logo ২৫ এপ্রিল ২০২৫
পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল! জনমনে নানা প্রশ্ন
ইব্রাহিম খলিল, ঢাকাটাইমস
১৯ জুলাই, ২০১৫ ২১:৪৬:৩৯
image


চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম শহর জুড়েই পাহাড়ের পাদদেশে হাজারো মানুষের বসবাস। আর প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম এলেই পাহাড় ধসে মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।

প্রাণহানির পর প্রশাসন প্রতিবছরই নড়াচড়া দেয়। বৃষ্টির মৌসুম শেষ হলেই আবার সব শেষ।হঠাৎ করে সৃষ্ট উত্তেজনা হঠাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

প্রশাসনের এই ধরি মাছ না ছুই পানি-অবস্থায় বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষও হতাশ। প্রাণহানির পর প্রশাসন যন্ত্র লোক লস্কর নিয়ে মাঠে নেমে উচ্ছেদ অভিযানে অংশ নেয়। কাউকে কাউকে উচ্ছেদও করে। পত্রিকায়ও ফলাও করে তা প্রকাশিত হয়।

কয়েক দিন যেতে না যেতেই উচ্ছেদকৃতরা আবার পুরোনো জায়াগায় ফেরত আসে। আবার সবকিছু ঠিক আগের মতো। বর্ষ শেষে বিভিন্ন দিক থেকে আসা হাঁকডাকও বন্ধ হয়ে যায়। দৃশ্যত গত কয়েক বছর ধরে এ ভাবেই চলছে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর এবারও চট্টগ্রামে কয়েকজনের প্রাণহানি ঘটে।

পাহাড় ধসে একই পরিবারের তিন শিশু এবং দেয়াল ধসে তিন জনের প্রানহানির পর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের সরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয় প্রশাসন। প্রতিবছর বর্ষায় মৃত্যুর এই মিছিল নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালেও সেখানে বসবাসকারীদের নিয়ে সারা বছর প্রশাসনের কোনো খবর থাকে না। এর ফলে প্রতিবছর প্রাণহানীর ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়।

দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে প্রশাসনের এই ভূমিকা নিয়ে এখন জনমনে প্রশ্ন জেগেছে। তাদের প্রশ্ন, প্রশাসন শুধুমাত্র বর্ষাকালে বা প্রাণহানির পর পাহাড়ের বসতি নিয়ে এতো বিচলিত হয় উঠেন কেন? সারাবছর কি করে প্রশাসন? প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যারা পাহাড়ে বসতঘর নির্মাণ করে তারাই বা কারা?

স্থানীয়রা জানান, রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে পাহাড়ের জমি দখল করে তা কেটে পাকা-আধাপাকা ভবন ও বসতঘর তৈরি করে তা ভাড়া দেয় স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। আর এসব ঘরে যারা বসবাস করেন তাদের অধিকাংশই ভাড়াটিয়া। ফলে পাহাড় ধস নিয়ে দখলদারদের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। আর প্রভাবশালী হওয়ায় প্রশাসনও তাদের কাছে অনেকটা জিম্মি।

স্থানীয়রা আরও জানান, পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারীরা স্বল্প আয়ের মানুষ। বিশেষ করে নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, খুলনা ও রংপুরসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের নদীভাঙা জনগোষ্ঠী ও হতদরিদ্র অনেকে আয়ের সন্ধানে ছুটে আসে চট্টগ্রাম মহানগরীতে। তাদের একটি অংশ কম ভাড়ায় পাহাড়ের নির্মিত বসতঘরে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেয়।

সরেজমিনে আলাপকালে পাহাড়ে বসবাসকারী কয়েকজন এই প্রতিবেদককে বলেন, বর্ষাকালে পানির তোড়ে পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও নিরুপায় হয়ে জীবন কাটাতে হচ্ছে আমাদের। আয়-রোজগার থাকলে সাহেবদের মতো আবাসিক এলাকায় ভবনেই থাকতাম।

চট্টগ্রামের অক্সিজেন এলাকার পাহাড়ে বসবাসকারী নুসরাত জাহান (৪২) বলেন, ‘বর্ষা আইলে আমাগরলাই বেডাগর দরদ বাইরা যায়। খালি কই এখান থেকা চলে যান। না গেলে ঘর ভাঙি দেওনর ডর দেহাই। কি যন্ত্রণারে বাবা। শীতকালে আর গরমকালে শান্তিতে থাইকলে তাগও কারনে বাইরাকালে শান্তি পাই না।’

তিনি বলেন, ‘১৫ বছর ধইরা আমি এই পাহাড়ে আছি। বেডারা আগে কইছে আমাগরে ঘর-বাড়ি বাইন্দা (পূনর্বাসন) দিব। শেষ মেষ মাঠ এক্কান নিই তাবু টাঙাই দে। কই বাইরাকাল না যাওয়া পর্যন্ত এইহানে থাইকত হইব। শেষে এক-দুই মাস রাখি আর খবর লই না।’

