logo ২৪ এপ্রিল ২০২৫
তিনিই নায়ক
১০ আগস্ট, ২০১৫ ১১:৩১:৪৯
image


শিশুর প্রতি ভালোবাসার অনন্য নজির স্থাপন করলেন সুমন নামের এক গার্মেন্ট শ্রমিক। অচেনা একটি শিশুর মুখে হাসি ফোটাবার জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ করলেন। নিজের প্রাণ দিয়ে বাঁচিয়ে দিয়ে গেলেন শিশুটিকে। তিনই প্রকৃত নায়ক। তাকে নিয়ে লিখেছেন হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

রাজন, নাজিম উদ্দিন, রাকিব তারপর রবিউল। দিনের পর দিন যেন দীর্ঘ হচ্ছে পৈশাচিক নির্যাতনে শিশু হত্যার তালিকা। কী হচ্ছে দেশে? শিশুদের প্রতি এমন নির্মমতা কেনÑএই প্রশ্ন যখন মুখে মুখে, তখন শিশুর প্রতি ভালোবাসার অনন্য নজির গড়লেন একজন সুমন। অচেনা একটি মুখের হাসির জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ করলেন। নিজের প্রাণ দিয়ে বাঁচিয়ে দিয়ে গেলেন শিশুটিকে। ভুলে গেলেন, তারও এমন তিনটি শিশু আছে।

তিনি না থাকলে শিশুদের কী হবে? একটিবারের জন্যও কি ভেবেছিলেন সুমন? মনে হয় না। ধাবমান ট্রেন দেখে দৌড়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন রেল লাইন থেকে, কিন্তু বাঁচতে পারলেন না নিজে।

পথশিশুকে বাঁচাতে গিয়ে অসামান্য নজির স্থাপন করলেন তিনি। একটি নিষ্পাপ শিশুর মুখের হাসি অম্লান রাখতে কান্নায় ভাসালেন স্ত্রী-সন্তানকে। জীবন দিয়ে মো. সুমন প্রমাণ করলেন এখনো মনুষ্যত্ব, মানবতা আর শিশুর জন্য ভালোবাসা লুকিয়ে আছে অতি সাধারণের মনেও। চলচ্চিত্র, নাটকে রেললাইনে ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্যকে বাঁচাতে দেখা যায় ভূরি ভূরি। নায়কের দুঃসাহসিক কাজ দেখে দর্শকের হাততালি আর বাহবার কমতি হয় না। কিন্তু বাস্তব জীবনে জীবন নিয়ে এমন ঝুঁকি নেওয়ার সাহস আছে কার? কিন্তু সুমন দেখিয়ে গেলেন, মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য।

সুমন নিজেও তিন সন্তানের জনক। বড় মেয়ে সুমী আক্তার ১০ বছর বয়সেই হারাল বাবাকে। সাত বছরের মেঝো ছেলে রাকিব এখনো পুরোপুরি চিনতে শেখেনি পৃথিবীটা। আর দু মাস বয়সী শিশুকন্যা ফাতেমা যে আর কখনো বাবাকে ‘বাবা’ বলে ডাকতে পারবে না, এ কথা কি সে জানে?

গত ৪ আগস্ট দুপুরের ঘটনা। বনানী সৈনিক ক্লাবের পাশে রেললাইন ধরে হাঁটছিল পাঁচ-ছয় বছরের একটি শিশু, নাম-পরিচয় জানা নেই। ঠিক ওই সময় আসছিল একটি ট্রেন। শিশুটি বেখেয়ালে হাঁটছিল ট্রেনের দিকেই। দেখছিলেন সবাই। কিন্তু সবার চেয়েও যে সুমন আলাদা এটা তো প্রমাণ দিলেন তিনি। ট্রেন তখন খুব কাছাকাছিই চলে এসেছিল। এর মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে দৌড়ে গিয়ে রেললাইন থেকে শিশুটিকে ছিটকে ফেলে দিলেন। প্রাণে বেঁচে গেল শিশুটি। দুর্ভাগ্য বৃষ্টিতে পিচ্ছিল লাইনের স্লিপারে পা ফসকে পড়ে গেলেন তিনি। নির্দয় লোহার চাকা সাঁই করে চলে গেল রক্ত মাংসের শরীরের ওপর দিয়ে। গগন বিদারি চিৎকারে ভারী হয়ে উঠল আকাশ। একটার পর একটা বগি দানবীয় কায়দায় পার হয়ে যাওয়ার পর শরীর থেকে দু পা বিচ্ছিন্ন অন্য এক সুমনকে আবিষ্কার করে সহকর্মীরা। মাথার পেছনভাগেও বেশ আঘাত পেয়েছিলেন তিনি। ছুটোছুটি করে প্রথমে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে (পঙ্গু হাসপাতাল) নেওয়ার পর সেখানকার চিকিৎকরা জানান, কিছুই করার নেই তাদের। অগত্যা সহকর্মী-বন্ধুরা ছোটেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে। সেখানে পৌঁছানোর আগে পথেই শেষ নিঃশ্বাস ছাড়েন সুমন।

পেশার দিক বিবেচনা করলে অতি সাধারণ একজন বলেই হয়ত সুমনকে নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। গণমাধ্যমের পাতায়ও তার এই অসাধারণত্ব উঠে আসেনি সেভাবে। কিন্তু যে কাজটি করে গেলেন তিনি, মানবতার যে শিক্ষা দিয়ে গেলেন সুমন, তাতে তার কাছে, এই বাংলার অথবা এই পৃথিবীর অন্য সব মানুষই তো অতি সাধারণ হয়ে গেল।

যে মানবতার জয়গান গেয়ে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করলেন সুমন, তার কিছুটা হলেও প্রতিদান দেওয়ার সময় এসেছে। দুর্দশাগ্রস্ত পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো, তাদের জীবনটাকে একটু হলেও সহজ করে দেওয়া সমাজের দায়িত্ব।

রাজধানীর বনানী লাগোয়া কড়াইল বস্তির মোশারফ বাজারে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে নিয়ে যাবে সুমনদের বাসায়। বৃহস্পতিবার সরেজমিনে গেলে হৃদয়বিদারক এক পরিবেশের মুখোমুখি হতে হয়। পরিবারের উপার্জনক্ষম এই মানুষটিকে হারিয়ে শোক ছড়িয়েছে সবার চোখেমুখে। থমথমে পরিবেশ এসে ভর করেছে ‘সোনার সংসারে।’ হ্যাঁ, সোনার সংসারই তো। যার তিন তিনটি ফুটফুটে সন্তান তার দুনিয়া কি আর সব মানুষের মতো ছিল? স্বল্প আয়ের মানুষ হলেও স্বপ্ন দেখতে তো দোষ নেই। সদ্যপ্রয়াত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি মিসাইলম্যান খ্যাত এপিজে আবদুল কালামই বলে গেছেন, ‘সত্যি হওয়ার আগ পর্যন্ত স্বপ্ন দেখে যেতে হবে। আর স্বপ্ন না দেখলে কাজ করা যায় না।’

পড়ালেখায় নিজে খুব বেশি এগোতে পারেননি সুমন। চেয়েছিলেন বড় মেয়ে সুমী লেখাপড়া করে বাবার সেই মনের কষ্ট মুছে দেবে। ছেলেটা যখন বড় হয়ে শিক্ষিত হয়ে বুক উঁচু করে বাবাকে প্রথম উপার্জনের টাকা তুলে দেবে, তখন বুক ফুলিয়ে সুমন সবাইকে বলবে, ‘দেখো আমার রাকিব কত বড় হইছে। শিক্ষিত হইছে। আমার বাপ আমার মুখ উজ্জ্বল করছে।’ স্ত্রী লাকি আক্তারকে প্রায়ই এসব কথা বলতেন তিনি। এসব স্মৃতি মনে করে ক্ষণে ক্ষণে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনিও। দু-এক ফোঁটা চোখের পানি যখন কোলের শিশুর কপাল ছুঁয়ে যায়, তখন আলতো করে তা আঁচলে মুছে দেন লাকি। কিন্তু ললাটের লিখন মুছে দেওয়ার সাধ্য তো নেই তার।

