চট্টগ্রাম: ১৯৮৪ সালে পাকিস্তান থেকে আমদানি করা নিম্মমানের ডিডিটি (ডাইক্লোরো ডাইফিনাইল ট্রাইক্লোরোইথেন) পাউডারের সংরক্ষনাগার বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ৪টি সরকারি গুদাম এখন রাসায়নিক বোমায় পরিণত হয়েছে। এসব পাউডার নিষ্ক্রিয় করার ক্ষমতা নেই বাংলাদেশের।
জার্মান বা যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়েই ধ্বংস করতে হবে এসব পাউডার। যা করতে ব্যয় হবে প্রায় ৮ মিলিয়ন ডলার বা সাড়ে ৬২ কোটি টাকা। অথচ এসব পাউডার এরশাদ সরকারের আমদানি আমদানি করা হয়েছিল ৩ কোটি ৫৯ লাখ ১৪ হাজার ৬৪০ টাকা ব্যয়ে।
বর্তমানে পাউডারগুলো সংরক্ষিত রয়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে অবস্থিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (ঢাকা) নিয়ন্ত্রিত সহকারী পরিচালক (স্বাস্থ্য) পোর্ট ক্লিয়ারেন্সের (চট্টগ্রাম) কার্যালয়ের ৪টি গুদামে। এ এলাকায় মোট ১১টি সরকারি গুদাম রয়েছে।
কার্যালয়ের কর্মকর্তা এ কে এম শাহাদাত হোসেন জানান, ম্যালেরিয়া রোগ নিয়ন্ত্রণে মশা নিধনের জন্য 'পাবলিক হেলথ প্রোগ্রাম' প্রকল্পের আওতায় পাকিস্তান থেকে ৫০০ মেট্রিক টন ডিডিটি আমদানি করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো অতি নিম্মমানের হওয়ায় ব্যবহার না করে চট্টগ্রামে ৪টি সরকারি গুদামে ফেলে রাখা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ঢাকা টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষায় এসব পাউডার নিম্মমানের বলে প্রমাণিত হয়।
তিনি বলেন, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ওই সময় এসব ডিডিটি ধ্বংসের সতর্কবার্তা দেয়। কিন্তু এখনো এসব ডিডিটি ধ্বংস করা সম্ভব না হওয়ায় তা মহাবিপদ ঘটাতে শুরু করেছে। ডিডিটির বিষক্রিয়া বাতাসে ছড়িয়ে মারাতœক দূষণ ঘটছে। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় গুদামের দেয়ালে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে।
গুদামের স্টোরকিপার নাছির উদ্দিন জানান, আট বছর আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এসব ডিডিটি পরিদর্শন করে অফিস এলাকায় কোনরকম খাবার ও পানি পান করতে নিষেধ করেন। নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত পরিদর্শনে এসে ডিডিটির ভয়াবহতার কথা জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে গেলে গুদামের চারপাশে ডিডিটি পাউডারের অসহনীয় দূর্গন্ধ পাওয়া যায়। গুদামের ভেতর ঢুকতে চাইলে স্টোরকিপার নাছির উদ্দিন বলেন, গুদামের ভেতর মারাতœক গ্যাস সৃষ্টি হওয়ায় তা যে কোন সময় বোমার মত ভয়াবহ বিস্ফোরণ হতে পারে। এমনকি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্রের মত জনস্বাস্থ্যের প্রাণহানীও ঘটাতে পারে।
তিনি জানান, রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারনে গুদামের বিভিন্ন অংশে এরই মধ্যে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া কিছু ভাঙাচোরা দরজা-জানালা-ভেন্টিলেটরের ফাঁকফোকর দিয়ে ডিডিটি পাউডারের দুর্গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে।
পোর্ট ক্লিয়ারেন্স কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. সফিউল আলম চৌধুরী জানান, ডিডিটির কারণে গুদামে কর্মরত-কর্মচারীরা নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছে। এসব পাউডার ধ্বংস করার জন্য এ পর্যন্ত সরকারের কাছে একাধিক প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।
