ঢাকা: ঈদের আগের দিন। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের স্ক্রলে একটি খবর দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন এলজিআরডি মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ৩০ হাজার খামারি তিনদিন দুগ্ধ সরবরাহ করতে পারবে না মিল্ক ভিটায়। এই ছিল খবরের শিরোনাম। বিস্তারিত জানার জন্য মন্ত্রী ফোন করলেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় সচিবকে। মিল্ক ভিটার চেয়ারম্যানের কাছ থেকে বিস্তারিত জানতে তাকেও ফোন দিলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। মুঠোফোনে বিস্তারিত শোনার পরে তাকে তলব করলেন বাসায়। জানতে চাইলেন যে খবর প্রচারিত হচ্ছে তা কি ঠিক? আসলেই খামারিরা বিপাকে পড়বে কিনা? মিল্ক ভিটা চেয়ারম্যান জানালেন, ঈদের আগে খোলা বাজারে দুধের দাম বেশি থাকে। এতে খামারিদের লাভ হয়। পাশাপাশি মিল্ক ভিটায় যে কিছু যান্ত্রিক ত্রুটি বিচ্যুতি থাকে সেটা সেরে নেন। এতে খামারিদের কোনো সমস্যা তো হয়-ই না বরং লাভ হয়।
মোটামুটি আশ্বস্ত হয়ে এবার ওই বেসরকারি টেলিভিশনের বার্তা বিভাগের সংশ্লিষ্টকে মুঠোফোনে ধরলেন এলজিআরডি মন্ত্রী। বললেন, প্রকৃত ঘটনা প্রচার হচ্ছে না। বরং মানুষ বিভ্রান্ত হতে পারে, মিল্ক ভিটা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হতে পারে এমন খবর যাচ্ছে, এটা ঠিক হচ্ছে কিনা? ’ কিছুক্ষণ পরে বেসরকারি টিভি চ্যালেন তাদের খবর প্রত্যাহার করে নিলো। এখানেই থেমে থাকলেন না নতুন এলজিআরডি মন্ত্রী। মিল্ক ভিটা চেয়ারম্যানকে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকলেন। মিল্ক ভিটা কেন মুনাফা করতে পারছে না? কী সমস্যা? কারা সমস্যা করছে?
জানা গেল, মিল্ক ভিটাকে যে চক্রটি জিম্মি করে রেখেছে সেই স্বার্থন্বেষী গোষ্ঠীর আক্রোশের শিকার খোদ মিল্ক ভিটা চেয়ারম্যানও। তাকে লক্ষ্য করে কিছুদিন আগে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে গুলিবর্ষণও হয়েছে। মামলার আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশের গড়িমসির প্রসঙ্গও উঠে এলো আলোচনায়। এবার মন্ত্রী ফোন করলেন সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপারকে। ‘কী ব্যাপার? মিল্ক ভিটা চেয়ারম্যানকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ হলো? মামলা হলো? অথচ আসামি ধরা হলো না। ঘটনা কী, এটা কীসের লক্ষণ?’
অপর প্রান্ত থেকে আমতা আমতা করে মন্ত্রীকে কিছু বলার চেষ্টা হলো বটে। কিন্তু মন্ত্রী আশ্বস্ত হলেন বলে মনে হলো না। পুলিশ সুপারকে সাফ জানিয়ে দিলেন, আসামি গ্রেপ্তার এবং দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা না নিলে পাল্টা শাস্তির ব্যবস্থা তিনিই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নেবেন। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়ার পরে খন্দকার মোশাররফ হোসেন যে কতখানি সক্রিয় এটি তার একটি উদাহরণ মাত্র।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসি আলম নীলা এলজিআরডি মন্ত্রীর সঙ্গে গত বুধবার সচিবালয়ের দপ্তরে দেখা করে রীতিমতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। মন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ায় আমরা খুশি।’মন্ত্রী জানতে চান, ‘কেন?’ জবাবে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা জানি কাজকে আপনি ভালোবাসেন। সারাক্ষণই সক্রিয় থাকেন। এ কারণেই আমরা মনে করি যে, এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয় সেটা আরও বেগবান হবে।’এসময় সেখানে নারায়ণঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য গাজী গোলাম দস্তগীর ছিলেন। তিনিও বললেন, ‘খুবই সত্যি কথা। আপনি কর্মক্ষেত্রে অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পছন্দ করেন। তার প্রমাণ আমরা প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে থাকতে পেয়েছি। জনশক্তি রপ্তানি খাতে বিশৃঙ্খল অবস্থা ছিল। সেখানে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি লোক বিদেশে পাঠানো গেছে। আবার অভিবাসন ব্যয়ও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে অতুলনীয় দক্ষতার প্রমাণ।’
এইভাবে সারাদেশ থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা নতুন এলজিআরডি মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করছেন। তাদের সমস্যার কথা, এলাকার সম্ভাবনার কথা মন্ত্রীকে জানাচ্ছেন। মন্ত্রীও তাদের বক্তব্য শুনছেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে কিছু নির্দেশনা দিচ্ছেন। বাকিটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানাচ্ছেন। এতে সংশ্লিষ্টরাও আশস্ত হচ্ছে।
