সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। স্বাধীনতাবিরোধী বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর মতোই রাজনীতিতে সব সময় এক আলোচিত খলচরিত্র। বিতর্কিত মন্তব্য, উদ্ধত আচরণের জন্য বারবার সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। রাজনীতি আর সন্ত্রাসের মিশেলে পাকিস্তান আমল থেকেই ভীতি ছড়ানোর কৌশল নিয়েছিলেন শুরু থেকেই। পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরে স্বাধীনতাকামী বাঙালির স্বপ্নসাধ চূর্ণ করে দেওয়ার চেষ্টায় হত্যা-গণহত্যায় জড়িয়েও পার পেয়ে গেছেন নানা কারণে। পরে আবার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, নির্বাচিত হয়েছেন সংসদ সদস্য, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করেছেন।
এত বড় অন্যায় করেও কিছু না হওয়ায় দিনে দিনে বেড়েছে ঔদ্ধত্য। কেউ টিকিটাও ছুঁতে পারবে না, প্রকাশ্যেই বলতেন। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রকাশ্য আলোচনাতে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলতেন, ‘রাজাকার ছিলাম, পারলে বিচার করেন।’
জোট সরকারের শাসনামলের অবসানের পরও তীর্যক, অশালীন মন্তব্য করে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কটাক্ষ করতে গিয়ে। গ্রেপ্তার হওয়ার আগেও বলে যেতেন, তার কিছু হলে চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে আলাদা করে ফেলবেন। গ্রেপ্তার হওয়ার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক, আইনজীবীরাও বাদ পড়েনি তার অশালীন ও ব্যাঙ্গাত্মক বাচনভঙ্গি থেকে।
নিজেকে রক্ষায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর এ রকম বেপরোয়া আচরণ আর কথাবার্তায় এমন এক ধরনের সংশয় তৈরি হয় যে, আদৌ বিচারে তার সাজা হবে কি না। এমনকি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদ- দেওয়ার পরও দূর হয়নি সংশয়, অবিশ্বাস। আপিল বিভাগে রায়ের আগে নানা জল্পনা-কল্পনা ডালপালা মেলতে থাকে রাজনৈতিক পরিম-লে। তবে সব উড়িয়ে দিয়ে আইনের শাসনের ঝাণ্ডা উঁচুতে তুলে ধরে আপিল বিভাগ যখন ঘোষণা দিয়েছে যে, ফাঁসিতেই ঝুলতে হবে এই নেতাকে, তখন বোঝা গেল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ আসলে ছিল তার বাঁচার কৌশল।
প্রভাবশালী ও কথিত জনপ্রিয় এই নেতার ফাঁসির রায়ের পর নিজ এলাকাতেও কেউ টু-শব্দটি করল না, বরং উল্লাস হয়েছে দেশজুড়ে। বোঝা গেল সংসদ সদস্য নির্বাচনে জেতার পেছনে ‘কিন্তু’ আছে।
‘কিরে ভোট ন দিবি?’ (ভোট দিবি না?)
‘হ দিয়ুম, অনরে ছারা হারে দিয়ুম’ (জি, আপনাকে ছাড়া আর কাকে দেব)
‘অইয়ে, তোর ভোট ফাইয়ি, আর কেন্দ্রত ন যাইছ’ (ঠিক আছে, তোর ভোট পেয়েছি, তাহলে আর কেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নাই)
নির্বাচনের আগে হিন্দু অধ্যুষিত রাউজানে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রচারে এ রকম কথা শোনা গেছে প্রায়ই। এমন ভীতিকর পরিস্থিতি তিনি তৈরি করে রেখেছিলেন যে, একাত্তরে যাকে হত্যার দায়ে তার ফাঁসির আদেশ হয়েছে সেই নূতন চন্দ্র সিংহের ছেলে প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহকে তার নির্বাচনের প্রস্তাবক করেছেন দিনের পর দিন। ভয়ে আর্ত প্রফুল্ল এই কাজ করে গেছেন। তবে আপিল বিভাগের রায়ের পর সব আবেগ উথলে পড়েছে তার। বাবার খুনির ফাঁসি দেখতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার কথা বলেছেন তিনি।’
২০১০ সালের ডিসেম্বরে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে চট্টগ্রামে নিজ বাড়ি ‘গুডস হিলে’ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, কিছুই হবে না তার। ‘যুদ্ধাপরাধ আমি করে থাকলে আমি কুমিল্লাতেও করি নাই, ঢাকায়েও করি নাই নিশ্চয়ই করেছি চট্টগ্রামে। ওই এলাকার মানুষ তো আমারে যুদ্ধাপরাধী মনে করে না। এখন টুঙ্গিপাড়া থেকে যদি এলান দাও যে হে (সে) যুদ্ধাপরাধী তো দাও। অসুবিধা কী আছে? আর মাছ ধরতে নামছি লুঙ্গি শুকনা থাকবে এই চিন্তা করে নিশ্চয়ই মাছ ধরতে নামি নাই।...একটা সিদ্ধান্ত হয়ে আছে তার পর আলোচনার কী আছে? আমাকে ছেড়ে দেবেন এই আলোচনা? যুদ্ধাপরাধের বিচার করবে তো করবে। ওই দরখাস্ত তো হবে না।’
