হবিবুল্লাহ ফাহাদ: এ যেন শাঁখের করাত। কোথায় যাবে যাত্রীরা? ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান হলে যানবাহন সংকটে ভোগান্তি ওঠে চরমে। গাড়ির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় থেকে বাদুরঝোলা হয়ে উঠতে হয় যানবাহনে। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ে বহুগুণ, বাড়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।
আর অভিযান না চালালে ভাঙাচোরা, নষ্ট, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি দাপিয়ে বেড়ায় রাজপথ। যখন-তখন বিকল হওয়ার পাশাপাশি দুর্ঘটনায় ঘটে প্রাণহানি। সব মিলিয়ে পরিবহন খাতে চরম নৈরাজ্য চলছে বাংলাদেশে।
ফিটনেসবিহীন গাড়ির কারণে দুর্ঘটনায় একই সঙ্গে অনেক যাত্রীর প্রাণহানির পর প্রায়ই বিষয়টি সামনে আসে। এরপর এগুলো বন্ধের কথা বলে সরকার। ঢাকঢোল পিটিয়ে নানা সময় চলে অভিযান। কিন্তু কদিন পর আবার আগের জায়গায় ফিরে যায় সব। মাঝে লাভের লাভ হয় পুলিশের, ঘুষের হার বাড়ে তাদের।
দুইয়ে মিলে যেন গাড়ির ফিটনেসের চক্রে পড়েছে যাত্রীরা। ঈদের আগে-পরে বড় ধরনের কয়েকটি দুর্ঘটনার পর হাইকোর্ট ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ ও ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স জব্দের নির্দেশ দেওয়ার পর দেশজুড়ে শুরু হয়েছে অভিযান।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধ করতে হাইকোেের্ট নির্দেশনার দরকার নেই। কারণ, এমনিতেই এসব যানবাহন চলার কথা না। কিন্তু যারা এসব দেখবে সেই সরকারি সংস্থা বিআরটিএ আর পুলিশের দুর্নীতি ও দায়িত্বে অবহেলায় দিন দিন বেড়েই চলেছে অবৈধ যানবাহনের সংখ্যা।
গাড়ির ফিটনেস ঠিক নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নেই চলাচলের অনুমোদন। চালকের লাইসেন্স? সেটাও ভুয়া। দক্ষতার প্রশ্ন তো অসার। ‘চার চাকা ঠিক তো ইঞ্জিন ফিট।’ এবার জ্বালানি নিয়ে ছুটলেই হলো। পুরো ঢাকা শহর চষে বেড়ালেও ফিরেও তাকাবে না কেউ। প্রায় সারা বছর ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী গণপরিবহনগুলোর দশা এ রকম। কারো কোনো সমস্যা নেই। সবই চলে ঠিকঠাক।
প্রশ্ন ওঠে, কেউ কি নেই এসব দেখার? গণপরিবহনের এই নৈরাজ্য কি কারো চোখেই পড়ে না? পড়ে, চোখে পড়ে। তবে মাঝেসাজে। তখনই শুরু হয় সাঁড়াশি অভিযান। মোড়ে মোড়ে পুলিশ, রেকার। পাশেই প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিল পেতে বসে যান ভ্রাম্যমাণ আদালতও। ফিটনেসে একটু হেরফের হলেই আর ছাড় নেই। হয় মামলা আর না হয় সোজা ডাম্পিং।
ফিটনেসহীন গাড়ির সংখ্যা কত?
