ঢাকা: বিদেশে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর পলাতক ঘাতকদের ফিরিয়ে আনতে ফের সক্রিয় হচ্ছে টাস্কফোর্স।
এছাড়া বিদেশে অবস্থানরত আসামিদের বিচারার্থে ও দণ্ডদানার্থে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে পর্যালোচনা ও এ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনের নিমিত্তে পুনর্গঠিত টাস্কফোর্সের ৪র্থ সভা আগামি ১৯ আগস্ট এই বৈঠক ডাকা হয়েছে। পুনর্গঠিত টাস্কফোর্সের বৈঠক রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠিত হবে।
গত ১২ আগস্ট স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব শফিকুর রহমান স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত চিঠি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় পাঠানো হয়েছে।
কানাডায় অবস্থানকারী আসামি লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এম এইচ বি নূর চৌধুরী এবং যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে নতুন করে উদ্যোগ গ্রহণ করতে যাচ্ছে সরকার।এরই অংশ হিসাবে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
নানা আইনি জটিলতায় এবং আশ্রয়দাতা দেশগুলোর অসহযোগিতার কারণে বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন সময় এ নিয়ে আলোচনা হলেও এর অগ্রগতি সামান্যই।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এবং বর্তমান আইনমন্ত্রী এডভোটেক আনিসুল হক অবশ্য এ ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
২০০৯ সালে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদকে প্রধান করে আন্ত:মন্ত্রণালয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হলেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক ৬ খুনির মধ্যে ৪ জনের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেনি আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স।
৬ বছরে ২ জনের অবস্থান নিশ্চিত হলেও আইনি জটিলতায় তাদেরকে ফেরত আনা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে পলাতক ৬ খুনিকে বর্তমান সরকারের আমলে দেশে ফিরিয়ে আনা নিয়ে কাটছে না সংশয়।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল ( অব.) খন্দকার আব্দুর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ( অব.) শরিফুল হক ডালিম, ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের কোনও সন্ধান জানা যায়নি। এদের অবস্থান জানতে বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাস এবং ইন্টারপোলের মাধ্যমে প্রচেষ্টা চলে আসছে। নিজেদের আড়াল করতে হয়তো খুনিরা বারবার অবস্থান পরিবর্তনের ফলেই সঠিক তথ্য পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
কানাডায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান না থাকায় নূর চৌধুরীকে হস্তান্তরে দেশটি আগ্রহী নয়। এ বিষয়ে আইনি লড়াই চলছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দিবিনিময় চুক্তি না থাকায় রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনতে সমস্যা হচ্ছে।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিাফার ডটকমকে বলেন, আগামী ১৯ তারিখে আন্ত:মন্ত্রণালয়ে টাস্কফোর্স সভা রয়েছে। তাদের ফিরে আনা নিয়ে আলোচনা হবে। কী কী পদক্ষেপ নেয়া হবে তা আগে বলা যাবে না। বাকিদের ফিরিয়ে আনতে টাস্কফোর্সকে আরো শক্তিশালী করা হবে।
ইতোমধ্যে কানাডায় পলাতক আসামি নূর চৌধুরীর পাসপোর্ট জব্দ করেছে ওই দেশের সরকার। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে আইনি লড়াই শেষ পর্যায়ে রয়েছে। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে আইনজীবী নিয়োগ করে তাদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয় সরকার। এই উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় এই দুজনকে দেশে আনার বিষয়টি এ সভায় স্পষ্ট হবে বলে জানা গেছে।
অপরদিকে বিভিন্ন দেশে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর সাজাপ্রাপ্ত খুনিদের দেশে ফেরত আনার উদ্যোগের ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী বলেন, আমরা অন্যের আইনকে শ্রদ্ধা করি। আমাদের আইনকেও অন্যদের শ্রদ্ধা করা উচিত। বঙ্গবন্ধু খুনীদের দেশে ফেরাতে সরকার সেই পরিকল্পনায় এগিয়ে যাচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, খুনি আজিজ পাশা জিম্বাবুয়েতে মারা গেছেন ২০০২ সালে। খন্দকার আবদুর রশিদ লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির আশ্রয়ে ছিলেন। লিবিয়ার বেনগাজিতে গাদ্দাফি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ব্যবসাও ছিল তার। কিন্তু গত বছর লিবিয়ায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর খুনি রশিদ এখন কোথায় আছেন তা স্পষ্ট নয়। শরিফুল হক ডালিম বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থান করছেন। বাকিরা বারবার নিজেদের অবস্থান পাল্টাচ্ছেন।
ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন ২০০১ সাল পর্যন্ত ভারতে পালিয়ে ছিলেন বলে সরকার মনে করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের সঙ্গে আলোচনায় এ বিষয়টি উঠেছে। ভারত ওই খুনিদের অবস্থান সম্পর্কে বাংলাদেশের কাছে আরও তথ্য চেয়েছে। কিন্তু এরপরও সেখানে তাদের অবস্থান বা সমর্পণ বিষয়ে ইতিবাচক কোনও খবর জানা নেই।
খুনি ডালিম ২০০৯ সালের শেষ দিকে কানাডায় গিয়েছিলেন বলে দেশটির সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। জানা গেছে, কানাডা থেকে কয়েক দিন পরই তিনি হংকং হয়ে আবার পাকিস্তানে ফিরে গেছেন। তিনি ব্রিটিশ পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তিন প্রধান আসামি বরখাস্ত লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী (পিএ) এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ধানমণ্ডি থানায় হত্যা মামলা করেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাঁচাতে হওয়া ইনডেমনিটি আইন বাতিল হয় ১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর।
পরের বছর ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে এবং একই বছরের ১২ মার্চ ছয় আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়। তবে বিচারক বিব্রতসহ নানা কারণে ১৯৯৭ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিচার কার্যক্রম আবার স্থগিত হয়। অবশেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারপতি কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। অন্যদিকে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় দেয়।
বিচারপতি এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বজায় রাখেন এবং অপর বিচারক এ বি এম খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।
২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বিভক্ত রায়ের ফলে একই বছরের ৩০ এপ্রিল তৃতীয় বিচারক মোহাম্মদ ফজলুল করিম ২৫ দিন শুনানির পর অভিযুক্ত ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিশ্চিত করেন।
পরবর্তীতে ২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসলে বিচার কাজ বন্ধ থাকে। ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে ৫ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতিদানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন।
২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর ২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। ওইদিনেই বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করা হয়।
২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়।
(ঢাকাটাইমস/১৩আগস্ট/এইচআর/এমএম/এআর/ঘ.)