আমিন কলোনির বাসিন্দা তৈয়বুর রহমান বলেন, ‘পাহাড়ে বসতঘর তৈরি না করলে আমরাও ভাড়ায় থাকতাম না। পাহাড় ধসে প্রাণহানিও ঘটতো না। কিন্তু যারা বসতঘর নির্মাণ করেছে সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। টানাটানি শুধু আমাদের নিয়ে।’

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরীর বায়েজিদ এলাকা, অক্সিজেন, মতিঝর্ণা, টাইগারপাস, ওয়্যারলেস কলোনি, খুলসি এলাকার প্রায় ৩০টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে প্রায় ১১ হাজার পরিবার। যা সম্পূর্ণ অবৈধ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে যখন যে দল ক্ষমতায় ছিল তখন সে দলের নেতা পরিচয়ে চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশ দখল করে বসতঘর নির্মাণ করে। সে হিসাবে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পাশাপাশি বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টিসহ ছোটখাট দল ও অঙ্গসংগঠনের নেতাদের বসতঘরও রয়েছে পাহাড়ি এলাকায়। যাদের সঙ্গে প্রশাসনের সখ্যতা রয়েছে। ফলে প্রশাসন বসতঘর সরিয়ে না নিয়ে বসবাসকারীদের উচ্ছেদের নামে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, প্রশাসনের ভয়ে বসবাসকারীরা বসতঘর থেকে কয়েকঘণ্টার জন্য বেরিয়ে গেলেও প্রশাসন স্থান ত্যাগ করার পর আবার চলে আসে। এর ফলে প্রশাসনের আদেশ কার্যত উপেক্ষিতই থাকে। বসতঘর উচ্ছেদ করে পাহাড়ের পাদদেশ দখলের ব্যাপারে প্রশাসন কঠোর ও বাস্তব পদক্ষেপ না নেওয়া পর্যন্ত কোনো সুফল আসবে না বলে মত প্রকাশ করেন তারা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতি বছর বর্ষাকালে উচ্ছেদ অভিযানের নামে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের প্রভাবে প্রতিপক্ষ দলের নেতাদের বসতঘর উচ্ছেদ করলেও পরে টাকার বিনিময়ে আবার নির্মাণ করা হয় বসতঘর।

প্রশাসন হয়তো এই কারণেই বর্ষাকালে পাহাড় ধসের কথা বলে উচ্ছেদ অভিযানে তৎপর হয়ে উঠে বলে মত প্রকাশ করেন স্থানীয়রা।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন বলেন, রাজনৈতিক পরিচয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসতঘর নির্মাণ করা হলেও বসবাসকারীদের সিংহভাগই স্বল্প আয়ের মানুষ। যাদের অনেকেই পাহাড়ে বসবাসের নেতিবাচক ধারণা সম্পর্কে সচেতন নয়।

তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে এবং পাহাড়ে বসবাসের কারণে পরিবেশের যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয় এ ব্যাপারে প্রশাসনের দায়িত্ব রয়েছে। ফলে পাহাড় ধসে প্রাণহানি যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে প্রশাসন সজাগ দৃষ্টি রাখে।

তিনি আরও বলেন, গত ২০ বছরে চট্টগ্রাম মহানগরে বড় ধরণের প্রাণহানির বহু ঘটনা ঘটেছে। যা স্বরণ হলে এখনো গা কেঁপে উঠে। এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে সে কারণে প্রশাসন সতর্ক।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে চট্টগ্রামে গত তিন দিন ধরে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এর ফলে শনিবার দিবাগত রাতে আমিন কলোনি লালখান বাজার পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় ও দেয়াল ধসে তিন শিশুসহ ছয় জনের প্রাণহানি হয়েছে। চলমান বৃষ্টিপাতে আর যেন কোনো প্রাণহানি না ঘটে সে জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের সরিয়ে আনা হয়েছে।

অপর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিবেশ রক্ষা ও পাহাড় ধসের ঘটনায় জান-মাল রক্ষায় প্রশাসন প্রতিবছর উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে। পরে বসবাসকারীরা আবার ফিরে গিয়ে বসতঘর নির্মাণ করে। ফলে কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না পাহাড়ে বসবাস।

তিনি বলেন, শুধু বর্ষাকাল আসলেই পাহাড়ে বসবাসকারীদের নিয়ে প্রশাসন বিচলিত হয়ে উঠে তা নয়, পুরো বছর এ নিয়ে চিন্তিত থাকে। তবে ব্যস্ততার মাঝে হয়তো চিন্তায় একটু ভাটা পড়ে।

(ঢাকাটাইমস/১৯জুলাই/আইকে/এমআর)