ঢাকাঃ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের রাস্তায় ৫০টির মতো অ্যাম্বুলেন্স সারি সারি সাজানো। হাতেগোনা দু-একটা ছাড়া বাকিগুলোর অবস্থা নাজেহাল। এর মধ্যে বেশির ভাগই মাইক্রো বা মালামাল টানার ছোট গাড়ি থেকে অ্যাম্বুলেন্স বানানো হয়েছে। ভালো মানুষ দেখলে উঠতে চাইবে না- এমন পরিবহনগুলোকে অতিলাভের আশায় অ্যাম্বুলেন্স বানানো হয় অনুমোদন ছাড়াই। তাও গায়ে নাম, ওপরে লালবাতি, সাইরেন হর্ন ও ভেতরে রোগীকে শোয়ানোর জন্য কোনোমতে একটা সিট জুড়ে দিতে পারলেই হলো, ব্যস অ্যাম্বুলেন্স হয়ে গেল। এখন দিব্যি পুরো দেশ চষে বেড়াবে ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনগুলো। যানজটে দীর্ঘক্ষণ আটকে না থাকা, ট্রাফিক পুলিশের হয়রানি থেকে মুক্তি, মাঝেমধ্যে মাদক চোরাচালানের সুবিধাও মেলে শুধু নাম পরিবর্তনেই। এই চিত্র ঢাকাসহ সারা দেশের।
‘ইঞ্জিন আর চাকা ঠিক থাকলেই চলে। আর কিছু লাগে না। পুলিশেও ধরে কম। আটইকালে দুই-চার পাঁচ শ হাতে গুইজা দিলেই ছাইড়া দেয়। অ্যাম্বুলেন্স তো, ঝামেলা কম।’ ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায় কথা হচ্ছিল বাদশার সঙ্গে। তার নিজের একটি ছোট্ট গাড়ি আছে। কথা বলার সময় ওই গাড়ির ইঞ্জিন মেরামতের কাজ করছিলেন তিনি।
বাদশার গাড়িটিতে ঢোকার রাস্তা একটাই, পেছনের দিকের ঝাঁপ খুলে। দুই পাশের দরজাগুলো একেবারে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে অ্যাম্বুলেন্স করার সুবিধার্থে। ভেতরে রোগীকে নেওয়ার জন্য স্টিলের আলাদা একটা ট্রে তৈরি করা হয়েছে। অন্য পাশে দুজনের বসার সিট। যিনি শুয়ে থাকবেন তার অবস্থা যেমন তেমন, যারা বসবেন তাদের মেরুদ- সোজা রাখার সুযোগ নেই। ভেতরের অবস্থা সদরঘাট হলেও বাইরে রং করে ফিটফাট রাখার চেষ্টা হয়েছে। গায়ে লেখা, ‘২৪ ঘণ্টা রোগী সেবায় নিয়োজিত।’
এটা তো মালামাল টানার গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স করলেন কীভাবে? প্রশ্ন করতে একটু ঘাবড়ে গেলেন বাদশা। ইঞ্জিনের ময়লা-কালি মাখা হাতে কপাল মুছে বললেন, ‘কী করমু ভাই। আমার যা সাধ্য তাই তো কিনছি।’ অ্যাম্বুলেন্স করতে অনুমোদন লাগেনি? ‘গাড়ির অনুমোদন আছে। আগে এটা দিয়া নবাবপুরে মালামাল টানত। আমি কিনছি পুরানো। তারপর অ্যাম্বুলেন্স বানাইছি।’ কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সের জন্য বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) অনুমোদন লাগে...। ‘আমি জানি না ভাই। আমারে কেউ কোনো দিন বলে নাই।’ বলেই আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ইঞ্জিন মেরামতের কাজে। এরই মধ্যে বেজে উঠল বাদশার সহকারী মোখলেসের মুঠোফোন। কথা শেষে মোখলেস বললেন, ‘ওস্তাদ নতুন খ্যাপ। মহাখালী কলেরা হাসপাতাল যাইতে হইব। ভাড়া চারশ মিটাইছে।’
নতুন যাত্রী কে মিটিয়েছে জানতে চাইলে মোখলেস জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেতর তাদের লোক আছে। বাদশার তথাকথিত অ্যাম্বুলেন্স ঢাকা থেকে ফরিদপুরেও নাকি যায়। তবে ভাড়া সাত হাজার টাকা।
বিআরটিএর তথ্য মতে, ঢাকায় অনুমোদিত অ্যাম্বুলেন্স আছে এক হাজার ৬৮৬টি। অথচ চলাচল করে দুই হাজারের বেশি অ্যাম্বুলেন্স। অনুমোদন ছাড়াই চলছে পাঁচ শতাধিক অ্যাম্বুলেন্স। এছাড়া অক্সিজেন, ফাস্ট এইড বক্স, স্যালাইন, প্রেসার মাপার যন্ত্র, অ্যান্টিসেপটিক, গজ, ব্যান্ডেজ ও লাইফ সেভিং ওষুধ রাখা অত্যাবশ্যকীয় হলেও বেশির ভাগ অনুমোদিত অ্যাম্বুলেন্সও তা মানছে না। এগুলো তদারকিতে কড়া নজরদারির ব্যবস্থাও নেই।
অনুমোদনহীন অ্যাম্বুলেন্স চলাচলের কথা স্বীকার করেছেন জান্নাতুল অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের চালক সোহাগ। তিনি নিজেও আগে এক মালিকের গাড়ি চালাতেন। যার পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্স। কিন্তু অনুমোদন ছিল একটির। অবৈধ এসব অ্যাম্বুলেন্সের জন্য বৈধদের পোহাতে হয় নানা ঝামেলা। জানতে চাইলে সোহাগ বলেন, ‘বোঝেন না ভাই? যাদের ক্ষমতা আছে তারাই তো গায়ের জোরে আইন ভাঙেন। আগে তাদের গাড়ি ভাড়া পাবে এরপর অন্যদের। এর ব্যতিক্রম হলে নানাভাবে হয়রানি হতে হয়।’
এবার সন্ধান ক্ষমতার। কিসের ক্ষমতায় রোগীদের জীবনকে জিম্মি করে বাণিজ্য করছে অসাধুরা? অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোকে ঘিরে অ্যাম্বুলেন্সের বড় ধরনের বাণিজ্য গড়ে উঠেছে। যার সঙ্গে জড়িত হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মচারী নেতা, শ্রমিক নেতা ও রাজনীতিকরা। দিনের পর দিন এসব অসাধুচক্রের খপ্পরে পড়ে হয়রানি হতে হয় রোগী ও স্বজনদের। অ্যাম্বুলেন্সের নামে ভাঙাচোরা দুর্বল গাড়িতে চড়ে প্রাণদ- পেতে হয় রোগীকে। আবার ফিটনেসবিহীন এসব গাড়ি পথের মধ্যে নষ্ট হয়ে পড়লে ভোগান্তির যে শেষ থাকে না, যারা বিপদে পড়েন তারাই বোঝেন।
রাজধানীর হাতেগোনা কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালের ভালো অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস আছে। কিন্তু বেশির ভাগ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থাপনা ছেড়ে দেন বেসরকারি ব্যবসায়ীদের হাতে। যাদের কাছে মানবিকতা নয়, ব্যবসাটাই মূল। ভাড়া আদায়ের সময় তারা কোনো নিয়মকানুন মানেন না। যে যেভাবে পারছেন সেভাবেই আদায় করছেন ভাড়া। ঢাকার মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স ভেদে তিন শ থেকে পাঁচ হাজার পর্যন্ত ভাড়া আদায়ের নজির আছে অ্যাম্বুলেন্স-চালকদের। কে কত টাকা ভাড়া পেলেন তা নজরদারি করারও কেউ নেই। সরকারকেও দেন না কোনো কর।
ঢাকার শাহবাগের বারডেম হাসপাতাল থেকে বাবাকে নিয়ে ইস্কাটনে হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন জুয়েলের সঙ্গে। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স থেকে মুমূর্ষু বাবাকে নামাতে পারছেন না। বাগ্্বিত-া চলছে চালক দবিরের সঙ্গে। কারণ জানতে চাইলে জুয়েল বলেন, ‘কেমন অবিবেচক দেখেন ভাই। বারডেম থেকে পাঁচ মিনিটে এখানে এসেছি। অথচ চালক ভাড়া চাইছেন এক হাজার টাকা। এটা কি কোনো কথা হলো। দেশে কি আইন বলতে কিছু নেই?’ চালক দবিরের পাল্টা যুক্তি, ‘এই অ্যাম্বুলেন্স যেনতেন না। এখানে রোগী তুললেই হাজার টাকা দিতে হয়। এক পয়সাও কম হইব না।’ শেষে অনেক দরকষাকষির পর ৯০০ টাকা দিলে দবিরের কাছ থেকে রেহাই মেলে জুয়েলের।
কিন্তু জুয়েলের প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? বিআরটিএর উপপরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) শেখ মো. মাহবুব-ই রাব্বানী জানান, বিআরটিএ শুধু অ্যাম্বুলেন্সের অনুমোদন দেয়, ভাড়া ঠিক করে দেয় না। এমনকি অ্যাম্বুলেন্সের লাইসেন্স দেওয়ার জন্য কোনো আইন বা বিধিমালাও নেই। তিনি বলেন, ‘সাধারণ যানবাহনের মতো ফিটিংস এবং ফিটনেস যাচাই করেই অ্যাম্বুলেন্সের লাইসেন্স দেওয়া হয়। তবে আমদানি কর, রুট পারমিট এবং আনুষঙ্গিক কিছু ভ্যাট আদায় করা হয় না। সব ধরনের পরিবহনের মতোই এ লাইসেন্স দেওয়া হয় বিআরটিএ বিধি ১৯৪০ অনুযায়ী।’
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও অসন্তুষ্ট দেশের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থাপনা নিয়ে। তাদের অভিযোগ, সরকার এ বিষয়টিকে খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে না। এ ব্যাপারে আলাদা কোনো নীতিমালাও করছে না। নতুন স্বাস্থ্যনীতিতেও এ ব্যাপারে কিছু বলা নেই। এভাবে লাগামহীন অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার গলার ঘণ্টা কবে বাঁধা হবে, এই প্রশ্ন তাদের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক রাশিদ-ই মাহবুব বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর। সেখানে রোগীকে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেওয়ার সব ব্যবস্থা থাকে। কারণ, পথে যেন রোগীর কোনো সমস্যা না হয়। অথচ বাংলাদেশে বেশির ভাগ অ্যাম্বুলেন্সে রোগী তোলা আর সাধারণ যাত্রী পরিবহনে রোগী তোলা একই কথা। কোনোটাই মানসম্মত নয়। প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া তো দূরে থাক, রোগীকে অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থাও নেই বেশির ভাগ অ্যাম্বুলেন্সে।’
কোনো ধরনের নীতিমালা না থাকায় অ্যাম্বুলেন্সগুলো যাচ্ছেতাই ভাড়া আদায় করছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক এই সভাপতি বলেন, ‘ঢাকার সিএনজিচালিত অটোরিকশা, টেক্সিক্যাব আর অ্যাম্বুলেন্স সবই এক। এরা সুযোগ বুঝে রোগীদের জীবন জিম্মি করে স্বাভাবিকের চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি ভাড়া আদায় করেন। তাদের কাছে রোগীর সেবা বা মানবতার সেবা নয়, টাকাটাই মূল। যে কারণে, মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার মতো ব্যবসায় নেমেছেন তারা।’
রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট, কিডনি হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক, নিউরোসায়েন্স, ক্যান্সার ইনস্টিটিউট হাসপাতাল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিন কয়েক শ অ্যাম্বুলেন্স অপেক্ষায় থাকে রোগীর জন্য। যেগুলোর বেশির ভাগই সাধারণ যাত্রী তোলার উপযোগী নয়। অথচ তোলা হয় রোগী। এসব হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের যাত্রী ঠিক করে দেওয়ার জন্য আছে দালাল। এই দালালরাই সুযোগ বুঝে রোগীদের বেকায়দায় ফেলেন। বিনিময়ে অ্যাম্বুলেন্স মালিকদের কাছ থেকে কমিশন পান তারা।
যেকোনো সরকারি কিংবা বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতালের অধীনে অ্যাম্বুলেন্সের অনুমোদন নিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, হাসপাতালগুলো নিজেদের নামে একাধিক অ্যাম্বুলেন্সের অনুমোদন নিয়ে তা বিক্রি করে দেয় অন্যের নামে। আবার বিভিন্ন হাসপাতালের সামনের রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স পার্ক করে রাখার কারণেও ভাড়া গুনতে হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ থেকে শুরু করে ঢাকার সব হাসপাতাল এলাকাতেই চলে এই বাণিজ্য। মানবসেবা অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের চালক ইকবাল জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স রাখার জন্য সপ্তাহে গাড়িপ্রতি ২০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। ওই রাস্তায় দৈনিক কমপক্ষে ৬০টি অ্যাম্বুলেন্স পার্ক করে রাখা হয়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত স্থানীয় শ্রমিক নেতারা এসব ভাড়া আদায় করেন বলে জানা গেছে।
শুধু রোগী পরিবহনই নয়, ইদানীং অ্যাম্বুলেন্সের অনেক অপব্যবহারও বেড়েছে। হরতাল-অবরোধে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছতে অনেকে বেছে নেন অ্যাম্বুলেন্স। ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এ ধরনের কাজে জড়িয়েছেন, এমন নজির আছে। সন্ত্রাসীরাও আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে যাতায়াতের জন্য বেছে নেয় রোগী পরিবহন। যেকোনো রাজনৈতিক কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকে অ্যাম্বুলেন্স। রোগীর গাড়ির হুইসেল শুনেই পথ ছেড়ে দেয় সবাই। অথচ রোগীর পরিবর্তে দিব্যি ভালো মানুষ শুয়ে থাকেন বিশেষ ওই পরিবহনে।
লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ির রমরমা বাণিজ্য
গায়ে বাংলা কিংবা ইংরেজিতে ‘অ্যাম্বুলেন্স’ লেখা ও ওপরে লালবাতি ও সাইরেন হর্ন লাগানো থাকলেও অনুমোদন নেই বেশির ভাগেরই। এ ব্যাপারে কড়া নজরদারিও নেই। যে কারণে যাচ্ছেতাই পরিবহন দিয়ে বানানো হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স। এসব পরিবহনের ভালো মানুষ উঠলেই অসুস্থ হওয়ার জোগাড়। সেখানে লক্কড়-ঝক্কড় গাড়িতে টানা হয় মুমূর্ষু রোগী। অপরিকল্পিত এসব অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয় রোগীদের।
রোগীর স্বজন ভুক্তভোগীরা বলছেন, অ্যাম্বুলেন্সের জন্য সরকারের কোনো নীতিমালা না থাকায় এদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। যে যেভাবে পারছেন টাকা আয়ের চিন্তা করছেন। অথচ মানবসেবার কথা চিন্তা করে এসব পরিবহনের অনুমোদন থেকে শুরু করে চলাচলের পথ পর্যন্ত সহজ করে দেওয়া হয়। অ্যাম্বুলেন্স লেখা দেখলে ট্রাফিক পুলিশ ওই গাড়ি আটকান না। সব ধরনের করও মওকুফ করা হয়। অথচ এই সুবিধার কোনো সুফল মিলছেন না রোগীদের। সবই যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের পকেটে।
বিভিন্ন হাসপাতালে সরেজমিনে ঘুরে ও সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা এ ব্যবসায় জড়িত। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি হাসপাতালের মর্গ থেকে মরদেহ নেওয়ার সময় ওই হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার না করলে মর্গ থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয় না। আবার ভাড়ার ক্ষেত্রেও গুনতে হয় অতিরিক্ত টাকা। মাত্র ২০ কিলোমিটার অ্যাম্বুলেন্সে যেতে একজন রোগীর জন্য গুনতে হয় পাঁচ হাজার টাকা।
বিভিন্ন গ্যারেজ সূত্রে জানা গেছে, অব্যবহৃত মাইক্রোবাসগুলোই মেরামত করে অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এসব অ্যাম্বুলেন্সের নেই ফিটনেস সার্টিফিকেট, নেই রুট পারমিটের স্টিকার, অক্সিজেন, ফাস্ট এইড বক্স। শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সগুলোকেও ব্যবহার করে সরকারি হাসপাতালগুলো।বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের দালালদের ভিজিটিং কার্ডেও ঠিকানা থাকে বড় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের। এ ব্যবসা মূলত চালু রাখে দালালরা। তারা হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে মুমূর্ষু রোগীদের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে এবং সময় বুঝে যাত্রীদের চিনে ফেলে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে দিন-রাত সব সময় দাঁড়িয়ে থাকে অ্যাম্বুলেন্স। ২০-২৫টি অ্যাম্বুলেন্সে যাত্রী ঠিক করার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে ২০-২৫ দালাল। রোগী নিয়ে শুরু হয় টানাটানি।
অ্যাম্বুলেন্সে যখন চিকিৎসক-কর্মকর্তাদের বাহন
