দলীয়ভাবে পৌরসভা নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনের মতোই। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নৌকা প্রতীক নিয়ে, বিএনপি লড়বে ধানের শীষ নিয়ে, জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা পাবেন লাঙ্গল। কিন্তু থাকবে না আরেক পরিচিত প্রতীক দাঁড়িপাল্লা। স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় দলটি এই নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশ নিতে পারছে না। এমনকি কোনো দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে জোটবদ্ধ হয়ে সে দলের প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগও নেই জামায়াতের। এই পরিস্থিতিতে জামায়াত কি নির্বাচনের বাইরে থাকবে? প্রশ্ন ছিল পৌর নির্বাচনে দামামা বাজার আগে থেকেই। প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর এরই মধ্যে মিলেছে প্রশ্নের জবাব। নির্বাচনের বাইরে রাখা গেল না দলটিকে। দলীয়ভাবে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক ব্যবহার করতে না পারলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার কৌশলটা ঠিকই বেছে নিয়েছে জামায়াত।
গত ৩ ডিসেম্বর ছিল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। ওইদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় জামায়াতের লোকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে। এর মধ্যে নাটোরের সিংড়া পৌরসভায় প্রার্থী হয়েছেন জামায়াতের কর্ম পরিষদ সদস্য জয়নাল আবেদীন। দিনাজপুরের ফুলবাড়ি পৌরসভায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন উপজেলা জামায়াতের আমির জয়নাল আবেদিন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের চারটি এবং সাতক্ষীরার দুটি পৌরসভাতেই একইভাবে প্রার্থী হয়েছেন ছয়জন জামায়াত নেতা। আরও বেশ কিছু পৌরসভায় স্বতন্ত্র হিসেবে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে জামায়াত। সরকারি জোটের শীর্ষ নেতারা বলছেন, জামায়াতকে নির্বাচন থেকে দূরের রাখার জন্য শত চেষ্টা করেও ফল হয়নি। তারা ঠিকই কৌশলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছে। তবে আর যাই হোক দাঁড়িপাল্লা মার্কা তারা ব্যবহার করতে পারছে না।
নিবন্ধন বাতিল হওয়ার ফলে ভোটের রাজনীতি থেকে জামায়াতের দলীয়ভাবে ছিটকে পড়ার প্রথম ধাপ শুরু হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তারা। জোটবন্ধু জামায়াত এবার এমনটিই করবে, আঁচ করতে পারছিলেন বিএনপির নেতারাও। তবে শরিক দলটি আগেভাগে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি জোটের মূল দলটিকে।
জামায়াত বরাবর নিজের স্বার্থে বিএনপিকে কাছে পেতে চাইলেও সময় ও সুযোগ মতো বিএনপিকে এতটুকু ছাড় না দেওয়ায় দলের নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ তাদের শরিক দলটির প্রতি। ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগকে মোকাবেলায় স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয় বিএনপি। ওই জাতীয় নির্বাচনে এই জোট কার্যকর প্রমাণ হলেও পরে বিতর্কিত দলটির কারণে বারবার বিব্রত হতে হয়েছে দলটিকে।
কেবল মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা হয়, জঙ্গিবাদের সঙ্গে দলটির সম্পর্ক থাকার সন্দেহ, আন্দোলনের নামে নির্মম নাশকতাসহ নানা কারণে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলও বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে। আবার সরকারও বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসার শর্ত হিসেবে জামায়াত ত্যাগের কথা বলেছে। তবে ভোটের রাজনীতিতে সুবিধার কথা চিন্তা করে চাপের মুখেও বিএনপি এই সিদ্ধান্ত নিতে দোটানায়। যদিও দলের একটি অংশ চায়, জামায়াতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করুক বিএনপি। জোটবদ্ধ হওয়ার পর নানা সময় দেখা গেছে, জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনে বিএনপিকে জামায়াতের চাহিদা সমঝেই চলতে হয়েছে।
বিএনপি কোনো আসন জামায়াতকে ছাড়তে রাজি না হলেও জামায়াত অনেক এলাকায় নিজের প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে। কোথাও কোথাও জামায়াত হয়ত জিতেছে, কিন্তু এভাবে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে বেশিরভাগ এলাকাতেই বিএনপির প্রার্থীর পরাজয় নিশ্চিত করেছে জোটের এই দলটি। নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় এবার পৌর নির্বাচনে জামায়াত অংশ নিতে পারবে না জানা ছিল আগেভাগেই। অবশ্য জামায়াত তার অস্তিত্ব ও অন্তত বিএনপির কাছে গুরুত্ব টিকিয়ে রাখতে ভিন্ন কৌশলে নির্বাচনে অংশ নেবে সেটা অনুমেয়ই ছিল। তবে কোণঠাসা অবস্থায় দলটি অন্তত বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেবে ধারণা করেছিলেন বিএনপির নেতারা। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত না নিয়েই নিজেদের কিছু অবস্থান আছে এমন আসনে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দিয়েছে দলটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর একজন নেতা বলেন, ‘জামায়াত নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশ নিতে পারলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থন করছে। তবে তাদের প্রতীক হবে ভিন্ন ভিন্ন।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে কোনো দেন-দরবার হয়নি। আমরা নিজেদের মতো করে প্রার্থী বাছাই করেছি। এখানে একই পৌরসভায় বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতের আলাদা প্রার্থী হতে কোনো অন্তরায় দেখছি না।’ জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘পৌরসভা নির্বাচন তো জাতীয় কোনো নির্বাচন নয়। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আমাদের জোট এখনও রয়েছে ঠিক আছে, তবে সেটির মূল লক্ষ্য কিন্তু জাতীয় নির্বাচন।’ তিনি বলেন, ‘অতীতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপি আর জামায়াত নিজের পছন্দ অনুযায়ী আলাদা প্রার্থী দিয়েছে। এবারও এর ব্যতিক্রম হওয়ার কারণ দেখছি না।’ ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে। এর বিরুদ্ধে দলটি আপিল করলেও পৌর নির্বাচনের আগে এই ইস্যুর চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
জামায়াতকে কতটা ছাড় দেবে বিএনপি?
