তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, কোনো প্রযুক্তির ব্যবহার বন্ধ করে দিয়ে অপরাধ দমনে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। প্রযুক্তির মোকাবিলা প্রযুক্তি দিয়েই করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির বিরুদ্ধে যদি আপনি তলোয়ার নিয়ে মাঠে নামেন তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের পাশাপাশি সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টিও মাথায় রাখা দরকার ছিল। অথচ আমরা এ নিয়ে চিন্তাই করিনি। এখনো দেশে সাইবার অপরাধ আইন করা যায়নি। আইসিটি আইনের নামে যেটা করা হয়েছে সেটা সাইবার অপরাধ দমনের সক্ষম নয়। এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। গত ২১ জানুয়ারি একান্ত আলাপচারিতায় এসব বিষয় তুলে ধরেন বাংলা লেখার সফটওয়ার বিজয়ের জনক। আলাপচারিতায় ছিলেন হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
নিরাপত্তার কারণে ভাইবার, ট্যাঙ্গোর মতো অ্যাপ্লিকেশন্স বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কীভাবে দেখছেন বিষয়টি?
এ সম্পর্কে আমার মন্তব্য হচ্ছে, আপনার মাথা ব্যথা হয়েছে। আপনি মাথাটা কেটে দিয়েছেন। যারা এসব পরামর্শ সরকারকে দিয়েছে বা যারা এটা বন্ধ করেছে তাদের মধ্যে ন্যূনতম প্রযুক্তির জ্ঞান নেই। এটাই তার প্রমাণ।
নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কি আদৌ এসব অ্যাপ্লিকেশন্স বন্ধ করা গেছে?
ভাইবার বন্ধ করার যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তাতে ভাইবার বন্ধ হয়নি। বস্তুত বিটিআরসির ভাইবার বন্ধ করার মতো সক্ষমতা নেই। আপনার যদি কোনো সক্ষমতা না থাকে তাহলে ওই কাজ করবেন না।
এর আগে ইউটিউব বন্ধ ছিল, এখন ম্যাসেজিং অ্যাপ্লিকেশন্স বন্ধ করা হচ্ছে। এতে কী ক্ষতি হচ্ছে?
সরকার জনসমর্থন হারাচ্ছে। সাধারণ মানুষকে ভাইবার ব্যবহার থেকে দূরে রাখার একটা উপায় বের করেছেন। কিন্তু যাদের ব্যবহার করার তারা ঠিকই ব্যবহার করতে
পারছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। আর বকাটা খাচ্ছে সরকার। সরকারের রাজনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে।
এখানে তো রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে আনা হচ্ছে?
আপনি নিরাপত্তার প্রশ্ন যদি বলেন, যারা জ্বালাও-পোড়াও, হানাহানি করছে তারা যাতে ভাইবার ব্যবহার করতে না পারে আপনি সে জন্য ভাইবার বন্ধ করছেন। তারা কি জানে না কেমন করে ভাইবার বিকল্প পথে ব্যবহার করা যায়? ভাইবার বন্ধ করে কোনো অগ্রগতি হয়েছে এটা আমার মনে হয় না।
প্রযুক্তির ক্ষতিকর দিক কি প্রযুক্তির ব্যবহার বন্ধ করে দিয়ে মোকাবিলা করা সম্ভব?
কোনো প্রযুক্তি বন্ধ করে দিয়ে অপরাধ দমনে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। উচিত হলো প্রযুক্তির যে মন্দ দিকগুলো আছে সেগুলো বন্ধ করা। প্রযুক্তির মোকাবিলা প্রযুক্তি দিয়েই করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির বিরুদ্ধে যদি আপনি তলোয়ার নিয়ে মাঠে নামেন তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না।
অপরাধ করলে তো আইন দিয়ে তা মোকাবিলা করা যায়...
আমাদের এখানে দেখা যাচ্ছে, আপনি তথ্যপ্রযুক্তির পক্ষে আইনকানুন নিয়ে হাজির হচ্ছেন এবং সেটা প্রয়োগ করার চেষ্টা করছেন। আমি একেবারে গোড়া থেকেই বলে এসেছি। যখন ফেসবুক, ইউটিউব বন্ধ করা হয় তখনও বলেছি যে, প্রযুক্তির এই বিষয়গুলোকে এমনভাবে হ্যান্ডেল করবেন না, যার ফলে পুরো বিষয়টা হাস্যকর মনে হয়। আমার কাছে এখনো বিষয়টা হাস্যকরই মনে হয়।
কেন হাস্যকর মনে হচ্ছে?
আমি যাদের দেখি তারা এখনো চমৎকারভাবে ভাইবার ব্যবহার করছে। ভাইবারে ম্যাসেজিং এবং কথা বলার বিষয়টা আছে। এ কাজ তো আরও অনেক কিছু দিয়েই করা যায়। যেমন-ফেসবুক, স্কাইপি, জি-মেইল। তার মানে হচ্ছে যারা বন্ধ করেছে তারা এসব সম্পর্কে জানেন না।
তাহলে সরকারের কী করা উচিত ছিল?
এই ক্ষেত্রগুলোর জন্য সরকারের বহু আগে সচেতন হওয়া উচিত ছিল। তবে হ্যাঁ, রাষ্ট্রের স্বার্থে অনেক সময় কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তা কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়ে নয়।
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যমের ওপর নজরদারি তো পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও আছে?
পৃথিবীর সব দেশই নিরাপত্তার স্বার্থে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনিটরিং করে। বাংলাদেশ সরকারও করে। যেমন মোবাইল ফোন রেকর্ড করে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এগুলো করতে পারে।
তাহলে ইন্টারনেটও নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা যেতে পারে?
আপনি ভাইবার নিয়ন্ত্রণ করতে যাবেন কেন? গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ইন্টারনেট করতে আপনার গোয়েন্দা সংস্থার সক্ষমতা বাড়ান। আপনি যদি মনে করেন যে জঙ্গিরা ভাইবার ব্যবহার করছে, তাহলে আপনি এমন একটা পদ্ধতি বের করেন যাতে আপনি তাদের হ্যাক করতে পারেন।
ম্যাসেজিং অ্যাপ্লিকেশন্স বন্ধের পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে?
আমার মনে হয় এক সময় মানুষ মোবাইল ব্যবহার ছেড়ে ভাইবার স্কাইপিতে কথা বলবে। এখনো অনেকে মোবাইলের পরিবর্তে ভাইবারে ম্যাসেজিং বা ভয়েস কল করছেন। তাই মোবাইল অপারেটরগুলো বিটিআরসিকে দিয়ে এটা করিয়েছে কি না সন্দেহ হয় আমার।
জনগণের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে সরকার এসব করছে বলে বলা হচ্ছে...
এগুলো করে জনগণের স্বার্থ বলেন, দেশের স্বার্থ বলেন, ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থ বলেন কোনোটাই রক্ষা হয় না। এগুলো এক রকম হঠকারিতা। আসলে ক্ষতিটা হয় রাজনৈতিক সরকারের। অর্থাৎ গালিটা দিচ্ছে ডিজিটাল সরকারকে। আর সাধারণ জনগণের কথা বলার এ মাধ্যমগুলো বন্ধ করার অধিকার সরকারের নেই।
সাইবার হামলা ঠেকাতে কী ধরনের সক্ষমতা দরকার?
খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা ইউরোপীয় দেশগুলোÑ প্রযুক্তির ব্যবহার যারা সবচেয়ে বেশি করে তারাও মাঝেমধ্যে সাইবার হামলার শিকার হয়। এর সমাধান হচ্ছে সাইবার অপরাধ দমন করার জন্য একটি দক্ষ বাহিনী গড়ে তোলা। এটা অবশ্য রাতারাতি সম্ভব নয়। বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু এর খারাপ দিক মোকাবিলার কোনো চিন্তা নেই।
দেশে তো আইসিটি আইন আছে। এর মাধ্যমে কি অপরাধ দমন সম্ভব?
একেবারেই কমন যে অপরাধগুলো হয় তা প্রতিরোধের জন্য কোনো আইন নেই। যে একটা আইন আছে সেটা ডিজিটাল আইন, সাইবার অপরাধ রোধের আইন নয়। আগে দরকার ছিল আইনটি। ১৯৯৬-৯৭ সাল থেকে সাইবার অপরাধ আইন সম্পর্কে বলে আসছি। তবে আমি আশাবাদী, পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
তাহলে আইসিটি আইনের সুবিধাটা কী পাচ্ছি?
আইসিটি আইনে শুধু রাজনৈতিক সুবিধা হচ্ছে। ২০১৩ সালে আইনে যে সংশোধন আনা হয়েছে তার প্রধানতম লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক। অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক ঘটনাকে এই আইনের আওতায় এনে অ্যাকশনে যাচ্ছে। কিন্তু এটা সাইবার অপরাধকে পরিচয় করিয়ে দেয় না। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে, সর্বনি¤œ সাজা সাত বছর। এ রকম অনেক দিক আছে যেগুলো আইসিটি আইনে থাকা উচিত নয়।
ভাইবার, ট্যাঙ্গো বন্ধের প্রতিবাদে বিটিআরসির ওয়েবসাইট হ্যাক করা হয়েছে...
আসলে বিটিআরসির ক্ষমতা নেই নিজেকে রক্ষা করার। সে আমার দেশ কী করে রক্ষা করবে? তাদের যে দুর্বলতাগুলো আছে এগুলো কাটানোর জন্য বিটিআরসি তৎপর নয়।
কিন্তু এভাবে সরকারি ওয়েবসাইট হ্যাক করা তো রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি
আমি বলতে চাচ্ছি, আমাদের ছেলেপেলেরা খারাপ ছিল না। আপনি তাদের পথে বাধা সৃষ্টি করছেন বলে তারা একটি খারাপ পথ অবলম্বন করে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আপনি ঠেকাতে পারেননি। সুতরাং আমার অনুরোধ, অনুগ্রহ করে সাপের লেজে পা দেবেন না, ওটা ভয়ংকর।
বিটিআরসি তো বিভিন্নভাবে সাইবার অপরাধ দমনের চেষ্টা করছে?
পুরো মোবাইল খাতটা বিটিআরসি পরিচালনা করে কিন্তু তারা সব সিমকার্ড ব্যবহারকারীর পরিচয়ই নিশ্চিত করতে পারে না। এটি সাইবার অপরাধ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। শুধু এই একটি জায়গায় যদি সঠিক কাজটি করা হতো তাহলে সাইবার অপরাধকারীর সংখ্যা অনেক কমে যেত।
এ সব ক্ষেত্রে মূল সমস্যাটা কোথায়?
যদি আপনি পুরো জনগোষ্ঠীকে দেশপ্রেমিক করতে না পারেন তাহলে ক্ষতিটা তো দেশের। মূল সমস্যাটা হচ্ছে মানসিকতা। যে জন্য আমরা বিরানব্বই সালে সাবমেরিন ক্যাবলে ঢুকিনি, শঙ্কা ছিল দেশের সব তথ্য বিদেশে চলে যাবে। সেই মানসিকতা এখনো সরকারের আমলাদের মধ্যে বিরাজ করছে।
তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের পাশাপাশি বিপদও তো বাড়ছে?
আমার পর্যবেক্ষণও তাই বলছে। আগে সই করে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হতো। এখন পাসওয়ার্ড জেনে গেলে টাকা উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এটা তো সমস্যাই। তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের পাশাপাশি মানুষের অনেক নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে।
তাহলে সমাধান কী?
আপনি যতই তথ্যপ্রযুক্তিতে এগুবেন ততই আপনাকে এগুলো মোকাবিলা করতে হবে। এজন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। আমার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা থাকলে তো হবে না। রাষ্ট্রের যদি প্রচেষ্টা না থাকে তাহলে তো উদ্ধার হয়ে আসতে পারব না।
আপনারা এসব বিষয়কে জোরালোভাবে সামনে নিয়ে আসছেন না কেন?
আমাদের পর্যায়ে যে জায়গাগুলো থাকে অ্যাডভোকেসি করার, সে জায়গায় কখনো পিছনে ছিলাম না। যখনই বলার সুযোগ পাই তখনই চেষ্টা করি। এই বিষয়গুলো যেন তাদের নজরে আসে। সমস্যাটা হলো, আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র বড় অদ্ভুত জিনিস।
আমলাতন্ত্রের সমস্যা আসলে কোথায়?
আমলাতন্ত্র তার নিজের মাথার মধ্যে যা ঢোকে সেটাই করে। আপনি যত কথাই বলেন, কোনোটাই তার মাথায় ঢোকে না। এ কারণেই আইসিটি আইনের ভেতরে যেসব অংশ ঢোকানো হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভুল প্রচেষ্টা। উচিত ছিল একটি সম্পূর্ণ নতুন আইন করে তার সব বিষয় পরিচয় করিয়ে দেওয়া। সেটা না করে একটা বিদ্যমান আইন সংশোধন করে সংক্ষেপে একটা পথ বের করা হয়েছে।
সরকার তো তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের ব্যাপারে আন্তরিক?
দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে রাজনীতিকদের সিংহভাগ পরিবর্তনের সঙ্গে পরিচিত নয়। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছে অথচ তারাই ডিজিটাল বাংলাদেশের ওপর একটা সেমিনার এখনো করেনি। এটা না করার কারণ হলো, আওয়ামী লীগের নেতারা ডিজিটাল বাংলাদেশের বিষয়ে কিছু বোঝেন না। যে মন্ত্রীদের কাছে গিয়ে আপনি বলবেন, সে মন্ত্রীই বিষয়টা বোঝেন না। শেষ পর্যন্ত আমলারা যা বোঝান তারাও সেই অনুযায়ী চলতে থাকেন।-সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।