সরকারি হাসপাতাল ও দপ্তরগুলোতে অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয় রোগী আনা-নেওয়ার জন্য। অথচ সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের বেশির ভাগই চিকিৎসক ও কর্মকর্তাদের আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়। এগুলো রোগীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট থেকে শুরু করে সরকারি সব হাসপাতালেই কম বেশি এ ধরনের কাজ হয়। এছাড়া প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়েও এমন কা- ঘটে। সচিবালয়ের হাসপাতালের জন্য বরাদ্দ করা অ্যাম্বুলেন্সটি ব্যবহার হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ওই হাসপাতালের কর্মকর্তাদের আনা নেওয়ার কাজে।
সূত্র জানায়, ঢাকা মেডিকেলে আড়াই হাজার রোগীর জন্য আছে চারটি অ্যাম্বুলেন্স। এই হাসপাতালে ১০টি অ্যাম্বুলেন্স ছিল। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও তেলের অভাবে বাকি গাড়ি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। সিএমএসডি থেকে সরবরাহ করা একটি অ্যাম্বুলেন্স পড়েছিল অনেক দিন, যার মূল্য প্রায় ১৭ লাখ টাকা। তবে বেশির ভাগ সময় অ্যাম্বুলেন্সগুলো হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার-পরিজনের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণেই হাসপাতাল চত্বরে গড়ে উঠেছে অবৈধ অ্যাম্বুলেন্সের রমরমা ব্যবসা।
কয়েক বছর আগেও অ্যাম্বুলেন্সে রোগী আনা-নেওয়া না করেই প্রতি মাসেই ৩০ হাজার টাকা হাসপাতাল ফান্ড থেকে তোলা হয়। বর্তমানে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স থেকে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাড়ি শাখার প্রধান মো. নাসির উদ্দিন নান্নু। তিনি জানান, ঢাকা মেডিকেলের চারটি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি অ্যাম্বুলেন্স চলছে। এগুলো ভাড়ায় চালানো হয়। ঢাকা শহরের যেকোনো স্থানে গেলে ভাড়া ৩০০ টাকা। প্রতি সপ্তাহে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার টাকাগুলো ঢাকা মেডিকেলের অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হয়। অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৪০ হাজার টাকা জমা হয়।
অথচ রোগীদের অভিযোগ, সরকারি এই অ্যাম্বুলেন্স কখনোই পান না তারা। কম টাকায় সরকারি অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় এই তথ্যও নেই অনেকের কাছে।
নেই আইন, লাগে না কর
সাধারণ পরিবহনের লাইসেন্স পেতে যাও ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়, অ্যাম্বুলেন্সের বেলায় তা নেই বললেই চলে। রোগী পরিবহনের কথা চিন্তা করে যত ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে সবই দেওয়া হয় অ্যাম্বুলেন্সকে। এমনকি রুট পারমিট, আমদানি কর ও আনুষঙ্গিক কিছু কর ছাড়াই মেলে অ্যাম্বুলেন্সের লাইসেন্স। রোগী পরিবহনের অনুমোদন পাওয়ার জন্য এখনো আলাদা কোনো বিধিমালা বা আইন করা হয়নি। ভাড়া নিয়ন্ত্রণেও নেই কোনো ব্যবস্থা। যে কারণে অ্যাম্বুলেন্স মালিকরাও ইচ্ছামতো ভাড়া নির্ধারণ ও আদায় করছেন মানুষের কাছ থেকে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীতে বিভিন্ন ধরনের অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এর মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধাসংবলিত কিছু অ্যা¤ু^লেন্স রয়েছে। তবে রাজধানীর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে রোগী পরিবহনে এসব অ্যাম্বুলেন্সের জন্য গুনতে হয় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। অন্যদিকে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা তথাকথিত অ্যা¤ু^লেন্স সার্ভিসগুলোতে চলে স্বেচ্ছাচারিতা। রোগীর অবস্থা যত মুমূর্ষু হবে এসব অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া ততই বাড়তে থাকবে। তবে দূরত্ব যতই কম হোক হাজার টাকার নিচে এসব অ্যা¤ু^লেন্সের চাকা ঘোরে না বলে জানা গেছে।
কম টাকায় অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস দিচ্ছে আদ্্-দ্বীন হাসপাতাল। কিন্তু তাদের অ্যাম্বুলেন্সের মান মোটেও ভালো নয় বলে অভিযোগ রোগীদের। তার ওপর যেসব গাড়িকে অ্যাম্বুলেন্স বলে চালানো হচ্ছে এগুলো মালামাল বহন করার জন্য তৈরি করা। কিন্তু ছোট ছোট এসব গাড়িতে লালবাতি, সাইরেন হর্ন ও গায়ে অ্যাম্বুলেন্স লিখে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে রোগী পরিবহন হিসেবে। গরিবের একমাত্র অবলম্বন আঞ্জুমান মুফিদুুল ইসলামের অ্যাম্বুলেন্সের খরচ ১০০ টাকা। তবে চাহিদা বেশি থাকায় এবং পরিবহনের সংখ্যা কম হওয়ায় আঞ্জুমানের অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া কিছুটা কষ্টকর।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে থাকেন নাজমা আক্তার। গত ২ নভেম্বর হঠাৎ তার সাত বছরের ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। রাত তখন দুইটা। এত রাতে কীভাবে হাসপাতালে নেবেন ছেলেকে এই চিন্তায় নাজমার হাত-পা ঠা-া হয়ে আসছিল। এমন সময় পাশের ফ্ল্যাটের একজন প্রতিবেশীর দেওয়া নম্বরে ফোন করে বাড়িতে অ্যাম্বুলেন্স খবর দেন। কিন্তু যেই অ্যাম্বুলেন্স ফোন করে তিনি ডেকে এনেছেন তাতে নেই কোনো অক্সিজেন, প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম। তার পরও ছেলেকে নিয়ে বেসরকারি একটি হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেন। কিন্তু পথিমধ্যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ছেলে। বেড়ে যায় মায়ের দুশ্চিন্তা। হাসপাতালে যাওয়ার পর চিকিৎসকদের কথা শুনে নিজেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ার অবস্থা হয় নাজমার। কারণ, চিকিৎসকরা জানান, আর মিনিট পাঁচেক সংজ্ঞাহীন থাকলে এই রোগীকে বাঁচানো কঠিন হতো। শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই অক্সিজেন লাগিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসা জরুরি ছিল।
নাজমার মতো অনেককেই প্রতিনিয়তই এমন মৃত্যু ঝুঁকিতে ঠেলে দিতে হয় প্রিয়জনকে। কারণ, একটাই দেশের অ্যাম্বুলেন্সের অব্যবস্থাপনা।
অপব্যবহারও হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সের
অ্যাম্বুলেন্সের অনেক অপব্যবহারও হচ্ছে। ইদানীং নিরাপদ যানবাহন হিসেবে অ্যাম্বুলেন্সকে বাহন হিসেবে বেছে নিচ্ছেন ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, সন্ত্রাসী, অভিনেতারা। মাদক চোরাচালানের মতো গুরুতর অপরাধেও ব্যবহার হচ্ছে রোগী পরিবহন। সূত্রে জানা গেছে, দেশের রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যেও অ্যাম্বুলেন্স থাকে সব কিছুর আওতামুক্ত। যে কারণে ব্যবসায়ীরা বেতনের টাকা বহন থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কারখানায় যাতায়াত, অফিস পাড়ার জরুরি মিটিং, ফ্লাইট ধরতে বিমানবন্দরে পৌঁছানো কিংবা বিদেশ থেকে ফেরার পর বিমানবন্দর থেকে বাসায় ফেরার ক্ষেত্রে আজকাল অ্যাম্বুলেন্সকেই নিরাপদ বাহন হিসেবে বেছে নিয়েছেন বিপুলসংখ্যক সামর্থ্যবান মানুষ। আর সে কারণেই রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন মহানগরী ও বড় বড় শহরগুলোতে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা এখন দারুণ জমজমাট। সুযোগ বুঝে অ্যাম্বুলেন্সের মালিকরা হাতিয়ে নিচ্ছেন স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৩-৪ গুণ ভাড়া। বাড়তি চাহিদার কারণে অনেক অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ী নিজেদের বহরে যুক্ত করছেন নতুন নতুন অ্যাম্বুলেন্স।