logo ২৪ এপ্রিল ২০২৫
“অন্তত আমার স্বামীর হাড্ডিটা হলেও দেখান”
৩০ আগস্ট, ২০১৫ ২১:৫৬:৩১
image

বোরহান উদ্দিন, ঢাকাটাইমস


ঢাকা: “আমার মা-বাবা কি ভাইকে না দেখেই মরে যাবে? আমরা কি ভাইকে আর দেখতে পাবো না? ভাইয়ের খোঁজে দ্বারে দ্বারে ঘুরছি কিন্তু কেউ সন্ধান দিতে পারেনি। আমরা তো এখন এক একজন পাথর হয়ে গেছি। আর কষ্ট সহ্য হচ্ছে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের ভাইকে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করুন।”


বিশ্ব গুম দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এমন কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন রাজধানী থেকে নিখোঁজ হওয়া সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুর বোন রেহেনা বানু মুন্না।


দিবসটি উপলক্ষে রবিবার বিকালে  বিভিন্ন সময় গুম হওয়া দলের নেতাকর্মীদের স্বজনদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে নিজের গুলশান কার্যালয়ে মতবিনিময়ের আয়োজন করেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ওই অনুষ্ঠানে  যোগ দিয়ে এসব কথা বলেন মুন্না।


গুম হওয়া ছাত্রদল নেতার বোন যখন ভাইয়ের সন্ধান চেয়ে এসব বলছিলেন তখন উপস্থিত সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন।


শুধু পিন্টুর বোনই নয়, এমন করেই বিলাপ করেন বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের গুম হওয়া প্রায় দশটি পরিবারের স্বজনরা। সবাই দাবি করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তাদের স্বজনদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে আর তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি।


নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা সবাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

“অনন্ত অপেক্ষা... বাংলাদেশে ২০০৯-২০১৫” গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনের প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সহমর্মিতা” শীর্ষক এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ‘গুমের শিকার ২৬ পরিবার ও তাদের অর্ধশতাধিক স্বজন।


গুমের শিকার স্বজনদের মধ্যে প্রথমেই বিএনপির নিখোঁজ সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহমিনা রুশদির লুনা কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, “আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর প্রত্যক্ষদর্শীদেরকে ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। জিডি করলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলাম কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।

তিনি বলেন, “প্রতিদিন মনে হয়, যদি এমন খবর আসতো আমার স্বামী ফিরে এসেছে।সন্তান ও শ্বাশুরিকে কোন উত্তর দিতে পারি না।”


সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে স্বামীকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি করেন তিনি।

বিমান বন্দর থানা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন মুন্নার বাবা মো. শামসুদ্দিন বলেন, “আমার সামনে থেকে মুন্না ও আরেকটি ছেলে তরিকুল ইসলাম জন্টুকে ধরে নিয়ে গেছে। তখন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনারা কারা? পুলিশ বলেছিল আপনার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। ছেলেকে না পেয়ে যখন মামলা করতে গিয়েছিলাম তখন বলা হলো সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় না।”

তিনি বলেন,“ ছেলের ছবি বুকে নিয়ে আছি। কিন্তু, ছেলেকে আর বুকে নিতে পারি না।” এই কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন মুন্নার বাবা।

তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া যুবদলের সভাপতি সাজিদুল ইসলাম সুমনের বড় বোন মারুফা ইসলাম বলেন, “সুমন ও তার ৬ বন্ধুকে র‌্যাব মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে প্রায় দুই বছর ধরে আমার ভাইয়ের কোনো খবর পাচ্ছি না। প্রশাসনের প্রতিটি দরজায় গিয়েছি।কিন্তু কেউ বলেনি কোথায় আছে আমার ভাই।”

তিনি বলেন, “জানিনা কীভাবে এর সমাধান হবে।”


ভাই হারানোর এই বেদনা থেকে তাদেরকে বাঁচানোর আহ্বান জানান তিনি।

তিনি আরো বলেন, “ভাইকে ফিরে পেতে আমরা এখনো হাল ছেড়ে দেইনি। হাল ছাড়বো না। প্রয়োজনে বিশ্ব দরবারে যাবো।”

মাজেদুল ইসলাম রাসেলের বোন লাবনি আক্তার বলেন, “প্রতিদিন মনে করি ভাই ফিরে আসবে এই সংবাদ পাবো। কিন্তু এই সংবাদটা আর আসে না। ছেলে হারানোর বেদনায় বাবা-মা বাকরুদ্ধ হয়ে আছেন।পুলিশের কাছে যখন গিয়েছি তখন নির্বাচনের পর খবর দেয়ার আশ্বাস দিলেও নির্বাচন হয়ে গেলো দুই বছর কিন্তু আমরা আমাদের ভাইয়ের কোনো খবর পাইনি।”


লাবনি বলেন, আমার শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকা পর্যন্ত ভাইয়ের সন্ধানের চেষ্টা করে যাবো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন আমার ভাইকে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করুন।”

ছাত্রদল নেতা সেলিম রেজা পিন্টুর বোন রেহানা বানু মুন্নি বলেন, “আমার ভাইকে যখন প্রশাসনের লোক নিয়ে যাচ্ছিল তখন বলেছিলাম আমার ভাই রাজনীতি করে, সে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত না। তখন তো বুঝিনি আমার ভাই গুম হয়ে যাবে। আমরা আমাদের ভাইকে ফেরত চাই।ভাইকে ফেরত না পেলে আমাদের বাবা-মা মারা যাবে।”

তিনি বলেন, “ভাইয়ের শোকে আমরা পাথরের টুকরো হয়ে আছি।আমাদের ভেতরে কোনো অনুভূতি নেই।”

এদের মধ্যে বিএনপির নিখোঁজ সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহমিনা রুশদির লুনা, নেয়াখালীর হাজীরপাড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ওমর ফারুকের স্ত্রী পারভিন আক্তার,  


লাকসাম পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার  বলেন, “প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকি এই বুঝি আমার স্বামী ফিরে আসবে। কিন্তু আসেনা। ছেলের সন্ধান করতে করতে আমরা শ্বশুর দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। জানি না শাশুড়িকেও চলে যেতে হবে কিনা।”


তিনি বলেন, আমি আমার স্বামীর কোনো সম্পদ কাজে লাগাতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন এই আইনটা পরিবর্তন করুন। আমরা খুব কষ্টে আছি। দয়া করে সত্যকে উদঘাটন করুন। আমাদের হারানো ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করুন।”


ছাত্রদল নেতা খালিদ হাসানের স্ত্রী সৈয়দা শাম্মী সুলতানা বলেন, অনেক কথা বলার প্রস্তুতি নিয়ে আসলে ও কষ্টের কারণে বলতে পারি না। সব কথা আটকে যায়। আমরা ছাড়া এই কষ্ট কেউ বুঝবে না।”


প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্বামীর সন্ধান চেয়ে শাম্মী বলেন, “আমরা গুম দিবস পালন করতে চাই না। আর যদি গুম দিবসের অনুষ্ঠান করতে না দেন তাহলে এই দিবস রাখার দরকার নাই।”


মাহবুব হাসান সুজন নামে এক নেতার স্ত্রী তাজনিন আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, “আর কষ্ট সহ্য করতে পারি না। দয়া করে বলুন আমার স্বামী কি জীবিত না মরে গেছে। মরে গেলে বলুন কোথায় রাখা হয়েছে। আমরা তার কবর দেখবো। অন্তত হাড্ডিটা হলেও দেখান।”


অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘অনন্ত অপেক্ষা’ নামের একটি প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শিত হয়।


(ঢাকাটাইমস/৩০আগস্ট/বিইউ/এআর/ ঘ.)