logo ২৪ এপ্রিল ২০২৫
জলাবদ্ধতা: দোষারোপ না সমন্বয়?

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ ও মহিউদ্দিন মাহী
০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ১২:৩৬:১২
image


হাতিরঝিলের সড়কের একটি অংশে পানি জমে আছে। বৃষ্টিও থামছে না। সময় গড়ায়, বাড়ে পানিও। পাশের এক বাসিন্দা সড়কে পানি নিষ্কাশনের ছোট্ট নালার মুখে জমে থাকা কয়েকটি পলিথিন হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেন, মুহূর্তেই কমতে শুরু করল সড়কে জমে থাকা পানি। এটা গত মঙ্গলবারের চিত্র। বৃষ্টির পানিতে নগরীর প্রধান প্রধান সড়কের একটি বড় অংশ তলিয়ে যায়। অলি-গলির অবস্থা আরও খারাপ। এর মধ্যে ভাঙা সড়ক ভোগান্তি বাড়ায় আরও বেশি। আর জমে থাকা পানির জন্য সড়কে বাধে দীর্ঘ যানজট। পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটে যে, পরদিন ঢাকার বেশ কিছু স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

পরদিন সকাল থেকেও আগের দিনের মতোই ভারী বৃষ্টি হয়েছে, তবে মঙ্গলবারের মতো অতটা পানি জমেনি সড়কে। একদিনের মধ্যে কী এমন জাদুমন্ত্র বদলে দিল এই নগরীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে? সহজ জবাব, পানি সরে যাওয়ার পথে জমে থাকা ময়লা আবর্জনা, বিশেষ করে অপচনশীল দ্রব্যগুলোর একাংশ হয় পরিষ্কার করা হয়েছে, অথবা ভেসে গেছে পানির তোড়ে। এ কারণে পরদিন পানি আটকে থাকেনি আগের দিনের মতো।

বৃষ্টি এলে জলাবদ্ধতার এই ভোগান্তি নতুন নয় ঢাকা শহরে। কিন্তু সারা বছর কি মনে থাকে এর কথা? থাকে না বলেই নালাগুলো পরিষ্কার করা হয় না নিয়মিত, খালগুলো ভরাট হয়ে থাকে সারা বছর, আর যে নাগরিকরা দুর্ভোগে পড়ে তারাও অসচেতনতার চূড়ান্ত রূপ দেখিয়ে যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলে যাচ্ছে। এতে নালা বা খালগুলো পানি সরে যাওয়ার মতো অবস্থায় থাকছে না আর। পরিস্থিতি এমন যে, আবর্জনা পরিচ্ছন্ন করলে কিছুদিনের মধ্যেই আবার ভরাট হয়ে যায় খালগুলো।  

এর পাশাপাশি অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ, জলাশয় ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ, নগরের সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকায় পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। দুদিনের জলাবদ্ধতার পর সেবা সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা যা বলছেন, তাতে উদ্বেগ বেড়েছে আরও। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাটি দেখার প্রকৃতপক্ষে কোনো কর্তৃপক্ষ নেই ঢাকায়। ওয়াসা যে খালগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করে, সেগুলোর মালিকানা জেলা প্রশাসনের। পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার পাইপলাইন আছে নগরীতে। এর মধ্যে ৩২৫ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন করে ঢাকা ওয়াসা। আর পানি উন্নয়ন বোর্ড পা¤েপর সাহায্যে বৃষ্টির পানি বেড়িবাঁধের বাইরে নদীতে ফেলে।

বর্ষার বৃষ্টি এখন এক ভয়ের নাম

গত মঙ্গলবার ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই জলের ভোগান্তি হয়েছে ঢাকায়। মধ্য ঢাকায় বর্ষার শেষ সময়ে এসে এত বৃষ্টি এর আগে কখনো হয়নি। এ কারণে গ্রাভিটি ফ্লতে (স্বাভাবিক সময়ে পানির যে প্রবাহ থাকে) পানি নামতে পারেনি। ফলে জলজটের সৃষ্টি হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াসার এক পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ‘সারফেস ড্রেনেজ সিস্টেমে ময়লা আবর্জনা জমে থাকায় পানি স্বাভাবিক গতিতে নামতে পারেনি। এ অবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। ফলে একটু বেশি বৃষ্টিপাত হলেই পানি জমে যায়। এখানে তো ওয়াসার কোনো হাত নেই।’ তাহলে ওয়াসার কাজ কী? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ডিপ ড্রেন বা সুয়ারেজ সিস্টেমে কোনো সমস্যা হলে সেটা ওয়াসা দেখবে। কিন্তু ঢাকায় এখন যে কারণে পানি জমে সেটা হচ্ছে রাস্তার পাশে সারফেস ড্রেনে ময়লা জমে থাকে, যেটা কি না প্রতিদিনই পরিষ্কার করার কথা।’

এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বর্ষার মৌসুমে নদীর পানির অনেক উঁচুতে ওঠে। এ কারণে ঢাকার আশপাশে যে নদী রয়েছে সেখানে সরাসরি পানি নামতে পারছে না। পা¤িপং করে পানি সরাতে হচ্ছে। এ কারণে পানি দ্রুত সরানো যাচ্ছে না। পানি জমে যাওয়ার এটি অন্যতম প্রধান কারণ।’ ওয়াসার তত্ত্বাবধানে চারটি পা¤িপং স্টেশন রয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে তিনটি পা¤িপং স্টেশনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বর্ষা শেষে নদীর পানি কমে গেলে রাজধানীর পানি নিষ্কাশনও সহজ হবে। ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল আলম চৌধুরী বলেন, বিদ্যমান ড্রেনেজ ব্যবস্থায় ঘণ্টায় ১৫-২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলে পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব। হঠাৎ করে এর চেয়ে বেশি হলেই জলজট তৈরি হয়।

একক কর্তৃপক্ষ নেই

অবাক করা হলেও সত্য যে, ঢাকার সার্বিক বিষয়গুলোর দেখভাল করার জন্য একক কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। স্থানীয় সরকার এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত মোট ৫৪টি সংস্থা ঢাকাকে রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করে। অর্ধশত এসব সংগঠন যে একেবারে কাজ করছে না তা বলা যাবে না। তবে এদের মধ্যে যে সমন্বয়হীনতার বড় ধরনের অভাব আছে তা বলা যায় চোখ বুজেই। ড্রেনেজ সিস্টেমে ময়লা জমে থাকায় পানি নামতে পারছে না। ময়লা পরিষ্কারে আপনারা কি করছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ওয়াসার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের দায়িত্বে স্যুয়ারেজ সিস্টেম রয়েছে। সেটা আমরা বর্ষা মৌসুমের শুরুতে একবার পরিষ্কার করি। কিন্তু সারফেস ড্রেনেজ সিস্টেম তো দেখব ডিসিসি।’

এ বিষয়ে ডিসিসি দক্ষিণের প্রধান বর্জ্য কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনই সারফেস ড্রেনেজ সিস্টেম পরিষ্কার করি। কিন্তু স্যুয়ারেজ সিস্টেমে সমস্যা থাকায় পানি ভালোভাবে সরতে পারে না। যেটার দায়িত্বে আছে ওয়াসা।’ ঢাকায় দখল হওয়া এবং দখল হওয়ার বাইরে থাকা খালগুলোর প্রকৃত মালিক জেলা প্রশাসন। অথচ এসব খাল পয়ঃপরিষ্কারের দায়িত্ব আবার ওয়াসার ওপর। যে কারণে দখল হওয়া খালগুলো উদ্ধারে ওয়াসার একক কর্তৃত্ব কাজে আসে না। আবার জেলা প্রশাসকও ওয়াসার সঙ্গে সমন্বয় করে তাদের কর্মসূচি ঠিক করতে পারে না। এ জন্য দিনের পর দিন দখল হওয়া খালগুলো উদ্ধারে হাঁকডাক ছাড়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াসার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ওয়াসা বিভিন্ন সময় জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে খাল উদ্ধার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। মাঠ পর্যায়ে অভিযানও পরিচালনা করা হয়েছে। এতে সাময়িকভাবে খালগুলোর অস্থায়ী স্থাপনাগুলো তাৎক্ষণিক উচ্ছেদ করা গেলেও দীর্ঘমেয়াদে কোনো সুফল মেলেনি। কারণ উদ্ধার হওয়া খালগুলো যারা দখল করে আছেন তাদের সবারই কমবেশি ক্ষমতার জোর আছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবটাই বড়।

জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘শহরে সুশাসনের অভাবে এসব সমস্যা তৈরি হয়েছে। পরিকল্পনা তৈরিতে সংকট, বাস্তবায়নে দক্ষতার অভাব, দুর্নীতির কারণে উন্নয়ন বাস্তবায়ন সঠিকভাবে না হওয়ায় আজকের ভোগান্তি।’ তিনি বলেন, ‘ভোগান্তি থেকে উত্তরণের জন্য জনসচেতনতা ও নগর নেতৃত্ব জরুরি। জনগণকে নগর উন্নয়নে স¤পৃক্ত ও উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। তাদের মধ্যে এই ভাবনা দিতে হবে যে, শহরটা আমার।’ তিনি বলেন, ‘নেতৃত্বের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখন নতুন দুই মেয়র এসেছেন। আশা করি তারা সমন্বয়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সরকার, সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং জনগণ ও নাগরিক সমাজকে স¤পৃক্ত করে সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হবেন। নেতৃত্ব বলতে বোঝাতে চাচ্ছি মেয়র, ওয়াসা, রাজউক, মন্ত্রী এমনকি সরকারপ্রধান সবার। সবাইকে যার যার ভূমিকায় সক্রিয় হতে হবে।’

আবর্জনা ব্যবস্থাপনায় বড় সংকট

ঢাকা সিটিতে প্রতিদিন পাঁচ হাজার মেট্রিক টন ময়লা জমে। সিটি করপোরেশনের পাঁচ হাজার কর্মী এর অর্ধেক সরাতে পারে। এদের মধ্যে আবার অনেকে আছে মাস্টার রোলে কাজ করেন। অভিযোগ আছে- মাস্টার রোলে যারা কাজ করেন তাদের মধ্যে ফাঁকির প্রবণতা রয়েছে। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ আছে তাদের মধ্যে। ডিসিসির কর্মকর্তারাই বলছেন, পরিচ্ছন্নতা কর্মী যারা আছেন, তারা যদি প্রতিদিনই দায়িত্ব নিয়ে যার যার এলাকায় পরিচ্ছন্নতা কাজে অংশ নেয় তাহলে ঢাকায় ময়লার জট থাকত না।

তবে এ অভিযোগ মানতে নারাজ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা কাজ না করত তাহলে তো ঢাকাবাসী থাকতেই পারত না।’ তিনি বলেন, আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা অনেক জিনিস চাইলেই করতে পারি না। আমাদের যথেষ্ট কর্মী নেই। যথেষ্ট অবকাঠামোগত সুবিধা নেই। তবে এসব সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঢাকার বেশিরভাগ রাস্তার সারফেস ড্রেন সিস্টেমের মুখে ময়লা আবর্জনা জমে থাকে। এ কারণে পানি বের হতে পারে না। এ বিষয়ে রকিব উদ্দিন বলেন, ‘পরিচ্ছন্ন কর্মীরা সকালে পরিষ্কার করে চলে যায়। আবার পরদিন সকালে আসে। কিন্তু এর মাঝখানে কেউ খাবার খেয়ে পলিথিন রাস্তায় ফেলে রাখল।’ এ রকম হাজারো জিনিস আমরা রাস্তায় ফেলে দেই এগুলোই কিন্তু বৃষ্টি হলে পানিতে ড্রেনের মুখে গিয়ে জমা হয়। ফলে পানি সরতে পারে না। এজন্য আমাদের নগরবাসীর সচেতন হওয়া খুব জরুরি।’

উন্নত বিশ্বের উদাহরণ দিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশেই যত্রতত্র ময়লা ফেলে না নাগরিকরা। আমাদের দেশে এই সংস্কৃতি চালু করতে হলে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।’  

নিচু এলাকা ভরাটে বিপদ

ঢাকাতে অনেক জলাশয় ছিল। নিচু জায়গা ছিল। খাল ছিল। সেগুলো এখন আর নেই। সব ভরাট হয়ে গেছে। বাড়ি উঠছে। রাস্তা হচ্ছে। পানি সরানোর জায়গায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ড্রেন লাইন ব্লক হয়ে আছে। এ সব কারণে সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। এগুলো আগে ঠিক করতে হবে। তা না হলে সমস্যা বাড়বে ছাড়া কমবে না।’ ঢাকাবাসীর এই দুর্ভোগের কারণ স¤পর্কে জানতে চাইলে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ‘আজকের জলাবদ্ধতার মূল কারণ জলাভূমি ভরাট করা। এই শহরে প্রতিদিনই জলাশয় ভরাট করে নতুন নতুন স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। ফলে বৃষ্টিতে যে পানি জমা হচ্ছে তা সরাসরি নদীতে মিশতে পারছে না।’