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন হাসপাতাল এবং ক্লিনিকের নিজম্ব অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস ছাড়াও রাজধানী ঢাকায় বেশ কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালু রয়েছে। এর মধ্যে আলিফ আপনজ, ডে-নাইট, গ্রিন, রাফা, শেফা, সাগর অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস অন্যতম। এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসাপতাল, আগারগঁাঁও পঙ্গু হাসপাতাল এবং মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতাল এলাকায় বেশ কিছু ভাসমান অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস রয়েছে।
স্বাভাবিক সময়ে এসব স্থানে গেলে রাস্তার পাশে অনেক অ্যাম্বুলেন্স অপেক্ষমাণ দেখা যায়। কিন্তু বিরোধী দলগুলোর অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচির কারণে আজকাল এসব স্থানে গেলে কোনো অ্যাম্বুলেন্সকে অপেক্ষমাণ থাকতে দেখা যায় না। এমনকি বিভিন্ন হাসপাতাল এবং ক্লিনিকের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্সগুলোও হরতাল-অবরোধের সময় সার্বক্ষণিক ব্যস্ত থাকে।
রাফা অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা জানান, যেকোনো হরতাল-অবরোধেই অ্যাম্বুলেন্সের চাহিদা বাড়ে। কিন্তু মাস খানেক ধরে বিরোধী দলের টানা কর্মসূচির কারণে এই চাহিদা এখন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। তিনি বলেন, ‘আমরা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া দিই টাকার জন্য। সুতরাং টাকার বিনিময়ে যে কেউই অ্যাম্বুলেস সেবা নিতে পারেন। এই ক্ষেত্রে কোনো বিধি-নিষেধ নেই। তবে ঘন ঘন হরতাল-অবরোধের কারণে অধিকাংশ বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালু করেছে বলে জানান তিনি। ব্যবহারকারীদের চাহিদা বুঝে চার হাজার টাকার জায়গায় ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করছে তারা।
তবে নামমাত্র মূল্যে অ্যাম্বুলেন্স সেবা দানকারী আঞ্জুুমান-ই-মুফিদুল ইসলামের একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের সার্ভিস শুধু হাসপাতাল থেকে বাসা আর বাসা থেকে হাসপাতাল। তাই কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় তাদের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহারের সুযোগ নেই।
উন্নত বিশ্বে রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর। সেখানে রোগীকে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেওয়ার সব ব্যবস্থা থাকে। কারণ, পথে যেন রোগীর কোনো সমস্যা না হয়। অথচ বাংলাদেশে বেশির ভাগ অ্যাম্বুলেন্সে রোগী তোলা আর সাধারণ যাত্রী পরিবহনে রোগী তোলা একই কথা। কোনোটাই মানসম্মত নয়। প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া তো দূরে থাক, রোগীকে অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থাও নেই বেশির ভাগ অ্যাম্বুলেন্সে। কোনো ধরনের নীতিমালা না থাকায় অ্যাম্বুলেন্সগুলো যাচ্ছেতাই ভাড়া আদায় করছে। ঢাকার সিএনজিচালিত অটোরিকশা, টেক্সিক্যাব আর অ্যাম্বুলেন্স সবই এক। এরা সুযোগ বুঝে রোগীদের জীবন জিম্মি করে স্বাভাবিকের চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি ভাড়া আদায় করেন। তাদের কাছে রোগীর সেবা বা মানবতার সেবা নয়, টাকাটাই মূল। যে কারণে, মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার মতো ব্যবসায় নেমেছেন তারা।- সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে