ঢাকা: যিলহজের দশম দিনে গোটা বিশ্বের মুসলমানগণ স্ব-স্ব এলাকায় পবিত্র ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ উদযাপন করেন। ঠিক একই সঙ্গে সারা বিশ্বের সামর্থ্যবান মুসলমানরা মক্কা নগরীতে হজ পালনের জন্য সমবেত হন। প্রকৃতপক্ষে দুনিয়ার সমস্ত নেতা-নেত্রী, দল-মত প্রভৃতিকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার চেতনা থেকেই একজন মুসলিম কোরবানির পশু জবেহ করে থাকেন।
মানুষ তার পাশবিক সত্তা তথা খাহেশাতকে পরিপূর্ণরূপে বিসর্জন দিয়ে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত; এই প্রতিশ্রুতি বা শপথই হল কোরবানির শিক্ষা। এই কথায় কুরআনের আয়াতের প্রতিধ্বনি- ‘নিশ্চয়ই আমার সালাত অর্থাৎ ইবাদাত, কোরবানি, জীবন এবং আমার মৃত্যু সবকিছু আল্লাহর জন্য’ (সুরা-আনয়াম-১৬২)।
মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই কোরবানির বিধান চলে আসছে। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতের এ ছিল একটি অপরিহার্য অংশ।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির এক রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওসব পশুর উপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যেসব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন’- (সূরা হজ-৩৪)।
মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানি হজরত আদম (আ.)-এর দু’পুত্র হাবিল ও কাবিলের কোরবানি। আন্তরিকতা ও উদ্দেশ্যের সততার কারণে হাবিলের কোরবানি কবুল হলো কিন্তু নিষ্ঠার অভাব ও অমনোযোগিতার কারণে কাবিলের কোরবানি আল্লাহর কাছে প্রত্যাখ্যাত হলো।
কোরবানির ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন হজরত ইব্রাহীম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.)। মহান আল্লাহর জন্য হজরত ইব্রাহীম (আ.) এর সর্বোৎকৃষ্ট ত্যাগ এবং হজরত ইসমাঈল (আ.) এর আত্মোৎসর্গ আল্লাহর কাছে এতই পছন্দ হলো যে তিনি ইব্রাহীম (আ.) কে আপন বন্ধুরূপে (খলিলুল্লাহ) গ্রহণ করলেন।
শুধু তাই নয় মহান আল্লাহ তাকে মুসলিম জাতির পিতার আসনে অভিষিক্ত করলেন এবং তার পুত্র ইসমাঈল (আ.) এর পবিত্র বংশধারায় সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর উত্থান ঘটালেন। তিনি হজরত ইব্রাহীম (আ.) ও হজরত ইসমাঈল (আ.) এর ত্যাগের ইতিহাসকে চিরঞ্জীব রাখার জন্য সর্বকালের সব সচ্ছল মানুষের জন্য কোরবানিকে বাধ্যতামূলক করলেন।
কোরবানির মৌলিক শিক্ষা
আমাদের জীবন, আমাদের সম্পদ সবকিছুই মহান আল্লাহর দান। পরম প্রভুর জন্য প্রিয় বস্তুকে উৎসর্গ করতে পারাই কোরবানির শিক্ষা। কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর কাছে বান্দাহর গোলামি প্রকাশ পায়, তার প্রভুর জন্য তার ভালোবাসা ও ত্যাগের মাত্রা নির্ণয়। আল্লাহর দান আল্লাহকে ফিরিয়ে দিতে আমরা কতটা প্রস্তুত তারই একটি ক্ষুদ্র পরীক্ষা হলো কোরবানি। আমাদের জীবন সম্পদ আল্লাহর কাছে উৎসর্গ করার প্রতিশ্রুতিই গ্রহণ করি আমরা কোরবানির মাধ্যমে। কোরবানির দেয়ার মধ্যে মৌলিক যে কথাটি আমরা বলি তা হলো, ‘আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু সারা জাহানের ‘রব’ আল্লাহর জন্য’ (সূরা আনয়াম-১৬২)।
