চট্টগ্রাম: কেউ খায় কলমের খোঁচায়, কেউ বন্দুকের নলে, আবার কেউ খায় সরাসরি। দীর্ঘদিন ধরে ত্রিমুখী এই খাই খাই চক্রের কবলে পড়ে আছে দেশের তেল খাত। বছরে শতকোটি টাকারও বেশি তেল গিলছে এই চক্রটি। কলমের খোঁচা চক্র বিপুল পরিমাণ গিলে খাওয়া তেলকে বছরের পর বছর অপচয় হিসেবে উল্লেখ করছে বার্ষিক আয়-ব্যয় বিবরণীতে।
যদিও এই জ্বালানি তেল সেক্টরে সরকারের এখন দ্বিগুণেরও বেশি লাভ। এর কারণ বিশ্ববাজারে চেয়ে বাংলাদেশে এখন তেলের দাম দ্বিগুণেরও বেশি। সূত্র জানায়, খাই খাই চক্রের পেটে বছরে শত কোটি টাকার তেল যাচ্ছে।
অন্যদিকে সরকারের লাভের পরিমাণ যতই হোক না কেন সবকিছুর মাসুল দিতে হচ্ছে কিন্তু এ দেশের সাধারণ মানুষকে। যারা এই তেল ব্যবহার করে অন্ধকারে আলো জ্বালানোর জন্য। যানবাহনে ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদন ও দৈনন্দিন রোজগারের জন্য।
দিনশেষে এসব মানুষের আয় কত হল, না হল অথবা অর্থাভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহারে অক্ষম গরিব পরিবারে রাতের আঁধারে আলো জ্বালাতে পারল কি পারল না তা দেখার কেউ নেই। অথচ এসব মানুষের আয়ের মোটা অংশ গিলছে ত্রিমুখী এই খাই খাই চক্র।
এরপরও নিস্তার নেই সাধারণ মানুষের। খাই খাই চক্রের আধিপত্যের বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় বন্ধুক চক্রের অ্যাকশন পড়ছে সরাসরি গিলে খাওয়া চক্রের উপর। গিলে খাওয়া চক্র ধর্মঘটের নামে চালায় নৈরাজ্য। এসব চক্রের কবল থেকে কখন যে নিস্তার মিলবে ভুক্তভোগী জনগণের তারও নিশ্চয়তা যেন মিলছে না।
তেল পরিবহন কাজে নিয়োজিত বাংলাদেশ ট্যাংক লরি মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি রফিকুল মাওলা এ প্রসঙ্গে বলেন, গত ৪ আগস্ট সুপার রিফাইনারি লিমিটেডের নামে অবৈধ কেরোসিন তেল পাচারের অভিযোগ এনে বায়েজিদ বোস্তামি থানা পুলিশ জাকির হোসেন নামে এক ট্যাংক লরি চালককে গ্রেপ্তার করে।
সরকারি রাজস্ব বিভাগসহ বৈধ সব ধরণের কাগজপত্র নিয়ে ৯ হাজার লিটার কেরোসিন তেল নিয়ে মিরসরাইর মেসার্স রিদোয়ান ট্রেডার্সে যাচ্ছিল লরিটি। এই সময় অবৈধ তেল পাচারকারী দাবি করে পুলিশ চালকের কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। চাহিদা মোতাবেক চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় পুলিশ জাকির হোসেনকে আটক করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তেল পরিবহনে নিয়োজিত একাধিক চালক অভিযোগ করেন, দেশের জ্বালানি তেল সেক্টরের সুতিকাগার চট্টগ্রাম সুপার রিফাইনারি লিমিটেড থেকে তেল নিয়ে সড়কে বোরোলেই স্তরে স্তরে পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। অন্যথায় বৈধ তেলকেও অবৈধ বলে মামলা ও গ্রেপ্তারের মাধ্যমে হয়রানি করে পুলিশ। যা রিফাইনারি কর্তৃপক্ষও জানেন। তাদের সাথে পুলিশের যোগসাজশ রয়েছে।
তারা বলেন, একদিকে নানা কারসাজি করে রিফাইনারির কর্মকর্তারা কলমের খোঁচায় চুরি করে। অন্যদিকে বন্দুকের নল দেখিয়ে কেড়ে খায় পুলিশ। তাদের এই খাই খাই স্বভাবের কারণে জ্বালানি তেল সেক্টর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে কোন সময় লাভের মুখ দেখেনি।
চট্টগ্রাম শিল্প পুলিশের এসআই আবু তাহেরের মুখে আবার অন্য কথা। তিনি বলেন, রিফাইনারি কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় নানা কারচুপি ও দুর্নীতির সাথে তেল পরিবহণে নিয়োজিত ভাউচার চালকরা অবৈধ উপায়ে তেল উত্তোলন করে বাইরে পাচার করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। যা দেখার দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর রয়েছে।
তিনি বলেন, গত ৪ আগস্ট সুপার রিফাইনারি লিমিটেডের নামে অবৈধ কেরোসিন তেল পাচারের সময় বায়েজিদ বোস্তামি থানা পুলিশ ট্যাংক লরিসহ চালক জাকির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় জাকির হোসেন কারাগারে রয়েছেন। তার মুক্তির বিষয়টি এখন আদালতের ব্যাপার।