মোটরযান আইন অনুসারে, যত দিন ফিটনেস থাকবে, তত দিন একটি গাড়ি চলতে পারবে। তবে নির্বাহী আদেশে রাজধানীতে বাসের ২০ এবং ট্রাকের জন্য ২৫ বছরের বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু ২০ বছরের অধিক পুরোনো বাসও ঢাকার রাস্তায় চলছে।
বিআরটিএর হিসাবে, বর্তমানে সারা দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ৩ লাখ ৩৫ হাজার। এর মধ্যে বাস-মিনিবাস ৪১ শতাংশ বা প্রায় ২৫ হাজার। অবশ্য ফিটনেস সনদ হালনাগাদ না করলেও তা ফিটনেসবিহীন গাড়ির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, ফিটনেসবিহীন যানের সংখ্যা পাঁচ হাজারের মধ্যে থাকলে বলতে হবে পরিবহনব্যবস্থা ঠিক আছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক বলেন, ‘ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধে কয়েক দিন ধরপাকড় করলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না। অভিযানের ফলটা যেন দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় সেই উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের এখানে অভিযানগুলোর অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। এতে যাত্রীরা বেশ কষ্টে পড়েন। কিন্তু অভিযান শেষে দেখা যায়, সেই ফিটনেসবিহীন গাড়ি দেদারে ঢাকায় চলছে।’ তিনি বলেন, ‘পরিবহন খাত এক ধরনের মাফিয়াদের হাতে চলে গেছে। এটা সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ হয়। তাই এত সহজে এই খাতের নৈরাজ্য দূর করা যাবে বলে আমার মনে হয় না।’
বুয়েটের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, একটা যানবাহনের ফিটনেস দিতে ৪২টি পরীক্ষা করার নিয়ম। কিন্তু সেগুলো করা হয় না। তিনি মনে করেন, সরকারি সংস্থাগুলো নিজেরা এই কাজ পারছে না। তাই বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত।
যানবাহন সংকটের সুযোগ নিচ্ছেন মালিকরা
হঠাৎ ফিটনেসবিহীন গাড়ি ধরার এসব অভিযান নতুন কিছু নয়। বছরে একাধিকবারও দেখা যায় এমন তৎপরতা। কী ফল হয় এতে? জবাবটা ¯্রফে হতাশার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) যৌথ অভিযান কোনো কাজে আসে না, ব্যাপারটা তা নয়। হঠাৎ করেই রাজধানীর রাস্তা থেকে উধাও হয়ে যায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি। দিনের পর দিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা লক্কড়ঝক্কড় পরিবহনগুলো হাওয়া হয়ে যাওয়ায় বাসমালিকের তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও মূল ভোগান্তি পোহাতে হয় যাত্রীসাধারণের। এমনিতেই ঢাকায় মোট জনসংখ্যার তুলনায় গণপরিবহনের সংখ্যা কম। এসব কারণে ধাক্কাধাক্কি করে বাসে চড়া, সিট তো দূরে থাক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গেটে ঝুলে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা নিত্যদিনকার চিত্র।
তার ওপর অভিযানের ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে হঠাৎ করে ফিটনেসবিহীন গাড়ি কমে যাওয়ায় দারুণ ভোগান্তিতে ফেলে যাত্রীদের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে বাস পাওয়া যায় না। অনেক সময় পর পর একটি বাস এলে হুড়োহুড়ি শুরু হয় তাতে উঠতে। তার ওপর চিরচেনা যানজটের দুর্ভোগ তো থাকেই। ইতিপূর্বে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে এসব অভিযান বিশ্লেষণ করে এসব চিত্রই ফুটে উঠেছে। অভিযানের শেষ অবশ্য দু-চার দিন ঠিকঠাক থাকে। তারপর কদিন যেতে না যেতেই আগের মতো রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে ত্রুটিপূর্ণ গণপরিবহন।
আদালতের নির্দেশ, আবার ভোগান্তি