ঢাকায় জলজটের কারণ স¤পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্লানিং বিভাগের অধ্যাপক সরোয়ার জাহান বলেন, ‘কোনো জায়গায় পানি জমলে সেই পানি কোথাও না কোথাও যেতে হবে। জমে থাকা পানি তো সরতে পারছে না। পানির পরিমাণ বেশি হওয়ায় মাটিও পানি শুষে নিতে পারছে না। এর কারণ হলো এই কংক্রিটের শহরে আমাদের ড্রেনেজ সিস্টেম উন্নত নয়।’

তিনি বলেন, ‘দুটি ড্রেনেজ সিস্টাম আছে। একটি হচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেনেজ সিস্টেম। অন্যটি ওভারগ্রাউন্ড বা সারফেস ড্রেনেজ সিস্টেম। এগুলো ঠিক মতো কাজ করছে না। নিচু জমি ভরাট হয়ে গেছে। ওভার সিস্টেমে ময়লা-পলিথিন জমে গেছে। সিটি করপোরেশন পরিষ্কার করছে না। ফলে পানির প্রবাহ কম। এজন্য পুরো ড্রেনেজ সিস্টেমকে উন্নত করতে হবে। এতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। খাল বা লেকের সঙ্গে শহরের কানেকটিভিটি বাড়াতে হবে। লো ল্যান্ড ভরাট করা যাবে না। আমাদের পা¤িপং ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে।’ তার মতে জলাবদ্ধতার আরেক বড় কারণ হচ্ছে ‘বক্স কালভার্ট’।

ধোলাইখাল কালভার্টের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, খালটির নিচে যেখানে ১২-১৪ ফুট জায়গা ছিল সেখানে এখন ময়লা-আবর্জনা জমে ৩-৪ ফুট জায়গা অবশিষ্ট আছে। এ ধরনের খাল নির্মাণ স¤পূর্ণ অযৌক্তিক। বুয়েটের সিভিল বিভাগের অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সমস্যা আসলে গোড়ায়। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে আজকের এই সমস্যা। এই সমস্যা সামনে আরও ঘোরতর হবে। এই মেগাসিটির পানি সরানোর জন্য উন্নত কোনো ব্যবস্থা নেই। খুব বেশি বৃষ্টি হয়েছে সেটা বলা যাবে না। কিন্তু এই বৃষ্টিতেই ঢাকার এই অবস্থা। কিন্তু এর চেয়ে যদি বেশি বৃষ্টিপাত হয় তাহলে কি হবে সেটা সহজেই অনুমেয়।’

সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্টদের এখনই উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ঢাকার জলাশয়গুলো উদ্ধার করতে হবে। খালগুলো উদ্ধার করতে হবে। নিচু জায়গায় বাড়ি করা যাবে না। ড্রেনেজ সিস্টেম আরও উন্নত করতে হবে। এছাড়া সারফেস ড্রেনেজ এবং আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেনেজ সিস্টেম একই কর্তৃপক্ষের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।’

নাগরিকদের কুঅভ্যাস

শুধু যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাই ঢাকার জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী, ব্যাপারটি মোটেও তা নয়। দায় আছে নাগরিকদেরও। কারণ, নাগরিকদের অসচেতনতার কারণে অনেক সময় চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। এ কথা ঠিক যে, ঢাকায় যে জনসংখ্যার বসবাস সেই ধরনের প্রস্তুতি নেই। এখানে মানুষ-সৃষ্ট বর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা অপ্রতুল। পর্যাপ্ত ময়লা ফেলার জায়গা নেই। আবার নির্দিষ্ট জায়গায় ময়লা ফেলা ঝামেলার এই অজুহাতে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে শহরের নালা ও খালগুলো ভরাট হয়ে যায়। এগুলো পরিষ্কার করা হয় না বলে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। ঢাকার মগবাজার রেললাইন পার হলেই চোখে পড়বে রাস্তার বড় একটি অংশ দখল করে ফেলে রাখা হয়েছে আবর্জনার কনটেইনার। নিয়ম হচ্ছে, ওই কনটেইনারের মধ্যে ফেলতে হবে ময়লা। অথচ বাস্তব চিত্র হচ্ছে, কনটেইনারে যে ময়লা রয়েছে, তার চেয়ে বেশি ময়লা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে রাস্তায়।