এভাবে অট্টহাসি আর ব্যাঙ্গাত্মক বাচনভঙ্গিতে লুকাতে চাইতেন নিজের বিমর্ষতা। যুদ্ধাপরাধের বিচারের ‘ভয়’ তিনি করেন না, মুখে এসব বললেও আদপে ভেতরে তার ঠিকই কেঁপে উঠত। ভয়ই তার ক্ষয় হলো। সঙ্গে সঙ্গে পতন হলো ঔদ্ধত্যের। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তার মৃত্যুদ- হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনা চারটি অভিযোগ প্রমাণের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তার ফাঁসির আদেশ দিয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতও বহাল রেখেছে এই রায়।
মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু এই সময়কে বলেন, ‘সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছিলেন আমাদের রাজনীতির এক খলচরিত্র। তিনি নিজেকে রক্ষায় ঔদ্ধত্য, অশালীন ভাষা ব্যবহার কৌশল হিসেবে নিয়েছিলেন। তার বিচার নানা দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। এক দিকে এটা ন্যায়বিচারের প্রশ্ন অন্যদিকে রাষ্ট্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দিনের পর দিন আক্রমণ করে যাওয়া এক উদ্ধত মানুষকে মাটিতে নামিয়ে আনার প্রশ্ন।’
অশালীন বাচনভঙ্গি আর বক্তব্যই অস্ত্র
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর চেয়ে তিনি সাকা চৌধুরী নামে বেশ পরিচিত। রাজনীতিতে এসেছিলেন আশির দশকে। ১৯৭৯ সালে মুসলিম লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই নানা কারণে আলোচিত তিনি। ব্যাঙ্গাত্মক বাচনভঙ্গি, উদ্ভট অট্টহাসি আর কারণে-অকারণে দেশের রাজনীতির শীর্ষস্থানীয়দের নিয়ে হাস্যরসাত্মক বক্তব্য তাকে সমালোচকের মুখে রেখেছে। সংসদে দাঁড়িয়ে কিংবা গণমাধ্যমের সামনে অশালীন বাক্যালাপেও আপত্তি করতেন না বিএনপির এই নেতা। যাকে তাকে যখন তখন এক হাত নিতে মোটেও বাধত না তার। বিএনপির সংসদ সদস্য থাকাকালেও দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে নিয়ে অশোভন মন্তব্য করে আলোচনার খোরাক হয়েছিলেন তিনি। কোনো একটা ইস্যুতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আগে জানতাম কুকুর লেজ নাড়ায়, এখন তো দেখছি লেজে কুকুর নাড়ায়।’ এই বক্তব্যে খোদ বিএনপিতেই ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল সাকা চৌধুরীকে নিয়ে। এরপর নানা ইস্যুতে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সম্পর্কের দূরত্বও বেড়েছে তার। যে কারণে যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেপ্তার থেকে শুরু করে ফাঁসির দণ্ড ঘোষণার পরও ওই অর্থে কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখায়নি বিএনপি।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, সাকা চৌধুরী খাতা-কলমে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হলেও দল তাকে ভেতরে ভেতরে ত্যাগই করেছিল। তা না হলে দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনা হলেও তার মুক্তির দাবিতে একটা বিবৃতিও দেয়নি বিএনপি। এছাড়া কোনো পর্যায়ের নেতাই তার রায়ের ব্যাপারে জোরালো কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। বরং ভাবখানা এমন ছিল, ‘যাক বাবা বেঁচেছি।’
২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকালে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে আটক করা হয়েছিল হরতালের গাড়ি পোড়ানোর একটি মামলায়। তার তিনদিন পর ১৯ ডিসেম্বর একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় তাকে। পারিবারিকভাবে স্থানীয় পর্যায়ে বেশ প্রভাবশালী এই নেতা পারতপক্ষে কিছুকেই পাত্তা দিতে চাইতেন না। সবকিছুকেই তোয়াক্কার ছলে দেখতেন। কিন্তু কারাগারে গিয়ে শুরু থেকেই মুষড়ে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামের দোর্দ- প্রতাপের এই নেতা। তবে সুযোগ পেলে কারাগারে, ট্রাইব্যুনালে কিংবা লোহার শিকের ওপাশে দাঁড়িয়ে নিজের উগ্র মেজাজের জানান দিতেন। মনে করিয়ে দিতেন এখনো ফুরিয়ে যাননি তিনি।