নি¤œবিত্তের সংসার বলতে যেমনটা বোঝায় ঠিক তেমন একটা পরিবারের ছেলে সুমন। ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার মাদারীনগরের ছেলেটি বাবা আবদুল কুদ্দুসকে হারিয়েছেন অনেক আগে। বুড়ো মা মোসাম্মৎ আনোয়ারার দেখভালের দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। অসচ্ছল পরিবারের সন্তান হলে যা হয়। লেখাপড়ার পাঠ কৈশোরে চুকিয়ে জীবন যুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন তিনি।

জয়ী হওয়ার অদম্য ইচ্ছাই ছিল এগিয়ে যাওয়ার শক্তি। কখনো কারো সঙ্গে কটুকথা বলেছেন, এমন নজির নেই। অত্যন্ত সদালাপী মানুষ ছিলেন সুমন।

‘নামের সঙ্গে বেশ মিল ছিল তার। সত্যিই সুন্দর একটা মন ছিল মানুষটির। কখনো কল্পনাও করিনি তার মৃত্যু ঘটবে। কথায় আছে না, ভালো মানুষ বেশি দিন দুনিয়াতে থাকে না। তাই হলো’Ñ বলছিলেন সুমনের প্রতিবেশী আল মামুন হোসেন। ‘কখন কারো সঙ্গে রাগ করে কঠিন ভাষায় কথা বলেছেন এমনটা শুনিনি। বরং কারো সঙ্গে রাগ করলে কিছুক্ষণ পর নিজে থেকেই গিয়ে কথা বলতেন। মুখকালো করে থাকতেন না। হাসিখুশি লেগেই থাকা তার মুখে।’

কড়াইল বস্তির মোশারফ বাজারের কাছে ছোট টিনশেড ঘরে এখন শূন্যতা। সবাই আছে। কিন্তু তারপরও যেন কেউ নেই। দেয়ালে ঝুলছে স্ত্রী ও মেঝো ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তোলা ছবিটা। ফ্রেমের কাচটা বোধহয় অনেক আগেই ফেটে গেছে। এই ছবি এখনো শুধু স্মৃতি। মনে হতেই আঁতকে ওঠে কিশোরী সুমী আক্তারের মন। বাবা নেই, কচি মনে এ যেন বড় একটা দাগ। ‘আব্বুকে আল্লাহ নিয়া গেল কেন? আমাগো কী হবে? আব্বুরে আমরা কই পামু?’ হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে শব্দ করে কেঁদে উঠছিল মেয়েটি। এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারো। আশপাশের মানুষজন বুঝি সেই ব্যর্থতা মনে করেই কাঁদছে। চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না কেউ। প্রতিদিনই ভিড় জমাচ্ছে পাড়া- প্রতিবেশীরা। যাদের সঙ্গে নিত্যদিনের মুখ দেখাদেখি ছিল সুমনের।

একটি অপূরণীয় ক্ষতি বুকে আঁকড়ে বাঁচতে হবে সুমনের স্ত্রী লাকি আক্তারকে। কিন্তু কী হবে তাদের? একেকটা দিনের সূর্য উঠছে। সন্ধ্যা হচ্ছে। দিনরাতের ২৪ ঘণ্টা স্বামী-হারা এই নারীর কাছে ২৪ যুগের মতো মনে হচ্ছে। সুমী আর রাকিবের মুখের দিকে তাকিয়ে কান্না সামলে নিয়ে সন্তানদের বাঁচার সাহস দেওয়ার চেষ্টা করলেও সেই চেষ্টা ফিকে হচ্ছে কোলের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে। হায়! মেয়েটি তার বাবাকে ডাকারও ভাগ্যও পেল না। বলছিলেন, ‘একটা মানুষ নিজের জীবনের মায়া করল না, আমাগো মায়া করল না, অচেনা একটা বাচ্চাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই লাশ হইল। সঙ্গে সঙ্গে আমাগোও জীবিত লাশ কইরা গেল। এখন আমাগো কী হইব আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।’