ঈদের আগে-পরে মহাসড়কগুলোতে একের পর এক দুর্ঘটনা, প্রাণহানির ঘটনার পর দেশের সড়ক বিভাগ নড়েচড়ে বসে। সচেতন সমাজও সোচ্চার হয়। গত ৩ আগস্ট আদালত থেকেও আসে নির্দেশনা। আদালত বলেছে, সারা দেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ি আর চলবে না। এটা বন্ধ করতে বিআরটিএর চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি প্রায় ১৯ লাখ ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স জব্দ করে ওইসব চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে বলেছেন আদালত। আগামী এক মাসের মধ্যে এর অগ্রগতি আদালতকে জানাতে হবে।
এর দুদিনের মাথায় ঢাকায় রাস্তায় নেমে পড়েন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশও (ডিএমপি)। শুরু হয় ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান। ফিটনেসবিহীন বাস চোখে পড়লেই তা থামিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয় যাত্রীদের। আটক করা হয় গাড়ি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলা করার পর রেহাই মিললেও এবার সরাসরি ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে অনেক বাস। ডিএমপির ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মশিউর রহমান এমন তথ্যই জানিয়েছেন।
যত্রতত্র হাত দেখিয়ে বাস থামিয়ে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়ায় গাড়ির চালক বা চালক সহযোগীর ভোগান্তি যেমন-তেমন, দারুণ দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে সাধারণ যাত্রীদেরই। একদিকে সূর্যের প্রখর তাপ অন্যদিকে ব্যস্ত রাস্তা। সব মিলিয়ে যাত্রীদের ভোগান্তি গিয়ে পৌঁছায় চরমে। বিদ্যমান বাস-মিনিবাস মেরামতেও বিনিয়োগ করছে না পরিবহন কো¤পানিগুলো। এতে দিন দিন খুবই খারাপ অবস্থা দিকে যাচ্ছে রাজধানীর বেসরকারি বাস সার্ভিস। যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সকালে, বিকেলে এবং অফিস সময়ে গাড়ির অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ডে। এ সময় গাড়ি পাওয়া খুব কষ্টকর। দু-একটি গাড়ি পাওয়া গেলেও তাতে উঠতে ধাক্কাধাক্কি করতে হয়। এছাড়া সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে গাড়ির অপেক্ষায় শত শত যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকে। একটি গাড়ি এলে হুড়োহুড়ি করে উঠতে গিয়ে আহত হচ্ছেন অনেকেই। তবে বেশি অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে শিশু ও নারীদের।
গত মঙ্গলবার উত্তরা থেকে আজিমপুরের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন তানিয়া সুলতানা। ইডেন কলেজের এই ছাত্রী জানান, ভিআইপি পরিবহনের একটি বাসে চড়ে আসছিলেন তিনি। কিন্তু ফিটনেস নেই এই অভিযোগে বনানীতে বাসটিকে থামিয়ে দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। নামিয়ে দেওয়া হয় সব যাত্রীকে। শুরু হয় দুর্ভোগ। একদিকে অন্য কোনো বাস তিনি পাচ্ছিলেন না তার ওপর ভাড়া ফেরত দিতে হবে এমন আশঙ্কায় চালকের সহযোগী টাকা নিয়ে সন্তর্পণে পালিয়ে যান। ‘ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে ভালো কথা। কিন্তু যাত্রীদের জন্য বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না করে এ ধরনের অভিযান ¯্রফে গণদুর্ভোগ সৃষ্টির নামান্তর।’ বলছিলেন তিনি।
অভিযানের কারণে ভোগান্তির শিকার আরেক যাত্রী সাইফুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় রাজধানীর রামপুরায়। যাত্রাবাড়ী যাওয়ার উদ্দেশে ছালছাবিল পরিবহনের একটি বাসে চড়েছিলেন। কিন্তু পথে পুলিশ গাড়ি আটকে দিয়েছে। অভিযোগ, গাড়িটির ছিল না কোনো নম্বর প্লেট। কোনো সংকেতবাতিও ছিল না পেছনে। জানালাগুলোর বেশির ভাগই খোলা। কাচ ভেঙে পড়েছে তারপর আর মেরামত হয়নি। সাইফুল বলছিলেন, ‘আমাগো কী দোষ? বুঝলাম গাড়িতে সমস্যা। পুলিশ এত দিন দেখল না? নাকি পয়সাপাতি ঠিকঠাক পাইছে দেইখ্যা কিছু কয় না। এখন টেকা দেওন বন্ধ করছে নাকি?’ আরেক যাত্রী তানভীর আলম বলেন, ‘ফিটনেসবিহীন সবই কি বাস? কোনো প্রাইভেট কার তো ধরতে দেখি না। তার মানে ঢাকার রাস্তার সব প্রাইভেট কারই ঠিকঠাক। তাদের কোনো সমস্যা নেই?’
কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, অভিযান নিষ্ফল
অভিযানের কারণেই যে শুধু পরিবহন কমে যাচ্ছে, বিষয়টি মোটেও এ রকম নয়। এই সময়-এর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অভিযান ঠেকাতে নানা ধরনের অপচেষ্টার একটি অংশ হচ্ছে কৃত্রিম পরিবহন সংকট। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে পরিবহন মালিকরা তাদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা চালান। দেখা যায়, ফিটনেস ঠিক আছে এমন বাসও ডিপোতে ফেলে রাখা হয়। যেখানে কোনো একটি পরিবহনের বাস দিনে ২০০ থেকে ২৫০টি চলে সেখানে অভিযানকে জনরোষের মুখোমুখি দাঁড় করাতে অন্য সময়ের চেয়ে অর্ধেকের কম বাস রাস্তায় বের করা হয়। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, অভিযানের কারণে তারা গাড়ি বের করতে পারছেন না। গাড়ি বের করলেই আটক করছে, ডাম্পিং করছে। তাই তারা বাধ্য হয়ে গাড়ি বের করছেন না। এভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর চাপ সৃষ্টি করে অনেক সময় অভিযান মাঝপথে আটকে দেওয়া হয়। শিথিল করা হয় নানা নিয়ম-কানুন। আর ওই সুযোগে ভালো বাসের পাশাপাশি ফিটনেসবিহীন যানগুলো আবারও আগের মতো ঢাকার রাস্তায় চলাচল করে। পরিবহন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন ব্যবসায়ী এই সময়কে বলেন, ‘উপায় নেই। কৌশল না করলে ঢাকায় পরিবহন ব্যবসা করা যাবে না। ঘাটে ঘাটে টাকা দিয়ে ব্যবসা করতে হয়। এখন পুরোনো বাসগুলো তুলে নিতে বলা হয়। এগুলো নিয়ে আমরা করব কী? আর চাইলে কি নতুন বাস কেনা যায়।’
তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ এই সময়কে বলেন, ‘পরিবহন মালিকরা কখনোই কৃত্রিম উপায়ে সংকট সৃষ্টি করেন না। মালিকরা তো পথে চালানোর জন্যই গাড়ি কিনেছেন। এটা ফেলে রাখার জন্য তো নয়।’ তিনি বলেন, ‘অভিযানের নামে হয়রানি যেন না হয়, এটাই আমাদের দাবি। চালক-হেলপারদের যদি ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে এটা তো নতুন ভোগান্তির কারণ।’
বাধ্য হয়ে পিকআপে করে গন্তব্যে
অভিযানের অজুহাতে ঢাকার রাস্তায় গাড়ি কমে যাওয়ায় মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। সকালে বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া, চাকরিজীবীদের অফিসে যাওয়া এবং ব্যবসায়ীদের নিজেদের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিবহন না থাকায় ৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এ অভিযানে বেশ বেকায়দায় পড়েছেন নগরবাসী। অনেকে বাধ্য হয়ে রাজপথ পাড়ি দিচ্ছেন মালামাল টানার খোলা পিকআপ ভ্যানে। অথচ এ ধরনের পরিবহনে চড়া শুধু ঝুঁকিপূর্ণই নয়, আইনত দ-নীয়।
অনুমোদনের পরও নামছে না মিনিবাস
ঢাকায় প্রতিনিয়তই বাড়ছে জনসংখ্যা। সেই সঙ্গে মানুষের চলাচলের প্রয়োজনীয়তাও বাড়ছে। বিআরটিএ তথ্যমতে, জনসংখ্যার দিক থেকে রাজধানীতে সাড়ে ৭ হাজার বাস-মিনিবাসের প্রয়োজন। বর্তমানে রাজধানীতে বাস-মিনিবাস চলছে সাড়ে তিন হাজারের কিছু বেশি। বিআরটিএ বাস নিবন্ধনসংক্রান্ত তথ্যভা-ার থেকে জানা গেছে, সারা দেশে বাস-মিনিবাসের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে ৬১ হাজার ৫৮৯টি। এর মধ্যে ৪০ হাজার ৮২২টি বাস-মিনিবাস ১০ বছরের পুরোনো। ২০ বছরের পুরোনো বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ১৮ হাজার ৫৪টি। রাজধানীতে চলমান বেশির ভাগ বাসেরই ফিটনেস নেই। দরজা-জানালা ভাঙা, বসার সিট ছেঁড়া ও ভাঙা। কোনোটার জানালায় নেই কাচ। পেছনে জানালার ব্যবস্থা থাকলেও স্টিলের শিট দিয়ে সেটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া। এসব কারণে দ্বিগুণ-তিন গুণ ভাড়া গুনলেও যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