পাশেই হাতিরঝিল। অনেক সময় বৃষ্টির পানিতে ময়লাগুলো ধুয়ে নামে ঝিলে। এতে যে শুধু পানি দূষণ হচ্ছে তাই নয়, পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। জমে থাকা ময়লা পচে পানিকে দুর্গন্ধময় করে তুলছে। এছাড়া পলিথিন জাতীয় অপচনশীল দ্রব্য পানিতে ফেলায় পানির গতিপথও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাতিরঝিল বা বেগুনবাড়ি জলাধারে নগরীর পয়ঃবর্জ্য বা মানুষের ত্যাগ করা বর্জ্যরে পানি এসে পড়ার কথা ছিল। যাতে শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থাটা সচল থাকে। অথচ এখন এই ঝিলগুলোতে কোনো পানি এসে পড়া তো দূরে থাক ঝিলের পানিই গতি হারিয়েছে। সচল ঝিল এখন বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে।

নগরবিদরা মনে করেন, ঢাকার জলাবদ্ধতা বা হঠাৎ পানিবন্দি দশা থেকে রেহাই পেতে শুধু বর্ষা মৌসুমে কিংবা পানি আটকে যাওয়ার পর নয়, সারা বছরই নাগরিকদের সচেতন থাকতে হবে। যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলা যাবে না। পাশাপাশি ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষের যথাযথ স্থানে ময়লা ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষকে সচেতন করতে হবে। প্রয়োজনে জরিমানাসহ শাস্তির বিধানও করা যেতে পারে।

কী করা যেতে পারে?

সরকারি-বেসরকারি তথ্য বলছে, ঢাকা মহানগরীর মধ্য দিয়ে একসময় প্রবহমান ছিল ৫৪টি খাল। এখন তার ১২টি কোনোমতে টিকে আছে। অন্যগুলো দখলদারদের কবলে পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। নগরীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ঠিক রাখতে এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ঢাকার খালগুলোকে উদ্ধার করতে হবে। বিশেষ করে জলাশয়ে পচনশীল দ্রব্য যে এসে পড়তে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়িয়ে শৃঙ্খলা ফেরানোর বিকল্প নেই।

নগরীর সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি এ বিষয়ে বলেন, ‘ঢাকা শহরটি সমতল ও বৃষ্টিবহুল এলাকায়, তাই এখানে নগরায়নের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জলাশয় ও সবুজ রাখতে হবে। ১৯৯৭ সালে ঢাকার জন্য যে নগর-পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়, সেটিতে জলাশয় সংরক্ষণে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল। ১০টির মতো পানি সংরক্ষণের জলাধার (ওয়াটার রিটেনশন পন্ড) রাখার কথা ছিল। কিন্তু নতুন যেসব আবাসিক প্রকল্প হয়েছে, সেগুলোতে এ ধরনের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই।’ তিনি বলেন, ‘শহরকে বাসযোগ্য রাখতে গেলে পর্যাপ্ত জলাশয় রাখতে হবে। পুরনো খাল সংস্কার করতে হবে, দখল হওয়া খাল পুনরুদ্ধার করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, খাল ও নদীতে বর্জ্য ফেলার কারণে এগুলো যেন বন্ধ হয়ে না যায়।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নগর সুশাসন স¤পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব মনে করেন ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানের জন্য এখন একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজনৈতিক ডাক দিতে হবে। গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যাতে এ ধরনের কার্যক্রমে জনস¤পৃক্ততাকে বাধ্যতামূলক করা যায়। তিনি বলেন, ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে সবাই নেমে পড়বে। সব ড্রেনেজ সিস্টেম পরিষ্কার করতে হবে। যাতে নদী পর্যন্ত পুরো লাইন পরিষ্কার থাকে।’

এই স্থপতি বলেন, ‘সব খাল-বিল, ড্রেন, বক্স কালভার্ট, জলাধার পরিষ্কার করে ঢাকার রাস্তাগুলোর সঙ্গে সংযোগ লাইনগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে। যাতে পানি সরল রেখায় প্রবাহিত হতে পারে। নদী পর্যন্ত এগুলো সচল রাখার সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।’

ঢাকা ওয়াসার সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, খাল ও জলাশয় ভরাট হয়েছে এমন এলাকায় জলাবদ্ধতার পরিমাণ বেশি। রাজধানীর পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনের কাজে যুক্ত এই সরকারি সংস্থাটির হিসাবে মোট সাতটি এলাকায় বেশি জলাবদ্ধতা হচ্ছে। ঢাকা শহরে ২৫টি খাল চিহ্নিত করে তা পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। এর মধ্যে ১২টি খালের দুই পাড় পাকা করে দেওয়া হচ্ছে। ওয়াসার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, জলাবদ্ধপ্রবণ এলাকাগুলো হচ্ছে মিরপুর (১০ নম্বর গোল চক্কর থেকে শুরু করে ১১, ১৩ ও ১৪ নম্বর), বাড্ডা, ধানমন্ডির রাপা প্লাজার চারপাশের এলাকা, ফার্মগেট, পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোড, মালিবাগ, মৌচাক, বেইলি রোড, মগবাজার, খিলগাঁও, শান্তিনগর, মতিঝিল, ফকিরাপুল, নয়াপল্টন, রাজারবাগ, গুলশান ও আরামবাগ এলাকা। এ এলাকাগুলোর বৃষ্টির পানি একসময় সেগুনবাগিচা খাল, জিরানি খাল, বাসাবো খাল ও বেগুনবাড়ি খালের মোট ৪৩ কিলোমিটার এলাকা দিয়ে নিষ্কাশন হতো।

জলাবদ্ধতা দেশে দেশে

শুধু বাংলাদেশই নয়, পৃথিবীর নামকরা অনেক শহর বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যায় মাঝেমধ্যেই। একটা ভারী বৃষ্টিপাতে এই সমস্যা দেখা দেয়। গণমাধ্যমে এসব চিত্র অহরহই দেখা যায়। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, টরেন্টোতে এই সমস্যা প্রকট। এছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে জলাবদ্ধতা ও বন্যার প্রকোপ তো আছেই।

তবে বাংলাদেশের মতো এত অব্যবস্থাপনা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কম আছে বলেই মত নগরবিদদের। তারা বলছেন, যে দেশের জনগণ যত সচেতন, সে দেশ তত উন্নত। কারণ, জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতার অভাব থাকলেই সেখানে অনিয়ম বাসা বাঁধে। তাছাড়া ঢাকার কথা বলতে গেলে, দীর্ঘদিন ঢাকায় নির্বাচিত কোনো প্রতিনিধি ছিল না। যারা ছিলেন তাদের মধ্যে ঢাকার উন্নয়নে কাজের আগ্রহও ওই অর্থে ছিল না বললেই চলে। এখন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আছেন। দুজন মেয়রই ঢাকার চেহারা পাল্টে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়র হয়েছেন। এখন শুধু এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অপেক্ষা।

এ বছর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বঙ্গোপসাগর থেকে সৃষ্ট জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে তা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এই বৃষ্টিপাত বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। টানা বৃষ্টিপাতের ফলে মানুষের ভোগান্তিও বেড়ে চলেছে। গত জুলাই থেকেই এবার অঝর ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। একটানা বৃষ্টি হলেই রাজধানীসহ বড় বড় শহরগুলোর রাস্তাঘাট তলিয়ে গিয়ে নাগরিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।

আবহাওয়াবিদ আরিফ হোসেন জানান, ২০১৪ সালের জুলাইয়ে সারা দেশে মোট বৃষ্টিপাত ছিল ১১ হাজার ৮১০ মিলিমিটার। আর চলতি বছরের জুলাইয়ে রেকর্ডকৃত মোট বৃষ্টির পরিমাণ ২৯ হাজার ২৮১ মিলিমিটার, যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণের চেয়ে বেশি। আগস্টে গত বছর বৃষ্টি হয়েছিল ১৪ হাজার ৭৪৫ মিলিমিটার। চলতি বছর হয়েছে ১৫ হাজার ২৩১ মিলিমিটার।

অতিবর্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আমানত উল্লাহ খান বলেন, ‘বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে তা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যাওয়ায় বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। আবার কখনো থেমেও যাচ্ছে। এটা মিয়ানমারের ওপর দিয়েও যাচ্ছে।’

জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বেশি বৃষ্টি হচ্ছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি ওই দিকে যাব না। তবে অতিবৃষ্টির কারণে রাজধানীজুড়ে যে দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে এর জন্য আমরাই দায়ী।’ আবহাওয়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য অধিদপ্তরের মনিটরিং ডিভাইস বাড়ানোর পরামর্শ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।