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ বিচার চলাকালে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েও ঔদ্ধত্য দেখাতেন সাকা চৌধুরী। বিচারিক প্রক্রিয়ার শুরুর দিকে ২০১১ সালে ট্রাইব্যুনালের বিচারককে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ‘চোখ রাঙাবেন না।’ ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ শুনানি চলাকালে এজলাস কক্ষেই প্রকাশ্যে হুমকি দেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তাকে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘দুই বছর জেলে রাখছস, বাইর হইয়া নেই...’ আবার ২০১৩ সালের ৪ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে সাকা চৌধুরী বলেন, ‘আমাকে আইন শেখাতে আসবেন না। অনেক আইন আমি করেছি। এ আইনও (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩) আমার করা। আপনি তো আমার করা এ আইন পড়েও দেখেননি।’ আইনজ্ঞরা বলছেন, শেষতক নিজের করা আইনেই জড়িয়ে গেলেন সাকা!
বেশ দাম্ভিকতা নিয়েই বলেছিলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে দেখাও দেখি (একাত্তরে) কারো বাড়িতে আগুন দিছি। কারো মেয়েরে নিয়া ধর্ষণ করছি। রেকর্ড যদি থাকত তাইলে দেখাইতে কও না।’ সাকা চৌধুরী এও বলেছিলেন, ‘খাসি চুরি গরু চুরির অভিযোগে আমাকে ধরে নিয়ে গেল। ২০ মাস দুই কম্বলে শুইয়েছে মইন ইউ আহমেদ। সাক্ষীর অভাব অতীতেও হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না। ট্রাইব্যুনালে সব সাক্ষীই পাওয়া যাবে।’ সব কথাই অসত্য হয়েছে তার। ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রাউজানে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, সুলতানপুর ও ঊনসত্তরপাড়ায় হিন্দু বসতিতে গণহত্যা এবং হাটহাজারীর আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজাফফর ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে অপহরণ করে খুনের দায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-ের আদেশ দেয়। ৩৩ মাস বিচার প্রক্রিয়া শেষে এই রায় এসেছিল ট্রাইব্যুনাল থেকে। কিন্তু বিদ্রƒপ করেছিলেন সাকা। ছুটে গিয়েছিলেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। লাভ হয়নি। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ই বহাল রেখে গত বুধবার রায় এসেছে। তার মানে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলেই ফাঁসি গলায় পড়তে হবে সাকাকে।
ট্রাইব্যুনালেও সময়ে সময়ে চড়াও হয়েছেন সাকা
মুখের অঙ্গভঙ্গিতেই যে শুধু অশালীন রূপ ফুটিয়ে তুলতেন সাকা চৌধুরী তা নয়, কাঠগড়াতে দাঁড়িয়েও হরহামেশা অশ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিচারের প্রতি। ২০১৩ সালের ১৭ জুন নিজের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেওয়ার সময় পুরো ট্রাইব্যুনালকে উদ্দেশ্য করেই বলে ওঠেন, ‘আমাকে ফাঁসি তো আপনারা দেবেনই, কিন্তু আমি পরোয়া করি না।’ ওইদিন এমনকি সাক্ষ্য দেওয়া শুরুর আগে আইন অনুসারে শপথ নিতেও অস্বীকার করেন তিনি। তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আমি একজন সংসদ সদস্য। আমি কেন এখানে শপথ নেব?’ পরে শপথ ছাড়াই সাক্ষ্য দিতে শুরু করেন সাকা চৌধুরী।
সাক্ষ্যের এক পর্যায়ে ট্রাইব্যুনালকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনারা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন। দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের জন্ম। তাই এদেশের সংবিধান রক্ষা করাও আপনাদের কর্তব্য। আপনারা সংবিধান রক্ষা করেই বিচার করবেন।’ বিভিন্ন সময়ে প্রসিকিউটরদের হেয় করে ‘পার্সিকিউটর’ বলেছেন তিনি। একবার আদালতে বলেছেন, গত আড়াই বছর ধরে আমার সঙ্গে যা করা হয়েছে তাতে কি ‘পার্সিকিউটর’ বলব না তো কি হাজী সাহেব বলব?
