ঢাকা: সম্প্রতি রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে ফাতেমা আক্তার (১৫) নামে এক কিশোরী রাস্তায় পড়েছিল। মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছিলো তখনো। আহারে! মেয়েটি জীবিত আছে-এই বলে দুই জন পথচারী (শাশুড়ি শাহনাজ ও জামাতা) মেয়েটিকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।
জরুরি বিভাগে নেয়ার পর ডাক্তাররা মেয়েটিকে মৃত ঘোষণা করে। আর বিপত্তি ঘটে তখনই! সন্দেহের তীর গিয়ে পড়ে তাদের ওপর। মেয়েটির জীবন বাঁচাতে গিয়ে তারা শেষ পর্যন্ত পুলিশি হয়রানির মুখে পড়ে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদেরকে জেরা করা হয়। খবর দেয়া কামরাঙ্গীরচর থানা পুলিশকেও। শেষ পর্যন্ত থানা পুলিশ এসে দ্বিতীয় দফা তাদের জেরা করে।
সকাল ১০টা থেকে চলে এই জেরা। টানা জেরা করার পর পুলিশ যখন নিশ্চিত হয় যে মেয়েটির মৃত্যুর সঙ্গে এদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে বিকাল।
অবশেষে বিকাল চারটার পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। দিনভর নানা হয়রানিতে তখন শাশুড়ি-জামাতা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। গত ২০ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতলের ঘটনা এটি।
এ-তো একটি ঘটনার কথা বর্ণনা করা হলো। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতলে প্রায় প্রতিদিনই এমন সব ঘটনা ঘটছে।
তবে দীর্ঘ দিন ধরে পত্র-পত্রিকায় পুলিশের এই হয়রানির খবর প্রচার হওয়ার ফল যে মোটেই ভালো হচ্ছে না তা জাতি টের পেয়েছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে টিএসসির সামনে বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ ও তার স্ত্রী বন্যার বেলায়।
দুর্বৃত্তরা এই দম্পত্তিকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে রাস্তায় ফেলে যাওয়ার পরও দীর্ঘ সময় কেউ এগিয়ে আসেনি তাদের উদ্ধারে। তখন আশপাশে হাজারো মানুষের ভিড়। সবাই যেন তাকিয়ে দৃশ্য দেখছিল।
এক পর্যায়ে রক্তাক্ত বন্যাকে দাঁড়িয়ে দুই হাত মেলে ধরে অভিজিতকে হাসপাতালে নেয়া আকুতি জানাতে দেখা যায়। পুলিশের অযথা হয়রানির এড়াতেই রাস্তায় পড়ে মানুষ কাতরালেও কেউ আর এখন এগিয়ে আসতে চায় না সেভাবে।
সূত্র বলছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রায়ই সময়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলে, বিষপান করলে, গলায় ফাঁস দিলে, ছুরিকাঘাতে আহত হলে, গুলিবিদ্ধ হলে, অজ্ঞানপার্টির খপ্পড়ে পড়লে তাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের এরকম জেরার মুখে পড়তে হয়। একটু এদিক ওদিক হলেই আর রক্ষা নেই!।
ফাতেমা সম্পর্কে জানতে চাইলে কামরাঙ্গীর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. ইব্রাহিম ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আমরা জানতে পেরেছি ফাতেমা আক্তারের সঙ্গে একটি ছেলের প্রেম ছিল। ওই ছেলে তাকে বিয়ে করতে না চাওয়ায় মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। এ ঘটনায় ৩০৬ ধারায় আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে প্রেমিক ইয়াসিনকে আসামি করে মেয়েটির মা লতা বেগম কামরাঙ্গীরচর থানায় একটি মামলা করেছেন।
ফাতেমাকে যারা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই শাহনাজ ও তার মেয়ের জামাইয়ের কী অবস্থা জানতে চাইলে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তাদের কোন দোষ নেই। তারাতো প্রথমে ফাতেমাকে বাঁচানোর জন্য তাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে যান।
তাদের যদি দোষ নাই থাকে তাহলে কেন তাদেরকে কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখা হলো- জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মোজাম্মেল হক ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অনেক সময় দেখা যায় কেউ দায়ী ব্যক্তিরা রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তখন আমরা বাহককে জিজ্ঞাসাবাদ করি। এবং স্থানীয় থানায় সংবাদ দেই। বিষয়টি স্থানীয় থানা পুলিশ নিস্পত্তি করেন।
তিনি আরও বলেন, নিরীহ কোন মানুষকে হয়রানি করি না। কারো আচারণ সন্দেহ হলে তাকে তো জিজ্ঞাসাবাদ করতেই হয়। এ ক্ষেত্রে নিরীহ লোক যে একেবারে হয়রানির শিকার হয় না তাও নয়। তার প্রশ্ন আমাদের কি করার আছে বলেন?
অপরাধী শনাক্ত করার নামে নিরীহ লোক যদি এ ভাবে হয়রানির শিকার হন তাহলে দুর্ঘটনায় কবলে পড়া সাধারণ মানুষকে তো কেউ আর স্বেচ্ছায় হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নিতে উৎসাহী হবে না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মুনতাসিরুল ইসলাম ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, একটি ঘটনা ঘটলে বা ফৌজদারী অপরাধ সংঘঠিত হলে পুলিশ তো তার প্রাথমিক দায়িত্ব পালন করবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অপরাধীরা ভিকটিমকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। সেক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা পুলিশের দায়িত্ব।
পুলিশের এই কৌশলে নির্দোষ ব্যক্তিরা হয়রানির শিকার হওয়ায় দুর্ঘটনার কবলে পড়া ব্যক্তিরা যেমন সাধারণ মানুষের সহযোগিতার হাত থেকে বঞ্চিত হবেন তেমনি প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাবেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, সাধারণ মানুষ অনেক সময় ভয়ে কথা বলতে চায় না। কিংবা পুলিশকে সহযোগিতা করতে চায়না। তবে এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতা প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মো. হাফিজুর রহমান কার্জন ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এসব ঘটনায় পুলিশ ফৌজদারী কার্যবিধি মোতাবেক বাহককে জিজ্ঞাসাবাদ করবে এটা স্বাভাবিক। তবে আইনকে পুঁজি করে কোন পুলিশ সদস্য যদি নিরীহ কোন ব্যক্তিকে হয়রানি করে তাহলে তা হবে খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এমনিতেই ওই ব্যক্তি কিছুটা নিজের ক্ষতি করে ভিকটিমকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। এ জন্য তার প্রশংসা বা পুরস্কার পাওয়া উচিৎ। সেক্ষেত্রে যদি সে হয়রানি বা কারাবাসের শিকার হন তাহলে এটি খুবই দু:খজনক। বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও যারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন তাদের দৃষ্টিগোচর করতে হবে।
(ঢাকাটাইমস/২৩জুলাই/এএ/এআর)