স্ত্রী-কন্যারা আপাতত আছেন সুমনের ভাইয়ের সংসারে। টাকা আয়ের উপায় এখনো শেখা হয়নি লাকির। সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে তার। স্বামীর ইচ্ছা অনুযায়ী সন্তানদের পড়াতে পারবেন তো তিনি? বাবার মতোই উদার চিত্তের হবে তো? ভাবতে গেলেই দুই চোখে নামে অশ্রুর ঝরনা।  

নিঃস্ব পরিবারটির কী হবে?

কী হবে সুমনের পরিবারের? বনানীর ম্যাডোনা ফ্যাশন নামের একটি তৈরি পোশাক কারখানার গুদামশ্রমিক ছিলেন তিনি। একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছিলেন প্রায় দশ বছর। টানাপড়েনের সংসার টেনে তুলতে গিয়ে অর্থকড়ি জমাতে পারেননি মোটেও। তার মৃত্যু অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে পরিবারটিকে। নিদারুণ অন্ধত্বের শিকার পরিবারটি এখন পথ দেখছে না।

‘কোথায় যাবে তারা? কার দুয়ারে দাঁড়াবে?’ এই প্রশ্নগুলো বারবারই সামনে আসছে। সমাজে অনেক বিত্তশালী মানুষ আছে যাদের দয়ার ছিটেফোঁটা পেলে পরিবারটি বেঁচে যেতে পারে। বুকের সন্তানকে জড়িয়ে সেই মিনতি করলেন সুমনের স্ত্রী লাকি আক্তার। ‘সরকার আমাগো দিকে একটু দেখব না? আমরা গরিব বইল্যা কেউ কি আমাগো দুঃখ বুঝব না? দেশে তো অনেক ধনী মানুষ আছে। হেগো একটু দয়া পাইলে তিনটা পোলাপান নিয়া বাঁচতে পারতাম। আমার স্বামী তো কোনো অন্যায় করতে গিয়ে মারা যায় নাই। একটা শিশুর জীবন বাঁচাইতে গিয়া নিজের বাচ্চাদের এতিম করছে। কেউ কি এইভাবে নিজের জীবন দিয়া এই কাজ করব? একটা মানুষ যেইখানে নিজের কথা না ভাইবা একটা বাচ্চারে বাঁচাইছে তার বাচ্চাগো বাঁচানোর জন্য কী কেউ আগাইয়্যা আইব না?’

সুমনের আত্মীয় মো. আশিক রানা বলেন, ‘সুমন আমার আপন ভাইয়ের চেয়েও বেশি কিছু ছিল। সবসময় হাসিখুশি রাখতেন আমাদের। তার সামনে মুখ গোমড়া করে থাকা যেত না। এখন তার পরিবারটা অনেক অসহায় অবস্থায় পড়ে গেছে। বিত্তশালী মানুষ যদি এগিয়ে আসে তাহলে এই পরিবারটা খেয়েপরে বাঁচতে পারবে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানো সম্ভব হবে। তাছাড়া সুমনের স্ত্রীর কোলে দু মাসের সন্তান। সে কখনো কোনো কাজকর্ম করেনি। তার পক্ষে তো আয় করা সম্ভব না।’

সুমনের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করার জন্য একটি ব্যাংক হিসাব নম্বর খোলা হয়েছে। হিসাবের নাম: লাকি, অ্যাকাউন্ট নম্বর: 0783209000001995, ব্যাংকের নাম: ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল), মহাখালী শাখা।



স্মৃতি উঁকি দেয় প্রতিবেশীদের মনে

মহাখালীর মোশারফ বাজার এলাকায় নাম বলতেই একজন এগিয়ে এলেন। ‘সুমন আমাগো বস্তিতে থাকত ঠিকই, কিন্তু হের মনডা আছিল আকাশের মতো। তা না হলে এই যুগে কেউ নিজের জীবন দিয়া এমন কাজ করে?’ বলছিলেন স্থানীয় বৃদ্ধ মজিবুর রহমান। ‘আল্লাহ তারে জান্নাত নসিব করুক।’

মোশারফ বাজারের ঠিক পেছনের রাস্তা ধরে এগোতেই হাতের বাঁয়ে এক দোকানি জানতে চান কোথায় যাচ্ছি। গন্তব্য বললে হাজী আবুল হাসান এই সময়কে বলেন, ‘খবর শোনার পর থেকে মনের মধ্যে হাহাকার করে উঠছে। ছোট মেয়েটা জন্মগ্রহণের পর ছোটখাটো অনুষ্ঠান করেছিল বাসায়। আমাকে যেতে বলেছিল। কিন্তু মনে ছিল না। পরে এসে দুঃখ জানিয়েছিল সুমন। ওকে বলেছিলাম, বাবা বাইচ্যা থাকলে তোমার বাড়িতে কত যাব। মৃত্যুর খবর শোনার পর ওর মায়া মুখটি বারবার মনে পড়ছে।’

সুমনের বাসার গলির মুখের একটি দোকানে সদাই করতে এসেছেন পারুল নামে মধ্যবয়সী এক নারী। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তার কোনো খারাপ দেখি নাই। অনেক ভালো মানুষ আছিল। ময়-মুরব্বি দেখলে সালাম দিত। আল্লাহ এই মানুষরে বেশিদিন দুনিয়ায় রাখে না। কখন কার হুকুম হয় কে জানে।’

সুমনের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকতেন খাইরুল বাশার। তিনিও কাজ করেন ম্যাডোনা ফ্যাশনসে। সুমন সম্পর্কে বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন এই তরুণ। ‘আসলে ভাই তার কথা কী বলব। আমার তার মৃত্যুর খবর শুনে বিশ্বাস হয় নাই। একটা মানুষের এমন করুণ মৃত্যু ভাবতেই কষ্ট হয়।’ প্রতিবেশী ফারুক হোসেন বলেন, ‘বস্তি এলাকায় থাকলেও সুমন ভাই আমাদের গর্বের। আমরা গর্ব করে বলতে পারব যে, একটা বাচ্চাকে বাঁচাতে গিয়ে আমাদেরই এক ভাই জীবন দিয়েছে। এটাই কজন বলতে পারে বলুন?’

আরেক প্রতিবেশী সাথী আক্তার বলেন, ‘হয়ত রেললাইনে ছেলেটাকে দেখে নিজের ছেলের কথা মনে হইয়্যা গেছিল। তাই জীবনের মায়া না কইরা ট্রেনের সামনে থেকে বাচ্চাটাকে বাঁচাইতে গেছে। এই জগতে কয়জন পাইবেন এমন দিলদরাজ মানুষ, যারা এইভাবে জীবন দিতে পারে? নিজের সন্তানের জন্যও তো মানুষ এত ত্যাগ করে না।’

কথা ছিল মোশারফ বাজারের কাছের মসজিদে জানাজা হবে সুমনের। অপেক্ষায় ছিলেন পাড়া-প্রতিবেশী। কিন্তু শেষমেশ টিঅ্যান্ডটি মসজিদে জানাজা হয়। এই খবরটা পাননি প্রতিবেশী বাদল মিয়া। ‘খারাপ লাগতাছে। মনে বড় দুঃখ শেষ দেখাও দেখতে পারলাম না। জানাজাও পড়তে পারলাম না। ভালো মানুষের জানাজায় থাকাও পুণ্যের কাজ’-বলছিলেন বাদল মিয়া।

জীবনে কখনো কাঁদেনি কেউ, মরণে কেঁদেছে

বেঁচে থাকতে সুমন কারো মনে কষ্ট দিয়েছে এমনটা মনে নেই কারো। সবার মুখেই সুমনের সুনাম আর সুব্যবহারের প্রতিচ্ছবি। কেমন ছিলেন তিনি? এই প্রশ্নের অভিন্ন উত্তর দিলেন সবাই। ‘ভালো, খুব ভালো।’ কখনো কারো সঙ্গে কটু ব্যবহার তো দূরে থাক জোর গলায় কারো সঙ্গে কথা বলেছেন এমনটা বলতে পারবে না কেউ। যদিও চলার পথে কারো সঙ্গে সাময়িক কঠিন আচরণ করে বসতেন পরক্ষণেই ছুটে যেতেন তার কাছে। ক্ষমা চাইতেন নিজের ভুলের জন্য। বুকে বুক মেলাতেন শত্রুর সঙ্গে। যে কারণে সুমন ছিলেন সবার কাছে বিনয়ী এক মানুষ।

শিশুদের ভালোবাসতেন তিনি। প্রায়ই ছিন্নমূল শিশুদের খাবার কিনে দিতেন। যতটুকু পারতেন নিজের সাধ্যের মধ্যে করতে চেষ্টা করতেন শ্রমজীবী মানুষটি। ‘একবার বস্তির ছোট একটা পোলা হারাইয়্যা গেল। তারপর সুমন এইখানে সেইখানে খুঁইজা তারে মায়ের কোলে ফিরাইয়্যা দিছে। সুমন কইত, আমারেও আল্লায় পোলাপান দিছে। মা-বাপের কাছে সন্তানের মূল্য তো আসমান সমান। তাই বাচ্চাগো কষ্ট দেখলে ভালো লাগে না।’ স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন আব্দুল কাইয়ুম নামে এক বাসিন্দা।

সহকর্মীদের কাছেও ছিলেন প্রিয়ভাজন

সহকর্মীদের কাছেও সুমন ছিলেন প্রিয়ভাজন একজন মানুষ। কখনো কারো মনে কষ্ট দেননি তিনি। সবার সঙ্গে ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ। কাজের প্রতিও ছিল আন্তরিকতা। কখনো কাজ ফাঁকি দিয়েছেন এমন নজির নেই। যে কারণে ম্যাডোনা ফ্যাশন প্রতিষ্ঠানে প্রায় এক যুগ কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। অন্যের কষ্ট দেখলে নিজেই এগিয়ে যেতেন। তাই বলে সহকর্মীদের সঙ্গে একেবারেই খুনসুটি হতো না তা নয়। কিন্তু তারপরও মানুষটি ছিলেন সবার চেয়ে আলাদাই।

তার এক সহকর্মী বলেন, ‘সুমন ভাই আমাদের বড় ভাইয়ের মতো ছিলেন। চোখের সামনে তাকে মারা যেতে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না।’ সুমনের দুর্ঘটনার পর ওইদিন পুরো প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরাই নেমে এসেছিলেন নিচে। তখনে রেললাইনে পড়েছিলেন তিনি। তার আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল দু-পায়ের ছিন্নভিন্ন অংশ। পা দুটোর হাড়সহ থেঁতলে গিয়েছিল। মাথাতেও আঘাত পেয়েছিলেন খুব। সহকর্মীদের অনেকে চোখ বন্ধ করলেই সেদিনের সেই ঘটনা ভেসে ওঠে। জলজ্যান্ত একটা মানুষকে এভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখে একেবারে ভাবলেশহীন থাকতে কজনই পারে?

দুপুরের খাবারটিও খাওয়া হয়নি তাঁর

কাজের ফাঁকে দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় হয়ে এসেছিল। বনানীর সৈনিক ক্লাবের কাছে ম্যাডোনা ফ্যাশন থেকে একটা কার্টন ভরা মালামাল নিয়ে নিচে নেমেছিলেন সুমন। ক্লান্ত শরীর একটু জিরিয়ে নিতে চাইছিল। পেটেও ছিল ক্ষুধা। পাশেই একটা দোকানে চা পানের জন্য যান। সহকর্মীদের কয়েকজন ছিল তাঁর সঙ্গে। চায়ের কথা বলে রেললাইনের দিকে নজর পড়ে সুমনের। প্রত্যক্ষদর্শীদের কথায়, চোখের পলকে দৌড়ে যান সুমন। একটা লাফ দিয়ে দানবগতির ট্রেনের সামনে থেকে দূরে ফেলে দেন একটি শিশুকে। ততক্ষণে চা হয়ে গেলেও সুমন আর ফেরেনি। সবাই তার কাছে ছুটে গিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা সুমনকে ধরাধরি করে তুলে হাসপাতালে ছুটতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

ওই শিশুটির কোনো হদিস নেই

যেই শিশুটিকে ঘিরে এতকিছু, জীবন দিতে হলো সুমনকে তার কোনো হদিস মিলছে না। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কূলকিনারা করা যায়নি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রেললাইনের পাড় ঘেঁষেই বস্তিঘর। এসব ঘরে যারা থাকেন তাদেরই ছেলে সন্তান হবে শিশুটি। কিন্তু অজানা আতঙ্কে পরিচয় দিতে সাহস পাচ্ছেন না কেউ। তবে অনেকের মন্তব্য, ঘটনার পর শিশুটিকে তার পরিবারের লোকজন এখান থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে গেছে।

 বাবা-ভাইয়ের পাশে অন্তিমশয়ন

ঈদ করতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নান্দাইলে গিয়েছিলেন সুমন। সুযোগ পেলেই বুড়ো মায়ের কাছে ছুটে যেতেন তিনি। সন্তানকে হারিয়ে মা আজ বাকরুদ্ধ। কথা হারিয়ে ফেলেছেন বয়সের ভারে নুয়ে-পড়া এই নারী। সুমনরা ছয় ভাই, চার বোন। এর মধ্যে এক ভাই ও এক বোন মারা গেছেন আরও আগে। বাবাও মারা গেছেন অনেক দিন হলো। সুমন ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয়। ঈদের পর মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় কথা দিয়ে এসেছিল আসছে ঈদুল আজহায় আবারও বাড়ি যাবেন তিনি। কথা তিনি রেখেছেন। বাড়ি গেছেন কিন্তু ঈদে নয় তারও অনেক আগে। আনন্দ নয় একবোঝা কান্না সঙ্গে করে, সাদা কাফনে জড়িয়ে। সুমনের এমন মৃত্যু কারোরই কাম্য ছিল না। সবাই শোকবিহ্বল। কান্না লুকানোর জায়গা নেই। তাই চোখের পানিতেই বিদায় দিতে রাতে গ্রামের বাড়িতে সুমনের দ্বিতীয় নামাজে জানাজায় লোকের ঢল নেমেছিল। ৪ আগস্ট রাতেই বাবা, ভাইয়ের শিথানের পাশে চিরনিদ্রায় শোয়ানো হয় তাকে। শ্রাবণের আকাশে তখনো মেঘ ছিল। মেঘগুলো কান্না হয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছিল একজন মহান হৃদয়ের মানুষকে বিদায় দিতে।

রেল সংলগ্ন বসতি, বাজার উচ্ছেদে সমস্যা কোথায়?

রাজধানীতে রেললাইনের দুই পাশে ছোট ছোট বস্তি আর বাজার নিত্যদিনের চিত্র। রেল চলাচলে ঝুঁকিপূর্ণ এসব এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না খোদ প্রশাসনও। উচ্ছেদের পরপরই আবারও শুরু হয় সরকারি এসব জায়গা দখল। প্রভাবশালীদের যোগসাজশ থাকার কারণেই অবৈধ এসব বসতি উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না বলে মনে করেন উচ্ছেদ পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেটরা। এসব কারণে শুধু সরকারি জায়গা দখল হচ্ছে এটাই মূল সমস্যা নয়, রেল চলাচলেও হরদম বিঘœ ঘটছে।

রেললাইন ঘেঁষে এসব ঝুঁকিপূর্ণ বসতি প্রায়ই মৃত্যুর মতো দুর্ঘটনা ডেকে আনছে। এতে নিহত হচ্ছে বস্তিবাসী, শিশু, নারী, বৃদ্ধরা। বাদ যাচ্ছে না সাধারণ পথচারীও। অথচ এসব ছিন্নমূল মানুষকে অন্য কোথাও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে পারলে অনাকাক্সিক্ষত রেল দুর্ঘটনা এড়ানো যেত সহজেই। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সুমনের মৃত্যুও এসব ঝুঁকিপূর্ণ বসতির কারণে। যে শিশুটিকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিতে হলো তরুণ সুমনকে সেই শিশুটি বস্তিবাসী কারো সন্তান। খেলার ছলে শিশুটি হয়ত উঠে এসেছিল রেললাইনে আর খেসারত দিতে হলো তিন সন্তানের জনককে।  

দেশের প্রায় সব জায়গাতেই রেললাইন ঘেঁষে বসতি ও বাজার চোখে পড়ে। বিশেষ করে বনানী, তেজগাঁও, কারওয়ানবাজার, খিলগাঁও এলাকায় রেললাইন লাগোয়া ঘিঞ্জি বসতি, দোকানপাট চোখে পড়ে। ১০ মাস আগে কারওয়ানবাজারের রেললাইনে কাটা পড়ে মারা যান চার জন। এরপরই নড়েচড়ে বসে কর্তৃপক্ষ। শুরু হয় রেললাইনের পাশের স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান। বেশ কিছুদিন চলার পর থেমে যায় এ কার্যক্রম। উচ্ছেদের পরপরই রেললাইনের পাশে আবারও গড়ে ওঠে বস্তি আর বাজার। বিভিন্ন স্থাপনার মাত্র একহাত পাশ দিয়েই যাচ্ছে ট্রেন। ঝুঁকি আর দুর্ঘটনা কোনোটিই ঠেকাতে পারছে না এই প্রবণতা।

তবে বসবাসকারীরা বলছেন, নিরুপায় তারা। একজন বলেন, ‘ছেলেমেয়ে নিয়ে বেঁচে থাকতেই আমাদের এখানে বসবাস করতে হচ্ছে। ঘরভাড়া, খাওয়া খরচ দিয়ে অন্য কোথাও থাকা সম্ভব নয়।’ রেললাইনের পাশ ঘেঁষে বসা এক দোকানি বলেন, ‘আমাদের মাঝেমধ্যে তুলে দিলেও নিরুপায় হয়ে আবার এখানেই দোকান নিয়ে বসতে হয়।’

একজন পথচারী জানান, এখানকার বস্তিগুলোতে মাদক বিক্রি ও নানা অবৈধ কার্যক্রম চলে। তবে রাজউকের এক কর্মকর্তা বলছেন, প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশেই অবৈধভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে এসব জায়গা। রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রোকন উদ দৌলা বলেন, ‘এখানে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ অনেকেই জড়িত, তারাই এখানে মানুষজনকে থাকার জায়গা দিয়ে মাসে মাসে ভাড়া আদায় করে। এতে করেই বস্তিগুলো মাদক ও নানা অসামাজিক কার্যকলাপের আখড়া হয়ে ওঠে।’ সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।