২০১৩ সালের ২ জুলাই ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরদের একদিন ফাঁসিতে ঝুলতে হতে পারে বলে পরোক্ষ ভয় দেখান ওই সময়কার সংসদ সদস্য সাকা চৌধুরী। প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুমকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘আমাকে ফাঁসির কাষ্ঠে দাঁড় করিয়েছেন আর আমি কথা বলতে পারব না? ভবিষ্যতে আপনাদেরও এখানে দাঁড়াতে হতে পারে।’ সেদিন নিজের পক্ষে শেষ দিনের সাফাই সাক্ষ্য দানকালে জেয়াদ আল মালুমকে এ হুমকি দিয়ে প্রকাশ্যে বাদানুবাদে জড়ান তিনি। এ সময় সাফাই সাক্ষ্যের পুরোটাই ইংরেজিতে দেন সাকা চৌধুরী। এর সপক্ষে নিজেকে বাঙালি নয়, চাটগাইয়া বলে দাবি করেন তিনি। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান তাকে বলেন, ‘আপনি বাংলায় সাক্ষ্য দিলে এত সময় লাগত না। তার চেয়েও বেশি কথা বলতে পারতেন।’ জবাবে সাকা চৌধুরী বলেন, ‘আমি বাংলায় সাক্ষ্য দিতে পারব না, ইংরেজিতেই দেব। কারণ, আমি বাঙালি না চাটগাইয়া। বাংলায় তো আমি ভালো বলতে পারতাম না। টেকনিক্যাল প্রবলেম হতো। এক সময় ভাষার প্রতি চরম ঔদ্ধত্য দেখিয়ে বলে ওঠেন, আমার মাতৃভাষা বাংলা নয়, চাটগাইয়া। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার সাক্ষ্যে এ দাবিও করে বসেন, তিনি পছন্দসূত্রে বাংলাদেশি, জন্মগতভাবে নন।
ট্রাইব্যুনালের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে-বসে তীব্র ব্যাঙ্গ-বিদ্রƒপ ও বাক্যবাণ ছুঁড়ে এজলাস কক্ষের পরিবেশও বেশ কয়েকবার উত্তপ্ত করে তোলেন সাকা চৌধুরী। স্বভাবসুলভভাবে সব সময়ই বিচারকাজ চলাকালে গোয়ার্তুমিও করে গেছেন। অনেক সময় বিচার কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করায় তাকে ছাড়াও শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারপরও তিনি চিৎকার-চেঁচামেচি করেই গেছেন। ট্রাইব্যুনাল সাকা চৌধুরীকে অসংখ্য দিন সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘আপনি সহযোগিতা করছেন না। আপনি অসংলগ্ন আচরণ করছেন।’ একবার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিৎকার করে কথা বলে শুনানির কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করায় সাকা চৌধুরীকে মধ্যাহ্ন বিরতির পর এজলাস কক্ষে আনতে নিষেধও করেছিলেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্রক্রিয়াকে ব্যাঙ্গ করার পাশাপাশি রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করারও চেষ্টা করেছেন সাকা চৌধুরী। ট্রাইব্যুনালে তার মামলার রায় ঘোষণার আগে ফাঁস হয়ে যায় ওই রায়ের খসড়া। এ ঘটনায় একটি মামলা এখনো নি¤œ আদালতে বিচারাধীন। এ মামলার আসামি তার স্ত্রী, ছেলে ও আইনজীবীসহ সাতজন।
বিএনপি শুধুই হতাশ!
দলের স্থায়ী কমিটি সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে যখন গ্রেপ্তার করা হয় তখন তিনি সংসদ সদস্যও ছিলেন। কিন্তু তাকে ছাড়িয়ে আনার দাবিতে লাগাতার কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায়নি বিএনপিকে। বরং যখনই এসেছে তার প্রসঙ্গ তখনই দলের শীর্ষ নেতারা এড়িয়ে গেছেন সেটি। ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর ফাঁসির রায়ের পরও ভাবলেশহীন ছিল বিএনপি। কোনো ধরনের জোরালো কর্মসূচিতে ছিল না দলটি। সবশেষ গত বুধবার ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায় বহাল রাখার পরও কেবল ‘হতাশ’ ও ‘বিস্মিত’ হয়েছে বিএনপি। ওই দিন বিকালে রাজধানীর নয়াপল্টনস্থ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ‘এই রায়ে আমরা হতাশ, বিস্মিত এবং বেদনাহত। আমরা মনে করি, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ন্যায়বিচার পাননি। অন্যায্যভাবে তাকে মৃত্যুদ-াদেশ দেওয়া হয়েছে।’
তবে কথিত অন্যায্য বিচারের প্রতিবাদে কোনো প্রতিবাদ সভা বা কর্মসূচিও দেয়নি বিএনপি। বরং তলে তলে দলের স্থায়ী কমিটি থেকে তাকে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে আগেই। বিএনপির আগামী জাতীয় সম্মেলনেই বিষয়টি চূড়ান্ত হবে বলে জানিয়েছেন নেতাদের একাংশ।
তবে সংবেদনশীল বিবেচনায় এ নিয়ে এখনই নাম প্রকাশ করে কিছু বলতে রাজি হননি বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা। যোগাযোগ করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান ও মওদুদ আহমেদ বলেন, এখন এ নিয়ে মন্তব্য করবেন না তারা। তবে দলের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ও সাবেক স্পিকার জমিরউদ্দিন সরকার বলেছেন, তারা আরও কিছু দিন অপেক্ষা করে এই সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে দোষী বিবেচনার ক্ষেত্রে আইনি আরও ধাপ আছে। আপিল বিভাগের রায় রিভিওয়ের সুযোগ আছে। এতে তিনি নির্দোষ প্রমাণ হওয়ার সুযোগ আছে। এতেও যদি তিনি নির্দোষ প্রমাণ না হন তবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ পাবেন তিনি। এসব ধাপ শেষ হলেই পরে বলা যাবে দলে তার অবস্থান কী হবে।
পাকিস্তানের দোসর ছিলেন বাবা
একবার এক সাক্ষাৎকারে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী অকপটেই স্বীকার করেছেন, তার বাবা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন না। অভিযোগ আছে, মুক্তিযুদ্ধকালে তিনিও কাজ করতেন পাকিস্তানি দখলদার সেনাদের সহযোগী হিসেবে। তার বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি ও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার। ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ফজলুল কাদেরের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার অন্যতম অংশীদার ছিলেন তার ছেলে সাকা চৌধুরী। বাবার নির্দেশ পালন করার জন্য একাত্তরের ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের রাউজানে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহকে তিনি পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তায় হত্যা করেন। এটিসহ চারটি অভিযোগে সাকা চৌধুরীকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। এর প্রতিটিতে ফাঁসি বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
ফাঁসির আদেশ আরও যাদের, কার্যকর দুই
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার আপিলের রায় দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এর মধ্যে কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। সাঈদী আমৃত্যু কারাদ- ভোগ করছেন। আর মুজাহিদের ফাঁসি বহাল রেখে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো প্রকাশিত হয়নি।
গুডস হিলকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করার দাবি
সাকা চৌধুরীর ফাঁসির আদেশ বহালের পর চট্টগ্রামে তার বাসভবন গুডস হিলটিকে মুক্তযুদ্ধ জাদুঘর করার দাবি জানিয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা। তারা বলছেন, গণি বেকারির মোড়ের এই বাড়িতেই খোলা হয়েছিল পাকিস্তানিদের টর্চার সেল। যে কারণে বাড়িটিকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করে ইতিহাসের অংশ করে রাখা উচিত। ট্রাইব্যুনালে সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী ম. ছলিম উল্লাহ বলেন, ‘একাত্তরে এই গুডস হিলেই মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেককে ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। এর নেতৃত্ব দিত কাদের চৌধুরী পরিবার এবং তাদের অনুসারীরা। তাদের পুরো পরিবারই একাত্তর সালে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে স¤পৃক্ত ছিল। আমাকে একাত্তরের ২ এপ্রিল রহমতগঞ্জ থেকে ধরে এনে গুডস হিলে উল্টো করে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয়। এর বিভিন্ন কক্ষে আরও অনেককে মারধর করা হয়।’
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ‘সে যে অপরাধ করেছে তার শাস্তি কার্যকর করার পাশাপাশি তার পারিবারিক স¤পত্তি বাজেয়াপ্ত করা উচিত। একজন যুদ্ধাপরাধীর স¤পত্তি বাজেয়াপ্ত করে জনগণের স¤পত্তি করার দাবি জানাচ্ছি।’ টর্চার সেল গুডস হিল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বা একাত্তরে নির্যাতিতদের আশ্রয়স্থল হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
একই দাবি জানান চট্টগ্রামের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা এবং সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী দেওয়া কাজী নুরুল আবছার। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যেখানে একাত্তর সালে গণহত্যা চালানো হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে সেখানে স্মৃতিচিহ্ন বা সৌধ করা হয়েছে। গুডস হিলও ছিল চট্টগ্রামের একটি বড় নির্যাতনকেন্দ্র। এখানে লোকজন ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। একাত্তরে নির্যাতন ও হত্যার স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে এখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর হওয়া উচিত।’
সাকার রাজনীতির একাল-সেকাল
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৩ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার গহিরা গ্রামে। বেড়ে ওঠাও চট্টগ্রামে। পাকিস্তানের পাঞ্জাবের সাদিক পাবলিক স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন সাকা। এরপর আবার উচ্চশিক্ষা গ্রহণে পাকিস্তানে যান তিনি। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএ (অনার্স) ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে আইনে পড়া শুরু করলেও তা শেষ না করেই দেশে ফিরে আসেন ১৯৭৩ সালে তার বাবার মৃত্যুর পর।
রাজনীতি মুসলিম লীগ থেকে শুরু করলেও পরে জাতীয় পার্টি ও এনডিপি হয়ে বিএনপিতে যোগ দেন এই রাজনীতিক। একাত্তরের অপরাধের জন্য বিতর্কিত এই রাজনীতিক ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তবে সেই নির্বাচিত হওয়ার মধ্যেও রয়েছে নির্যাতন আর প্রভাব খাটানোর অভিযোগ। অভিযোগ রয়েছে, সালাউদ্দিন কাদেরের সমর্থকরা ভোটের আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাউকে ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার হুমকি দিয়ে আসত।
১৯৭৯ সালে মুসলিম লীগ থেকে রাউজানের সাংসদ নির্বাচিত হন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়ে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে মূলধারার রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হন। ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে নিজের এলাকা রাউজান থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন সাকা। কিন্তু পরে এরশাদ তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন।
এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে তিনি নির্বাচন করেন নিজের গঠন করা দল এনডিপি থেকে। পুনরায় রাউজানের সংসদ সদস্য হন। কিছুদিন পর এনডিপি বিএনপির সঙ্গে একীভূত হয়ে যায় এবং ১৯৯৬ সালে বিএনপির সাংসদ নির্বাচিত হন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। পরের নির্বাচনে ২০০১ সালে তিনি সাংসদ নির্বাচিত হন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন সাকা চৌধুরী। এরশাদের শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন সাকা চৌধুরী। সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে রাঙ্গুনিয়া ও ফটিকছড়ি থেকে অংশ নেন সাকা। রাঙ্গুনিয়াতে হেরে গেলেও ফটিকছড়ি অর্থাৎ চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে বিএনপির সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি। ফকা চৌধুরীর চার ছেলের মধ্যে সাকা চৌধুরীই সবার বড়। তার সেজো ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সভাপতি। অপর দুই ভাইয়ের মধ্যে প্রয়াত সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামাল উদ্দিন কাদের চৌধুরী রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী, দুই ছেলে ফজলুল কাদের চৌধুরী ও হুম্মাম কাদের চৌধুরী এবং মেয়ে ফারজিন কাদের চৌধুরী। সৌজন্যে: সাপ্তাহিক এই সময়