তিনি জানান, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) অর্থায়নে এসব পাউডার ধ্বংসের উদ্যোগ নিলেও তার গাতি খুবই কম। এতে ব্যয় হবে আট মিলিয়ন ডলার বা প্রায় সাড়ে ৬২ কোটি টাকা। এ ব্যাপারে গত ২ মার্চ ইতালি থেকে আসা এফএওর প্রতিনিধিদের সাথে চট্টগ্রামে জরুরি বৈঠক হয়। বৈঠকে এফএওর অর্থায়নে যত দ্রুত সম্ভব পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ ওই ৫০০ টন ডিডিটি দেশের বাইরে নিরাপদে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত হয়।
বৈঠক এফএওর প্রতিনিধি মার্ক ডেভিস বলেন, ডিডিটি বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি দেশে ধ্বংস করার ব্যবস্থা আছে। এগুলো সম্ভবত জার্মানি বা যুক্তরাষ্ট্রে ধ্বংস করা হতে পারে।' তিনি বলেন, ডিডিটি এমন ক্ষতিকারক যে যেসব দেশে এটা ব্যবহার করা হয় সেসব দেশে উৎপাদিত ফসলি ও ফলজ দ্রব্য অন্য দেশে আমদানি করা হয় না।
তিনি বলেন, ৩১ বছর ধরে '৫০০ টন ডিডিটি সরকারি গুদামে আছে, এ কথা শুনে আমার অবাক লাগছে। আমার জানা মতে, শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর কোনো দেশে এখন আর ডিডিটি উৎপাদন হয় না।'
তিনি আরো বলেন, ডিডিটি ফসলি জমিতে শাকসবজিতে যাতে পোকার আক্রমণ না হয় সে জন্য ব্যবহার করা হতো। দেখা গেছে, খাদ্যচক্রের মাধ্যমে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এতে জীবকোষ ধ্বংস হয়ে যায়। একপর্যায়ে ক্যান্সারসহ অনেক জটিল রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সৈয়দ নুরুল আলমের নেতৃত্বে একটি টিম সম্প্রতি গুদাম পরিদর্শন করে। এ সময় তারা চারটি গুদামে থাকা ডিডিটি পাউডারের ৫০টি নমুনা সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া তারা গুদাম এলাকায় উৎপাদিত কাঁঠাল, কামরাঙা, পেয়ারা, বাদামসহ বিভিন্ন ফসলের নমুনা সংগ্রহ করে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী সরওয়ার ইমতিয়াজ হাশমি বলেন, 'পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পাই, যেসব গুদামে ডিডিটি পাউডার রয়েছে তার আশপাশে পোকামাকড় নেই, সব মরে গেছে। ডিডিটির বিষক্রিয়ায় পুরুষের শুক্রাণু ও নারীর ডিম্বাশয় নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মায়ের শালদুধের মাধ্যমে সন্তানেরও ক্ষতি হতে পারে। এ ছাড়া মানুষের শরীর ও পরিবেশে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করতে পারে।'
চট্টগ্রামে পোর্ট ক্লিয়ারেন্স কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. সফিউল আলম চৌধুরী বলেন, এসব ডিডিটি পাউডার নিয়ে একদিকে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে মামলা চলছে, অন্যদিকে সরকার সেগুলো ধ্বংস করার জন্য এফএওর সহযোগিতা চেয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক বেণু কুমার দে এ প্রসঙ্গে বলেন, এই রাসায়নিক জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচির্ত্যের জন্য হুমকি। ১৯৭১ সালে পরাজিত শক্তি পাকিস্তান বাঙালী জাতি নিধনের চক্রান্তের অংশ হিসেবে জেনে শুনে অত্যন্ত নিম্মমানের ভয়ংকর ক্ষতিকারক ডিডিটি পাউডার সরবরাহ করেছে।
তিনি জানান, ১৯৮৫ সালের ১৯ মার্চ ওই ডিডিটির চারটি নমুনা পরীক্ষার জন্য জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় পাঠানো হয়। তারা নিম্মমানের রিপোর্ট দেওয়ায় সরকার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে (মেসার্স এক্সচেঞ্জ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড) ১০০০ টন ডিডিটি পাউডার প্রতিস্থাপনের নির্দেশ দেয়।
কিন্তু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আইসিসি কোর্টে সালিসি মামলা দায়ের করলে তা বাংলাদেশ সরকারের বিপক্ষে যায়। সরকার ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল মামলা দায়ের করে, যা বর্তমানে নি®পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
(ঢাকাটাইমস/ ২৯ জুলাই/আইখ/ এআর/ ঘ.)