কিন্তু ট্যাংক লরি শ্রমিক ও মালিক সমিতির তার মুক্তির দাবি এবং বাধাহীন তেল পরিবহনের দাবিতে যে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে তা সম্পূর্ণ অন্যায় ও স্বেচ্ছাচারী।
এদিকে তেল পরিবহণে পুলিশের বাধা ও আগামী দুই দিনের মধ্যে চালক জাকিরের মুক্তি না হলে সারাদেশে আরো বৃহত্তর আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া হবে বলে জানান ট্যাংক লরি মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ এর মালিক ও শ্রমিকরা।
সুপার রিফাইনারি লিমিটেডের কর্মকর্তা মো. হারুন জানান, যুগ যুগ ধরে তেল পাচারে জড়িত রয়েছে তেল পরিবহনে নিয়োজিত চালকরা। যার প্রমাণ পাওয়ায় পুলিশ গত ৪ আগস্ট চালক জাকির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে। যা না মেনে ট্যাংক লরি শ্রমিক ও মালিক সংগঠন ধর্মঘটের ডাক দেয়। এতে সরকার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে প্রতিদিন। এই অবস্থা চলতে থাকলে আবার তেল সেক্টর লোকসানের মুখে পড়বে। দুর্ভোগ পোহাবে সাধারণ জনগণ।
তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ তেল স্থাপনা পদ্মা মেঘনা যমুনাসহ প্রাইভেট সেক্টরের ১৬টি অয়েল কোম্পানির তেল চট্টগ্রাম থেকে পরিবহণ করা হয় সারাদেশ। আর এই অয়েল কোম্পানির সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারি ও পরিবহণে জড়িত শ্রমিক এবং পুলিশ প্রশাসন চক্র লুটপাট করে খাচ্ছে। এরপরও লাভে আছে সরকার। এর কারণ হচ্ছে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও কমেনি বাংলাদেশে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সর্বশেষ ২০১৩ সালের ৪ জানুয়ারি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকার। সে অনুযায়ী বিপিসি এখন অকটেন ও পেট্রল বিক্রি করে লাভ করছে প্রতি লিটারে প্রায় ৪০ টাকা। আর ডিজেল, ফার্নেস তেল ও গরিবের জ্বালানি কেরোসিন তেল বিক্রি করে মুনাফা করছে ২০ টাকা পর্যন্ত।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের গড় মূল্য ছিল ব্যারেল প্রতি ৫৪ ডলার। পরের তিন মাস, অর্থাৎ এপ্রিল-জুন সময়ে গড় মূল্য খানিকটা বেড়ে হয় ৬১ ডলার। অথচ এক বছর আগে এই তেল কিনতে হয়েছে ১১০ থেকে ১১৫ ডলার। বিশ্ববাজারে তেলের দাম আরও কমেছে। গত ২২ এপ্রিল পর্যন্ত বিপিসির মুনাফা হয়েছে ৩ হাজার ৪৫৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
বিপিসির চেয়ারম্যান এ এম বদরুদ্দোজা জানান, জ্বালানি তেল সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় পরিবহন খাতে, ৪৫ শতাংশ। এরপরেই বিদ্যুৎ খাতে ২৫ শতাংশ, কৃষি খাতে ১৯ শতাংশ, শিল্প খাতে ৪ শতাংশ এবং গৃহস্থালি ও অন্যান্য খাতে ৭ শতাংশ। সুতরাং জ্বালানি তেলের দাম কমলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে পরিবহন ও বিদ্যুৎ খাতে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত বিশেষ সহকারী ম. তামিম মনে করেন, খাই খাই চক্রের পেটে হজম হওয়া তেল রিফাইনারি কর্তৃপক্ষ বছর শেষে অপচয় হিসেবে দেখান। সেই সাথে সরকারের লাভের অঙ্কসহ এসব অর্থ আসছে কিন্তু সাধারণ ভোক্তাদের পকেট থেকে। যাদের কিঞ্চিত পরিমাণ লাভের কথা চিন্তা করছে না কেউ।
ট্যাংক লরি ধর্মঘটের কারণে সরকারের সারাদেশে জ্বালানি তেল পরিবহনে বড় ধরনের সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি সরকারের বড় অংকের আর্থিক ক্ষতিরও আশঙ্কা করে তিনি বলেন, দেশের অগ্রগতি ও সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে খাই খাই চক্রের কবল থেকে তেল সেক্টরকে রক্ষার কোন বিকল্প নেই।
(ঢাকাটাইমস/ ২০ আগস্ট/ আইখ /এআর/ ঘ.)