মূলত আমাদের জীবন ও সম্পদের মালিক আল্লাহ। এ দু’টো জিনিস আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যয় করাই ঈমানের অপরিহার্য দাবি এবং জান্নাত লাভের পূর্বশর্ত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনের জীবন ও সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন’- (সূরা তওবা-১১০)। কাজেই জীবন-সম্পদ আল্লাহর এবং তা আমাদের কাছে আমানত। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ও তার পছন্দনীয় পথে তা ব্যয় করাই ঈমানের দাবি। কোরবানি মানুষকে ঈমানের এ দাবি পূরণের উপযুক্ত হয়ে গড়ে উঠতে সাহায্য করে।
কোরবানির প্রাণ শক্তি
কোরবানির উদ্দেশ্য অবশ্যই সৎ হতে হবে এবং তাতে ত্যাগের নজরনার বহিঃপ্রকাশ থাকতে হবে। কোরবানি প্রদর্শন ইচ্ছা ও অহঙ্কারমুক্ত হতে হবে। অনেকেই বাহবা পাওয়ার জন্য ও আলোচিত ব্যক্তিত্ব হওয়ার লক্ষ্যে লক্ষাধিক টাকার গরু-উট কিনে লাল ফিতা বেঁধে পথে ঘোরান। এটা যেমন ঠিক নয় তেমনি কোনো সচ্ছল ব্যক্তির জন্য জীর্ণশীর্ণ কমদামী পশু কোরবানিও অনুচিত। এক্ষেত্রে মহান আল্লাহর বাণীর দিকেই আমাদের ফিরে যেতে হবে।
আল্লাহ বলেন, ‘ওইসব পশুর রক্ত-মাংস আল্লাহর কাছে কিছুতেই পৌঁছে না- বরঞ্চ তোমাদের পক্ষ থেকে তোমাদের তাকওয়া তার কাছে পৌঁছে (সূরা হাজ)। এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট, উদ্দেশ্যের সততা ও খোদাভীতি কোরবানি কবুলের শর্ত। পশুটি কত বড় ও কত দামের সেটা আল্লাহর কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়।
ভোগ নয় ত্যাগেই আনন্দ- এটিও কোরবানির একটি শিক্ষা। কোরবানির গোশত গরিবদের মাঝে বিতরণ করে তাদের মুখে হাসি ফোটানও কোরবানির অন্যতম লক্ষ্য। রাসূল (সা.) কোরবানির তিন ভাগের এক ভাগ গোশত গরিবদের মাঝে বিতরণ করাকে মুস্তাহাব করেছেন। ইচ্ছে হলে এর বেশি এমনকি সবটাও দান করা বৈধ। কিন্তু আমাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যায়।
কোরবানির আগে ফ্রিজ ও ডিপ ফ্রিজ বিক্রির পরিমাণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এটা কেন? সম্মানিত পাঠকদের তা না জানার কথা নয়। কোরবানির গোশত খাওয়া ও সংরক্ষণ বৈধ, তবে তা করতে গিয়ে কোরবানির অন্যতম উদ্দেশে- ‘অন্যের জন্য ত্যাগ’ যেন লঙ্ঘিত না হয় সেদিকে আমাদের সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
শুধু পশু কোরবানি নয়, পশুত্ব কোরবানিও কোরবানির অন্যতম লক্ষ্য। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার সাথে আমাদের ভিতরকার পাশবিকতাকেও কোরবানি করতে হবে। পশু কোরবানির মাধ্যমে ঈমানের সাক্ষ্য প্রদান এবং পশুত্ব কোরবানির মাধ্যমে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়াই কোরবানির দাবি। কোরবানির মাধ্যমে ক্রোধ, হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, শত্রুতা ইত্যাদি পশুত্বকে দমন করে মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে জাগিয়ে তুলতে পারলে আমাদের কোরবানি সার্থক হবে এবং সমাজে শান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে পড়বে।
(ঢাকাটাইমস/১৭সেপ্টেম্বর/এমআর)