বিআরটিএর আরেক হিসাবে দেখা যায়, ১৯৯৫ সালের পর থেকে সারা দেশে বাস-মিনিবাসের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে ৪৩ হাজার ৫৩৫টি। বর্তমানে রাজধানীতে ৯০টির বেশি কো¤পানির প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাস চলাচল করছে। এই সংকট কমিয়ে আনতে মিনিবাসের নিবন্ধন দেওয়া হলেও রাজপথে নামছে না বাস। একাধিক সূত্রে ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন বাস নামাতে যাওয়ার আগে এমনকি অনুমোদন নেওয়ার আগেই নাকি পরিবহন মালিক সমিতির সদস্য হতে। আর জন্য চাঁদা দিতে হয় ৫ থেকে ২৫ লাখ পর্যন্ত। এসব অলিখিত নিয়মের কারণে কেউ ঝামেলা করে রাজপথে বাস নামাতে চায় না। এছাড়া ঢাকা শহরে যেসব লক্কড়-ঝক্কড় বাস চলছে এগুলো পুরোপুরি তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটা চক্র অনীহা রয়েছে। এসব পরিবহন শহরের রাস্তায় চলাচলের জন্য মোটা অঙ্কের ঘুষ গুনতে হয়। যদি এসব পরিবহন তুলে দেওয়া হয় তাহলে আয়ের এই পথ বন্ধ হয়ে যাবে, এমন কথা চিন্তা করে পরিবহন মালিকদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না পুলিশ। বিআরটিএর তথ্য বলছে, সারা দেশে চলাচলরত বাস-মিনিবাসের অন্তত ৩০ শতাংশ ২০ বছরের বেশি পুরোনো, লক্কড়-ঝক্কড়। আর ৬১ শতাংশের বয়স ১০ বছরের ওপরে।
সেই ১০০ এসি বাস কোথায়?
রাজধানীতে গণপরিবহন সংকট নিরসনে এক শ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) মিনিবাস আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল গত বছরের নভেম্বরে। ওই সময় সড়ক পরিবহনমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, তারা ১০০ মিনিবাস আনার অনুমোদন দিয়েছেন, কিন্তু এ বিষয়ে সাড়া পাচ্ছেন না। অনেকে লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা লোকাল বাসে চড়তে আগ্রহী হন না। তাই মানসম্মত লোকাল বাসের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগের মধ্যে সেটি ছিল একটি। কিন্তু অনুমোদনের পর ছয় মাসের বেশি সময় পার হলেও এখনও কেউ আগ্রহ দেখিয়ে বাস আমদানি করছেন না।
গত নভেম্বরে ঘটা করে চালানো অভিযানের বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, সরকার যে অভিযান শুরু করেছে সেটি এবার কয়েক দিনের মধ্যে শেষ হবে না। যানচলাচলে ন্যূনতম মান আর যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত চলবে এই অভিযান। অভিযান চালু থাকলে যানবাহন সংকট যেন না হয় সে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন মন্ত্রী। ঢাকায় শিগগির বিআরটিসির আরও ২৫০টি গাড়ি নামানোর ঘোষণা দিলেও তাও নামানো হয়নি এই সময়ে।
শক্ত অবস্থানে মন্ত্রী
ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, ‘আগে জীবন পরে জীবিকা। জীবন যদি না থাকে তাহলে জীবিকার ব্যাপারটা ভাবব কিভাবে। মানুষের জীবনে নিরাপত্তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। তারপর জীবিকা দেখা যাবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালকের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে, এটি বছরজুড়েই চলবে। পৌনে ৩ হাজার কিলোমিটার সড়কে এই অভিযান চলছে। মন্ত্রী বলেন, আগামী সেপ্টেম্বর থেকে মহাসড়কের পাশে স্থাপিত অবৈধ বিল বোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হবে।
ধরে লাভ নেই, ছেড়ে দিতে হয়
ফিটনেস নেই এমন অভিযোগে গাড়ি ধরে মামলা দেওয়া চালক, চালকের সহযোগীকে আটক করা হলেও কোনো কাজে আসে না। এদের ধরেও রাখা যায় না। ছেড়ে দিতে হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবহন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন বলেন, ‘বাসমালিকদের বেশির ভাগই রাজনৈতিক নেতা অথবা বড় ব্যবসায়ী। এদের হাত অনেক বড়। অনেক জায়গায় সংসদ সদস্যরাই এটা নিয়ন্ত্রণ করেন। সরকারের মন্ত্রীদের কেউ কেউ এর সঙ্গে জড়িত। তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কোনো অবস্থাতেই সহজ নয়।’
সূত্র জানা গেছে, পরিবহন মালিকদের এই সিন্ডিকেটের কাছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও অনেক ক্ষেত্রে জিম্মি। এদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। তাই এসব অভিযান আইওয়াশ ছাড়া কিছুই নয়।
পুলিশের ঘুষ এক সমস্যার নাম
গত ১০ নভেম্বর ঢাকার পাশাপাশি জেলা শহরেও শুরু হয় বিআরটিএর অভিযান। এই অভিযানে বেশ কিছু মামলা ও জরিমানা হলেও যাত্রীদের কতটা লাভ হয়েছে, তা বলা মুশকিল। অভিযান শুরুর পর থেকে ভাঙাচোরা গাড়িগুলো নতুন করে রং করিয়ে নিলেও আসন নোংরা ও ভাঙাই থেকে যায়।
একটি বাসের চালক জানালেন, গাড়ির মালিকের সঙ্গে পুলিশের চুক্তি আছে। প্রতিদিনই তাদের নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে হয়। তাই গাড়ির ফিটনেস দেখে না। অভিযানের কথা বললে বলেন, প্রথম সপ্তাহখানেক চলছিল। তাই মাঝেমধ্যে আটকাইত। কিন্তু এখন সপ্তাহে একবারও আটকায় না।’
টেম্পো হিসেবে পরিচিত হিউম্যান হলারের অবস্থা আরও খারাপ। বনশ্রী রোডে চলা এ ধরনের গাড়িগুলোর বেশির ভাগই রাস্তায় চলতে চলতে থেমে যায়। রামপুরা সেতু থেকে বনশ্রী হয়ে মাদারটেক রোডে চলছে ৭০টির মতো হিউম্যান হলার। সফি আলম নামে একজন সহকারী জানান, অভিযান বলতে আর কী, প্রতিদিন তো এমনিতেই ২৫০ টাকা করে দিতে অয়। অভিযানের নাম দিয়া প্রথম কয়দিন দুই তিনবার ধরত। ধরলেই দিতে হইত ৫০০ টাকা। আর রেকারে নিলে এক হাজারের কমে আনা যাইত না। তয় এখন আর ধরে না। আর ধরলে সপ্তায় একবার কি দুইবার। টেকা দিলে ছাইড়া দেয়।’
একজন চালক জানান, একদিন বাস না চললেই কয়েক হাজার টাকা লোকসান গুনতে হয়। তার চেয়ে পুলিশকে কয়েকটি টাকা বেশি দিলে সমস্যা নেই।’
বুয়েটের সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ শামসুল হক বলেন, আমাদের দেশে ঘটা করে কোনো কিছু করার রেওয়াজ চালু হয়েছে। এতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। আর সুযোগসন্ধানীদের সুযোগ তৈরি হয়। এবারও তাই হয়েছে। অভিযানের বিষয়টি এনফোর্সমেন্ট বা সার্বক্ষণিক নজরদারিতে সারা বছর থাকা উচিত। যদি ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সারা বছর ধরে কাজ না করে তাহলে সেটা কোনো কাজে লাগে না।’
জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক) খান মোহাম্মদ রেজওয়ান বলেন, ‘দুই কোটি নাগরিকের এই শহরে হাজারো সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধান না করে অবৈধ লাইসেন্সধারী এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধ করা সম্ভব না।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনই এসব ঘটনায় মামলা করে। কিন্তু এর পরও কমে না। মামলা হলে ফাইনও দেয়। বন্ধ তো হয় না।’- এই সময়-এর সৌজন্যে।