ঈদের ছুটি শেষে সরকারি অফিস-আদালত খুলেছে গত সোমবার। সেদিন থেকেই নিয়মিত অফিস করেছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী। গেল সপ্তাহে মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, নাটোর সদর আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল, ভোলার সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, রাজশাহীর সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের সংসদ সদস্য গাজী গোলাম দস্তগীর, নারায়ণগঞ্জের আরেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, রাজবাড়ীর সংসদ সদস্য জিল্লুল হাকিম প্রমুখ। তারা বিভিন্ন সময় মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। এলাকার সমস্যা, উন্নয়ন বরাদ্দ এসব নিয়ে কথা বলেছেন।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, গত ছয় বছরে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ে এই চিত্রটা ছিল না। জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই মুখো হতেন না। কারণ এখানে আগের মন্ত্রী কার্যত বসতেনই না। খন্দকার মোশাররফ হোসেন এলজিআরডি মন্ত্রী হওয়ার পর প্রতিদিনই মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ফাইল দেখছেন। নিয়মিত সবকিছুর খোঁজ-খবরও নিচ্ছেন।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাড়ে চারশর বেশি ফাইল না দেখে, সিদ্ধান্ত না দিয়ে ফেলে রেখেছিলেন। নতুন মন্ত্রী সেই ফাইলগুলো নতুনভাবে দেখছেন। যেগুলো সিদ্ধান্ত দেয়ার মতো সেগুলো সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছেন। এর বাইরেও নতুন অনেক ফাইল দেখছেন। প্রতিদিনই তিনি ফাইল ওয়ার্ক করছেন। মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব, বিভিন্ন সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী, মহাপরিচালকদের ডেকে এই মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। এর মধ্যে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের খুঁটিনাটি জানছেন মন্ত্রী। প্রকল্পের কর্মকাণ্ডের ভালো দিক, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছেন। এছাড়া কীভাবে সুপেয় পানি সহজে গ্রামাঞ্চলে সরবরাহ করা সম্ভব হবে সে ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানছেন।
মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রী দফায় দফায় স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিবদের ডাকছেন। কীভাবে কাজে সমন্বয় করতে হবে, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর তদারকি করতে হবে, কীভাবে সুপেয় পানি পাওয়া যাবে এসব নিয়ে আলোচনা করছেন। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিদের দায়িত্ব, তাদের ক্ষমতা, সমস্যা, সুবিধা এগুলো নানাভাবে বোঝার চেষ্টা করছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে সরেজমিনে ঘুরে দেখার জন্য ট্যুর প্রোগ্রাম করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া কুমিল্লা বার্ড, বগুড়ার আরডিতে বোর্ড সভা হয় কিনা তা খোঁজ নিতে বলেছেন। যদি না হয়ে থাকে তাহলে বোর্ড সভা করা দরকার, কেন করা দরকার এসব বিষয়ে কথা বলতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। এভাবে মন্ত্রণালয়ের অধীনে যত প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোকে সক্রিয় করার নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি শনিবার ছুটির দিনেও স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব,অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী, ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে মন্ত্রী বৈঠকে ডেকেছেন। তিনি চান না কোনো অবস্থাতেই কাজে শৈথিল্য দেখানো হোক। সবাইকে শতভাব আন্তরিকভাবে সক্রিয় হতে হবে।
মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা জানান, দায়িত্ব নেয়ার পর নির্বাহী প্রকৌশলীদের বিদেশ সফরের কয়েকটি ফাইল মন্ত্রীর কাছে এলে তিনি এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী শ্যামা প্রসাদ অধিকারীকে ডেকে এ ব্যাপারে জানতে চান। পরে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, একজন নির্বাহী প্রকৌশলী ছুটি নিয়ে স্বপরিবারে বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণে যাবেন, তা আর চলবে না। তাছাড়া একজন প্রকৌশলী কত টাকাই বেতন পান? তার আয় তো এত বেশি না যে চাইলেই যখন তখন ইউরোপ-আমেরিকায় যেতে পারেন। এভাবে বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি দেয়া আর অনিয়ম ও দুর্নীতিকে উৎসাহ দেয়া সমান কথা। সূত্র আরও জানায়, এলজিআরডি মন্ত্রী প্রধান প্রকৌশলীকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, আর যদি কোনো নির্বাহী প্রকৌশলীর বিদেশ সফরের ছুটির ফাইল মন্ত্রণালয়ে আসে তাহলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এলজিইডির পদস্থ একজন কমকর্তা জানান, মন্ত্রীর এমন দৃঢ় উচ্চারণে অধিদপ্তরে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। সবার কাছে এই বার্তা পৌঁছে গেছে যে, আগে যা হবার হয়েছে কিন্তু ভবিষ্যতে আর অনিয়মের সুযোগ নেই। এখন থেকে বুঝে শুনেই চলতে হবে।
জানতে চাইলে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় সচিব আব্দুল কাদের সরকার বলেন, ‘নতুন মন্ত্রী মহোদয় যোগদানের পর পুরো মন্ত্রণালয়ের কাজে গতি এসেছে। সবার মধ্যে এখন কর্মচাঞ্চল্য বিরাজ করছে। এভাবে চলতে থাকলে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান হবে।’
এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার সচিব আব্দুল মালেক বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের সর্বস্তরে এখন কর্মতৎপরতা চলছে। ছুটির দিনেও আমরা মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছি। সারাদেশেই এলজিআরডি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরকে সক্রিয় করার চেষ্টা চলছে।’
এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের এসব কর্মতৎপরতাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা। জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় চাঙ্গা হয়ে উঠেছে এটা খুশির খবর। তবে এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।’
(ঢাকাটাইমস/২৫জুলাই/এইচএফ/জেবি)