কক্সবাজার: থাইল্যান্ডের পর মালয়েশিয়ায় গণকবর ও বন্দী শিবিরের সন্ধান লাভের পর থেকে কক্সবাজারে মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে আগের চেয়ে বেড়ে গেছে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান। বিজিবি, র্যাব, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের সাঁড়াশি অভিযান আর ক্রস ফায়ার আতংকে শীর্ষ তালিকাভুক্ত মানবপাচারকারীরা গা ঢাকা দিলেও থেমে নেই মুক্তিপণ আদায়।
দালালচক্রের মাধ্যমে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে যেসব স্বপ্নবাজ লোক অল্প খরচে সোনার হরিণ ধরতে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে পাচার হয়েছে সেসব মানুষের পরিবারে মুক্তিপণ দাবি করে যাচ্ছে দালালচক্রের সদস্যরা।
কেউ কেউ মানবপাচারকারী দালাল চক্রের দাবিকরা মুক্তিপণ দিয়ে ফেরত আসছে। তবে চাহিদামতো মুক্তিপন না পেয়ে অভিবাসীদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত রাখার খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
মুক্তিপণ দিয়ে সম্প্রতি ফিরে আসা জেলার একাধিক যুবকের সঙ্গে কথা বলে এই চিত্র পাওয়া যায়। গত এক সপ্তাহে পাচারকারীদের মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসেছেন উখিয়া-টেকনাফসহ বিভিন্ন এলাকার ১০ যুবক।
সর্বশেষ ২৮ মে বৃহস্পতিবার সাগরে ভাসতে ভাসতে দালালদের চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে জনপ্রতি ৪০ হাজার টাকা করে মুক্তিপণ দিয়ে ৩১ দিন পর মানবপাচারকারীদের কবল থেকে রক্ষা পেয়ে ফিরে এসেছে উখিয়া পালংখালীর ৩ যুবক। এরা হলেন-মোঃ ইউনুছ (১৯), হামিদুল হক (১৭) ও আব্দুল করিম (১৫)। অন্যদিকে দালালদের চাহিদামত ২ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দেয়ার পরও এখনো খোঁজ মেলেনি চকরিয়া কোনাখালী মরংঘোনা এলাকার মোজাফফরের পুত্র মহিউদ্দিন (২৮), আমির হোসেনের পুত্র মোক্তার আহমদ মানিক (২৫) ও নুরুল কবিরের পুত্র মনির আহমদের (১৮)।
এসব নিখোঁজ যুবকদের পরিবারে এখন শুধুই কান্নার রোল। সাগরপথে অবৈধ ভাবে স্বপ্নের মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে কেউ পাচার হয়েছে দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে, আবার কেউ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, কিংবা মিয়ানমারের কারাগারে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
আবার কারো ভাগ্যে জুটেছে থাইল্যান্ড কিংবা মালয়েশিয়ায় গণকবর। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইন শৃংখলা বাহিনীর অভিযান ও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় বেশ কয়েকজন শীর্ষ মানবপাচারকারী আটক হওয়ার পর অন্যরা গা ঢাকা দিলেও মুক্তিপণ আদায় চলছে এখনো।
এদিকে সমানতালে চলছে আইন শৃংখলা বাহিনীর অভিযান। এদিকে ২৮ মে ২৫০ জন মানবপাচারকারীর তালিকা প্রকাশের পর থেকে আরো বেশী করে অভিযানে নেমেছে পুলিশ। গত ২ দিনে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ১০ জন মানবপাচারকারীকে আটক করেছে পুলিশ। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে শহরের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ সড়ক থেকে আটক করা হয়-মানবপাচারকারী নাইক্ষ্যংছড়ির মৃত সিদ্দিক মিয়ার পুত্র ইদ্রিস মিয়া ও রামুর দারিয়ারদীঘি মৌলভী পাড়ার আহসান উল্লাহর পুত্র আবুল আলা।
এছাড়া ২৯ মে শুক্রবার সকালে টেকনাফে পৃথক অভিযান চালিয়ে তিন মানবপাচারকারীকে আটক করেছে পুলিশ। আটককৃতরা হলো-টেকনাফের হারিয়াখালী গ্রামের গুরা মিয়ার ছেলে (তালিকাভুক্ত) আবুল কালাম (৩৫), কাটাবনিয়া গ্রামের কালু মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ হোসেন (৩০) ও একই এলাকার মৃত আব্দুল কাদেরের ছেলে গফুর (২৬)।
কঠোর অবস্থানে আইন শৃংখলা বাহিনী
সম্প্রতি থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় অভিবাসীদের গণকবরের সন্ধান পাওয়ায় মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ইতিমধ্যে অনেক পাচারকারীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক করতে সক্ষম হয়েছে। বেশ কয়েকজন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। কক্সবাজারে মানবপাচারকারীদের পাশাপাশি পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান চলছে মাদক ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। ৪ মাসে মডেল থানা পুলিশের অভিযানে ৭৯ লক্ষ ৪৮ হাজার টাকার মাদক, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার ও ১০ জন শীর্ষ মানবপাচারকারীকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া ৩৬৯টি মামলার সাজা পরোয়ানা তামিল করা হয়েছে। জানা যায়-নানা প্রতিকূলতা আর জনবল সংকটের মধ্যে দিয়েও মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ কাজী মতিউল ইসলাম ও অপারেশন অফিসার কাইয়ুম উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে চলা অভিযানে চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মানব পাচার সংক্রান্ত ৯টি মামলায় ১০ জন শীর্ষ মানবপাচারীকে আটক ও ৩০ জন ভিকটিমকে উদ্ধার করা হয়। জেলা পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ জানিয়েছেন, মানবপাচারকারীদের আটকে অভিযান চলছে। ইতিমধ্যে ইমিগ্রেশনগুলোতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। যাতে নদীপথে কেউ পালাতে না পারে সেজন্য কোস্টগার্ডকে নজর রাখারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আত্মগোপনে পাচারকারীরা
জানা যায়-থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে গণকবরের পর সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় ১৩৯টি কবর ও ২৮টি বন্দী শিবিরের সন্ধান লাভের পর আরো ভাবিয়ে তুলেছে এখানকার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ লোকদের স্বজনদের। অনেকের ঘরে দেখা দিয়েছে শোকের মাতম আর আহাজারি। অন্যদিকে এখনো হাজার হাজার অভিবাসি গভীর সাগরের অথৈ জলে ভাসছে। এসব ঘটনার পর সরকারের উচ্চ মহল থেকে সব জায়গায় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় মালয়েশিয়ায় মানবপাচার। সাগরপথে অবৈধ ভাবে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মানবপাচারের সাথে জড়িত গডফাদার থেকে শুরু করে চুনোপুটিদের বিরুদ্ধেও সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে বিজিবি, র্যাব, পুলিশ ও কোস্টগার্ডসহ আইন শৃংখলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এরই অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় টেকনাফ, উখিয়া ও সদরে ছয় শীর্ষ মানবপাচারকারী নিহত এবং প্রায় শতাধিক মানবপাচারের সাথে জড়িত ব্যক্তিকে আটকের পর আতংক দেখা দেয় মানবপাচারকারীদের মাঝে। মানুষতো দূরের কথা আইন শৃংখলা বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে এখন নিজেরাই আত্মগোপনে চলে গেছে। আবার অনেকে নৌ ও সড়ক পথে মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দেয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। অনেক পাচারকারী কক্সবাজারের টেকনাফ, সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে ট্রলারে কিংবা ইঞ্জিন চালিত ফিশিং বোটে করে চট্টগ্রামেই গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে।
আলোচিত রেবি ম্যাডাম এখন চট্টগ্রামে
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে-এদের মধ্যে জেলার শীর্ষ মানবপাচার গডফাদার উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের সোনারপাড়ার আলোচিত রেবি ম্যাডাম ও তার নুরুল কবির কৌশলে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে ভাড়া বাড়িতে আত্মগোপন করে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে উখিয়া ও কক্সবাজার থানায় মানবপাচারের অভিযোগে প্রায় ১১টি মামলা রয়েছে। রেবি ম্যাডামের সাথে কক্সবাজার সদরের গডফাদার হিসেবে কাজ করতো ছৈয়দ হোসেন, একরাম ও ছৈয়দ করিম।
মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা যুবকদের কথা
কলাতলীর মুজিবনগরের শুকনাছড়ির ১৬ বছরের কিশোর তৌহিদ। অল্প খরচে বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে পাঁচ মাস আগে তাকে মালয়েশিয়ায় পাচার করে তৌহিদের প্রতিবেশী অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত নুর হাকিমের স্ত্রী ফরিদা বেগম। পাচারের পর তৌহিদের পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। মুক্তিপণ আদায়ের পর থেকে আর কোনো খবর ছিল না তৌহিদের। চলতি বছরের ১৯ মে শাহপরীরদ্বীপ থেকে উদ্ধার হয় মালয়েশিয়াগামী পাঁচ যুবক। তাদের একজন সিরাজগঞ্জের বেলকুচির চরমোটানি গ্রামের রেজাউল করিমের ছেলে রবিউল (১৮)। তিনি জানান, তিনি ও তার চাচাত ভাই ইসমাঈলকে (১৫) তাদের দূর সর্ম্পকের মামা রহিম খাবারের দোকানে মাসে ৭০ হাজার টাকা বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে। ১৩ এপ্রিল কক্সবাজার শহরের কেন্দ্রীয় বাসটার্মিনাল থেকে মুক্তিপণের দেড় লাখ টাকাসহ বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের ঘুমধুম গ্রামের ছিদ্দিকের ছেলে শাহাজালাল (২০) আটক হয় ডিবি পুলিশের হাতে।
মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছে উখিয়ার ৩ কিশোর
সাগরে ভাসতে ভাসতে দালালদের চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে হাতে-পায়ে ধরে মুক্তিপণ দিয়ে মানব পাচারকারীদের কবল থেকে অবশেষে ৩১ দিন পর কিশোর মোঃ ইউনুছ (১৮), হামিদুল হক (১৬) ও আব্দুল করিম (১৭) মুক্তি পেয়েছে। মানব পাচারকারীরা মিয়ানমারে তাদের রোহিঙ্গা দালালদের মাধ্যমে মাথা পিছু ৪০ হাজার টাকা হারে আদায় করে মাছ ধরার নৌকা করে বাংলাদেশ সীমান্তে পৌছিয়ে দেয়। তাদের ফুসলিয়ে নেওয়া দালাল আবুল হাশেম পালিয়ে থাকায় কিছু করা যাচ্ছে না বরং মুক্তি প্রাপ্তদের মাঝে দালাল চক্রের অজানা হুমকি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তবে উখিয়া থানার ওসি হাবিবুর রহমান সাগরে মানব পাচাকারকারীদের ভাসমান ট্রলার থেকে মুক্তিপন দিয়ে মিয়ানমার থেকে ফিরে আসার খবর জানেন না।
(ঢাকাটাইমস/ ২৯ মে /প্রতিনিধি /এআর/ ঘ.)