logo ২৯ এপ্রিল ২০২৫
বিআরটিএর অভিযান বজ্র আটুঁনি, ফসকা গেরো

তানিম আহমেদ
১৭ নভেম্বর, ২০১৪ ২১:৫৭:১৮
image


সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা রোকেয়া রহমান। থাকেন মোহাম্মদপুরে। কাজে গিয়েছেন ফার্মগেটে, বিকালে যাবেন উত্তরায়। ততক্ষণে অফিস সময় শেষ, পাচ্ছেন অটোরিকশা। ভাবলেন বাসে করে যাবেন কিন্তু বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে যে পরিস্থিতি দেখেছেন তাতে আর উত্তরায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত পুরোপুরি বাদ দিতে হলো তাকে।

কী দেখলেন রোকেয়া রহমান? তিনি বলেন, ‘মাঝেমধ্যে এক দুইটা বাস আসে আর মানুষ তো শত শত। বাসে উঠতে গেলেই যুদ্ধ করতে হয়। আমার পক্ষে ভাই এটা সম্ভব নয়।’

রোকেয়া রহমানের না হয় জরুরি কাজ ছিল না। কিন্তু তেজগাঁও কলেজের ছাত্র আসাদের তো মিরপুর ১১ নম্বরের বাসায় না ফেরার উপায় নেই। তাই ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষার পর গায়ের জোর খাটিয়ে ঝুলে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছে তাকে।  ছেলেরা না হয় এভাবে গেল, মেয়েদের কী হবে? কল্যাণপুরের যাত্রী লাবণী দীর্ঘ অপেক্ষার পর ক্লান্ত হয়ে অবশেষে কিছুদূর হেঁটে গিয়ে রিকশা নিতে বাধ্য হলেন।

১০ নভেম্বর থেকে নগরীর প্রতিটি মোড়েই একই দশা। গন্তব্যে যাওয়ার পর পর্যাপ্ত যানবাহন না পেয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে মানুষ। রাজধানীর পাশাপাশি সারা দেশেই হঠাৎ শুরু হয়েছে যানবাহন সংকট। ফিটনেসবিহীন গাড়ি আর লাইসেন্স না থাকা চালকদের বিরুদ্ধে বিআরটিএর অভিযান শুরুর পর থেকেই এই দশা হয়েছে। জরিমানা বা জব্দের ভয়ে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন বের করছেন না মালিকরা। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, জনভোগান্তির জন্য একাধিকবার ক্ষমা পর্যন্ত চেয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তবে এই অভিযান চালু থাকবে জানিয়ে তিনি ভবিষ্যতের কথা ভেবে সাময়িক এই কষ্ট মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দেশবাসীকে।

দেশজুড়ে পরিবহন খাতে দীর্ঘদিন ধরেই দানা বেঁধেছে নৈরাজ্য। যাত্রী সেবা বা গাড়ির মানের যেন কোনো বালাই নেই। ভেতরের আসন আরামদায়ক নয়, পরিবেশও নোংরা, পাখাগুলো কবে নষ্ট হয়েছে তার ঠিক নেই, কখনো কখনো দেখা যায় জানালার কাচও ভাঙা। গাড়িগুলোর নিরাপত্তাও কতটুকু ভালো তা পরীক্ষা-নিরীক্ষারও কোনো উদ্যোগ নেয় না মালিকপক্ষ। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ত্যক্ত-বিরক্ত দেশবাসী যন্ত্রণা সয়েই চড়তে বাধ্য হচ্ছে এসব যানবাহনে।

আবার চালকদের একটি বড় অংশেরই নেই যথাযথ প্রশিক্ষণ। খোদ রাজধানীতেই দেখা মেলে অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকের। সঠিক নিয়মকানুন না মেনে গাড়ি চালানোয় প্রতিদিন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ।

এই সমস্যা একদিনে তৈরি হয়নি। সড়ক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা আর দুর্নীতি এবং পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের শ্রমিক সংগঠনের ঘুষ-বাণিজ্যের কারণে ন্যূনতম সেবা আর নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে চলাচলের সংস্কৃতি চালু হয়েছে পরিবহন খাতে। আর বেশ কয়েক দফা হুঁশিয়ারি দিয়ে ১০ নভেম্বর থেকে দেশজুড়ে অভিযানে নেমেছে সরকার।

আর এই অভিযানের ফলে অর্ধেকেরও বেশি গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তায় সব ধরনের গাড়ির উপস্থিতিই অনেকটা কম দেখা গেছে। তাই যাত্রীদের পড়তে হয়েছে নানা বিড়ম্বনায়। অনেকে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছেন অনেকটা পথ। সড়কে বাস-মিনিবাস কম সংখ্যায় চলাচল করায় অফিস-আদালত, কল-কারখানা ও স্কুল-কলেজে যাতায়াতকারীরা বাদুড় ঝোলা হয়ে আসা-যাওয়া করছে।

রুট পারমিট এবং ফিটনেসের কাগজপত্রে সামান্য ত্রুটি থাকায় মামলা ও ঝামেলার ভয়ে অনেকেই বাস-মিনিবাস নামায়নি। কর্তৃপক্ষের দাবি, অভিযানের ফলে রাস্তায় কমে গেছে অবৈধ গাড়ির সংখ্যা। এদিকে গণপরিবহন সংকটে পড়তে হয়েছে রাজধানীবাসীকে। তবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, পরিবহন সংকট দূর করতে ঢাকায় ২৫০টি গাড়ি নামাবে বিআরটিসি।

মন্ত্রী জানান, মহাসড়কে ও ব্যস্ত রাস্তায় নসিমন-ভটভটির মতো অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করতেও ব্যবস্থা নিচ্ছেন তারা। আর রাজধানীতে পর্যায়ক্রমে নামবে বিআরটিসির বাসগুলো। যানবাহন কমে যাওয়ায় আবার তৈরি হয়েছে অন্য সমস্যা। এই সুযোগে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অতিরিক্ত টাকা দিতে যাত্রীদের বাধ্য করার অভিযোগও পাওয়া গেছে। আবার কৃষিপণ্য পরিবহনেও তৈরি হয়েছে সমস্যা। কারণ গ্রাম এলাকায় মূলত নসিমন-করিমন দিয়ে ফসল বাজারজাত করা হয়। এই গাড়িগুলো চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাজারে পণ্য পরিবহনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দুর্ঘটনা ও অসহনীয় যানজট থেকে পরিত্রাণের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয়ের নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১০ নভেম্বর থেকে ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও লাইসেন্সবিহীন চালকের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এই মুহূর্তে ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত ক্ষুদ্র যানবাহনগুলোকে মহাসড়ক থেকে সরিয়ে ফিডার রোডগুলোতে রাখার জন্য জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও বিআরটিএকে নির্দেশ দেওয়া আছে।

ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, যশোরসহ বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে বাস সংকটে পড়ে সাধারণ মানুষ এখন ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। তারা বলছেন, যেভাবে অভিযানের কথা বলা হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে পরিবহন সংকটে সাধারণ মানুষ নাজেহাল হবে।  

যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে সরকারকে কঠোর হওয়ার বারবার তাগিদ দিয়েছেন যাত্রী থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞরাও। কিন্তু অভিযান শুরুর পর ভোগান্তিতে পড়া যাত্রীরা এখন তাদের কিছুটা সময় দেওয়ার দাবি তুলছেন।

জামাল নামে এক যাত্রী বলেন, ‘বিকল্প ব্যবস্থা না করে এমন কঠোর সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হলো তা বুঝতে পারছি না। সরকারের উচিত হবে জনগণের কথা বিবেচনা করে আগে বিকল্প ব্যবস্থা, এরপর অভিযান জোরদার করা। আমরাও চাই রাস্তায় অবৈধ গাড়ি যাতে একটিও না থাকে। তবে তা সিস্টেম মতো হতে হবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ শওকত আলী এই সময়কে বলেন, মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার জন্যই অভিযান। আর আমাদের এ অভিযান চলবে।’

শওকত আলী বলেন, ‘অভিযানে মানুষের সাময়িক দুর্ভোগ হচ্ছে। তাদের দুর্ভোগ কমাতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছি। আগামী দু-একদিনের মধ্যে মতিঝিল থেকে উত্তরা রুটে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস চলাচল শুরু হবে। পর্যায়ক্রমে আরও বাস নামানো হবে।’

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বিআরটিএ এই রকম অভিযান আগেও চালিয়েছে। কিন্তু কয়েকদিন পরই আগের অবস্থায় ফিরে গেছে।  সরকারি কর্তৃপক্ষ আইন মানতে বাধ্য না করায় এমনটি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল করে এটা বিআরটিএর ব্যর্থতা। তাদের ব্যর্থতার কারণে এখন এর মাশুল দিচ্ছে সাধারণ মানুষ।

যাত্রী ভোগান্তির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকার বিকল্প চিন্তা না করেই এ অভিযান পরিচালনা করছে। তাদের দীর্ঘমেয়াদি অভিযানের কারণে ফিটনেসবিহীন অনেক গাড়িই রাস্তায় নামছে না। এতে সরকার ও পরিবহন মালিকদের মধ্যে ‘ইঁদুর-বিড়াল দৌড়’ হচ্ছে। অভিযান শেষ হলে এই ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো আবারও রাস্তায় নামবে। আর যদি এই অভিযান দীর্ঘমেয়াদি হয় সাধারণ মানুষ আরো ভোগান্তিতে পড়বে।’

এ সমস্যার সমাধান কি? জানতে চাইলে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে অভিযান পরিচালনা করলে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। ফিটনেসহীন গাড়ির ব্যাপারে বিআরটিএর আগে থেকেই উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত ছিল। বিআরটিএর মোবাইল কোর্ট ও ট্রাফিক বিভাগ যদি আগেই যে সব গাড়ি ফিটনেস ছাড়া চলছিল তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত তাহলে এ সমস্যা হতো না। পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা রক্ষায় আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে ধীরে ধীরে।’

নাম না প্রকাশের শর্তে এক পরিবহন মালিক বলেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ি এতদিন চলেছে প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায়। তারা যদি তখন থেকেই একেকটি মহানগরী ভাগ করে অভিযান শুরু করত তাহলে এতদিন ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা এমনিতেই কমে যেত। থাকত না একজন অবৈধ চালকও। তিনি আরও বলেন, ঢাকার রাস্তায় এখন বিআরটিসির বাস দেখা যাচ্ছে অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি। তারা এখন একচেটিয়া ব্যবসা করছে। অথচ ওই গাড়িগুলোর বেশির ভাগের ফিটনেস নেই। চটলা উঠে গেছে। পাদানি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। তাহলে সেগুলো ঢাকার রাস্তায় কিভাবে চলাচল করছে?

বিআরটিএর তথ্য মতে, দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ২১ লাখ ৫ হাজার ১৪০টি। মোটরসাইকেল বাদে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৯ লাখ ৭৪ হাজার ৭৩৫টি। সড়ক-মহাসড়কে চলাচলকারী এসব যানবাহনের মধ্যে ৩৩ শতাংশেরই নেই কোনো ফিটনেস সনদ। ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ১৩ হাজার। এর মধ্যে খোদ রাজধানীতেই ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ৯৩ হাজার ৬০৪টি।



-সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।