logo ২৯ এপ্রিল ২০২৫
এক নৌযান জরিপকারকের কাণ্ড

গোলাম মোর্তোজা
২৮ নভেম্বর, ২০১৪ ১১:৪৭:২৮
image


পদ্মায় ডুবে যাওয়া পিনাক-৬ ও এমভি মিরাজ লঞ্চের জরিপকারক ছিলেন তিনি। অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছিল ওই নৌযান দুটির নিবন্ধন ও ফিটনেস সনদ দেওয়াতে। নৌযান দুটির নকশা ও স্টাবিলিটি বুকলেট না থাকার পরও মিলেছিল ছাড়পত্র। এই অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের জাহাজ জরিপকারক মির্জা সাইফুর রহমানকে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও চলছে। অনিয়মের অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)।

এই যখন অবস্থা তখন সাময়িক বরখাস্ত আদেশ বাতিল করে কাজে ফেরার তৎপরতা চলছে মির্জা সাইফুর রহমানের তরফে। বরখাস্ত হওয়ার এক মাস ২০ দিনের মাথায় চেষ্টা চলছে আদেশ প্রত্যাহারের। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হাত করে চাকরিতে ফেরার চেষ্টা করছেন তিনি।

সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, মির্জা সাইফুরের সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ জানিয়ে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর এম জাকিউর রহমান ভূঁইয়ার সই করা ওই চিঠি মন্ত্রণালয়ে গেছে ১৩ নভেম্বর। চিঠিটির একটি হুবহু কপি এসেছে আমাদের হাতে।

মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, পিনাক-৬ ডুবির ঘটনায় বিভাগীয় মামলা, নৌ আদালতের বিচারিক কার্যক্রম চলছে। মির্জা সাইফুর রহমানের করা জরিপ ও নিবন্ধন দেওয়া ৫৬টি নৌযানের নথি অনুসন্ধানের জন্য দুদক চেয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়কের ‘জাস্টিজ ডিমান্ড নোটিশ’ পাঠানো হয়েছে।

মির্জা সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি চিঠিতে উল্লেখ করে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘মির্জা সাইফুরের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে তাকে বরিশাল বা খুলনা জরিপ কার্যালয়ে পদায়নের বিষয়ে অনুরোধ করা হলো।’

বিচার চলছে এমন একজনের বরখাস্ত আদেশ বাতিল করে কেন তাকে পদায়নের অনুরোধ করা হলো? জানতে চাইলে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর এম জাকিউর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘জনবল কম থাকায় মির্জা সাইফুরের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে তাকে পদায়নের অনুরোধ জানানো হয়েছে। তবে এ বিষয়ে আইনসম্মত সিদ্ধান্ত নেবে মন্ত্রণালয়।’

অভিযোগ আছে, মির্জা সাইফুর স্বপদে ফেরার জন্য অনেক আগে থেকেই দেন-দরবার করছেন। নৌ-পরিবহন খাতের অসাধু সিন্ডিকেটের সঙ্গেও তার যোগাযোগ-সম্পর্ক রয়েছে। তাদের মাধ্যমে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরকে নানাভাবে চাপ দিয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিতে বাধ্য করা হয়েছে।

তবে এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য মির্জা সাইফুর রহমানের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

গত ৪ আগস্ট মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ঘাটের কাছে পদ্মায় পিনাক-৬ নামের যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবে শতাধিক লোকের  সলিলসমাধি হয়। অনেক ত্রুটি থাকার পরও মির্জা সাইফুর উৎকোচের বিনিময়ে নৌযানটিকে কয়েক দফায় চলাচলের অনুমতি দেওয়ার অভিযোগ আছে। এর আগে গত মে মাসে মুন্সিগঞ্জে এম ভি মিরাজ-৪ নামে আরেকটি লঞ্চ ডুবে ৫৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। ওই নৌযানটিরও জরিপকারক ছিলেন মির্জা সাইফুর।

সূত্র জানায়, পিনাক ডুবির ঘটনায় মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি মির্জা সাইফুর রহমানের অনিয়ম ও দুর্নীতিকে বিশেষভাবে দায়ী করে। পরে গত ২১ সেপ্টেম্বর সাময়িক বরখাস্ত করা হয় মির্জা সাইফুরকে। চালু করা হয় বিভাগীয় মামলা। সুনির্দিষ্ট পাঁচটি অভিযোগ তুলে গত ২ অক্টোবর অভিযোগনামা মির্জা সাইফুরের কাছে পাঠানো হয়। সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর এম জাকিউর রহমান ভূঁইয়ার সই করা ওই অভিযোগনামার বিষয়ে ১০ দিনের মধ্যে জবাব দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু সময় বাড়িয়ে নিয়ে ২২ অক্টোবর অভিযোগের জবাব দেন সাইফুর রহমান। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অভিযোগনামা জবাবসহ নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠান ২৬ অক্টোবর।

দুদক সূত্র জানায়, নৌযান নিবন্ধনে শত শত কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকিসহ মির্জা সাইফুরের বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান গতি পাচ্ছে না। সময়মতো দরকারি নথি না পাওয়ায় তদন্ত কাজে ব্যাঘাত ঘটছে।  দুদকের সহকারী পরিচালক শেখ আবদুস সালাম গত ২১ অক্টোবর ৫৫টি নৌযানের নথি এবং প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক মির্জা সাইফুরের দেওয়া নৌযান নিবন্ধন সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ড ও নথি চেয়ে অধিদপ্তরের কাছে চিঠি দেন। একই সঙ্গে মির্জা সাইফুরের পরীক্ষক হওয়ার সনদসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র চেয়ে পাঠান। ২৯ অক্টোবরের মধ্যে এসব নথি দুদকে সরবরাহের কথা থাকলেও এখনও কোনো নথি দুদকে যায়নি বলে সূত্রে জানা গেছে।

মির্জা সাইফুর রহমান ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরে প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক পদে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকা নদী বন্দরের জরিপকারক হিসেবে কাজ করেন। অভিযোগ আছে, নৌ জরিপ ও নিবন্ধনে ব্যাপক অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। নথিপত্র অনুযায়ী, দেড় বছরের কম সময় দায়িত্বকালে তিনি তিন হাজারের বেশি নৌযান জরিপ করেন। এ হিসেবে প্রতি কর্মদিবসে তিনি গড়ে ১০টি নৌযান জরিপ করেন। ওই নৌযানগুলোর তখন অবস্থান ছিল আরিচা, মাওয়া, সদরঘাট, নারায়ণগঞ্জ, গাবতলী, মেঘনা ঘাট ও ভৈরবে। মির্জা সাইফুর সরেজমিনে জরিপ করেছেন বলে নথিতে উল্লেখ থাকলেও এর সম্ভাব্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। -সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে