে তদারকি করতে হবে। ভালো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বই বাজারজাত করার অনুমোদন দেয়া প্রয়োজন। তা না হলে এসব বইয়ের আড়ালে জামায়াতের দলীয় আদর্শ ও মওদূদীবাদের যে প্রচার চালানো হচ্ছে তা ঠেকানো সহজ হবে না।
এ প্রসঙ্গে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক শামীম মোহাম্মদ আফজাল বলেন, ‘বর্তমান সরকারের বিভিন্ন খাত থেকে আলিয়া শিক্ষাব্যবস্থার পেছনে
প্রতিবছর কম করে হলেও দুই হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ব্যয় হচ্ছে। সরকারের এই বিপুল অর্থ মূলত জামায়াত ও মওদুদী দর্শনের প্রচারে ব্যবহার হচ্ছে। যদি সত্যিকার অর্থে আলিয়া মাদরাসার মাধ্যমে প্রকৃত আলেম তৈরি করতে হয় তা হলে আলিম থেকে কামিল পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক সরকারিভাবে রচনা ও প্রকাশিত হওয়া দরকার।’
বই বিতরণের দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে
মাদরাসা বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, সরকার প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৪৯ লাখ ৭১ হাজার ১২৩ জন মাদরাসা শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে বই দিয়ে আসছে। আলিয়া মাদরাসার আলিম থেকে কামিল পর্যন্ত শিক্ষার্র্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ। মাদরাসা শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেখানে সরকার ৫০ লাখ শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে বই দিতে পারছে, সেখানে মাত্র সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে বই দেওয়া কঠিন কিছু হবে না। এতে সরকারের যে আর্থিক ব্যয় হবে তার চেয়ে রাষ্ট্রীয় কল্যাণ বেশি হবে। কারণ ইসলামী রাষ্ট্রের নামে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে ইসলামী বিপ্লবের বীজ বুনে দেওয়া হচ্ছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিশেষজ্ঞদের দিয়ে নতুন করে পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব।
জড়িতদের শাস্তি দাবি
মাদরাসা শিক্ষাকে যারা রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারে ব্যবহার করেছে তাদের শাস্তি হওয়া উচিত বলে মনে করেন দেশের শিক্ষাবিদরা। তারা বলেন, পাঠ্য বই হচ্ছে একটি শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলার পাঠ। তারা যদি শুরুতেই কোনো রাজনৈতিক দলের হীন প্রচারের স্বীকার হন তা হলে সঠিক ইতিহাস জানার ও বোঝার সুযোগ হবে না। জামায়াতপন্থিরা বুঝে শুনেই এসব অপরাধ করেছে। তাই তাদেরকে শাস্তির মুখোমুখি করার দাবি অযৌক্তিক নয়।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ-উল লেনিন বলেন, ‘কারা এসব বই লিখেছে তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে হবে। তা না হলে এসব অপকর্মের বিহিত হবে না।’
সাপ্তাহিক এই সময়ের সৌজন্যে