বিএনপির সূত্র জানায়, শরিক দলের জন্য অন্তত কয়েকটা তো ছাড় দিতেই হবে। সেটা কতটা হবে তা প্রার্থী বিবেচনা করেই দিতে হবে। কারণ সরকারি দল চাইছে সব জায়গায় তাদের দলের জয়। এজন্য তারা কৌশলী হবে। সেখানে বিএনপিও ভিন্ন কিছু চিন্তা করছে। আপাতত বিএনপির প্রায় সব কটি পৌরসভায় তাদের প্রার্থী দিচ্ছে। পরে জোটের জন্য কোনো পৌরসভা ছাড়া হলে সেখানে তাদের প্রার্থী ওই জোটের দলের প্রার্থীর জন্য কাজ করবে।
এদিকে সূত্র জানায়, বিএনপি জোটের অন্য দলের বিষয়টি সেইভাবে বিবেচনা না করলেও জামায়াতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে নানা হিসাব-নিকাশ করতে হচ্ছে। গত দুই বছর ধরেই আন্তর্জাতিক মহলের তরফ থেকে জামায়াত ছাড়ার ব্যাপারে চাপ রয়েছে। সময় এলেই জামায়াতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে খালেদা জিয়া একাধিকবার বললেও এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনাই এখন পর্যন্ত করেননি তিনি। বিএনপির একটি সূত্র জানায়, জামায়াতের কিছু পৌরসভা রয়েছে যেখানে অতীতের নির্বাচনগুলোতে তাদের প্রার্থীরা ভালো ভোট পেয়েছিলেন। এসব এলাকায় বিএনপির ভোটও বেশি নয়। সেই সব পৌরসভা বিএনপিকে ছাড় দিতে হতে পারে জামায়াতের জন্য।
তবে বেশ কিছু পৌরসভা আছে যেখানে জামায়াত ও বিএনপি দুই দলেরই ভালো অবস্থান আছে। এসব আসনে কোন দল কাকে ছাড় দেয়, সেটা কৌতূহলের বিষয়। কারণ, এর আগে জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় নির্বাচনে এ রকম এলাকায় জামায়াত বিএনপিকে ছাড় দিয়েছে এমন উদাহরণ বিরল। এমনকি গত উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বগুড়াতে জামায়াত তাদের ছাড় দিতে রাজি হয়নি। জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে প্রথমে ছয়টিতে জামায়াতকে ছাড় দেয় বিএনপি। কিন্তু জামায়াতের দাবি ছিল আরও তিনটি। শেষ পর্যন্ত সেগুলোতেও জামায়াত প্রার্থী দাঁড় করায়। বিএনপির ঘাঁটিতেই জামায়াতের এমন আচরণ জোটের মূল দলটির নেতা-কর্মীদের কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে তখন।
একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরসহ চারটি আসনে বিএনপির সমর্থন না পেয়েও জামায়াত তাদের প্রার্থী দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। জামায়াতের জেদের বসে পরে বিএনপি এই আসনগুলো জোটের দুই দলের জন্যই উন্মুক্ত রাখে। আর সব কটিতেই বিএনপির প্রার্থী হেরে যান ভোট ভাগাভাগি হওয়ায়। ২০১১ সালের পৌর নির্বাচনে ৫০ পৌরসভায় মেয়র পদে জোটের সমর্থন চেয়েছিল জামায়াত। শেষ পর্যন্ত ২০টিতে ছাড় দেয় জোটের প্রধান শরিক বিএনপি। এবারও জামায়াতের দাবি ৫০ পৌরসভা। সে লক্ষ্যে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি পৌরসভার মেয়র পদে মনোনয়নপত্রও সংগ্রহ করা হয়েছে। তারা কৌশলে নির্বাচনী কার্যক্রমও শুরু করে দিয়েছে।
বিএনপির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ‘বৃহ¯পতিবার রাতে পৌর নির্বাচন নিয়ে ২০ দলীয় জোটের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠক থেকে ২০ দলীয় জোটনেত্রীকে পৌর নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেখানে নেত্রী পৌর নির্বাচনে সমন্বয়কারী হিসেবে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান এবং আমাকে (আসাদুজ্জামান রিপন) ও জামায়াতের আবদুল হালিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই বৈঠকে জামায়াতের পক্ষ থেকে মেয়র প্রার্থীদের একটি তালিকাও দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য দল প্রকাশ্যে মনোনয়নের ব্যাপারে কাজ করলেও জামায়াত সেটা তেমনভাবে করতে পারছে না। এই কারণে তারা অনেকটা সংগঠিতভাবেই নিজস্ব পদ্ধতিতে নীরবে কাজ করছে। তাদের প্রার্থীদের স্বতন্ত্র হওয়ার জন্যও বলেছে। এই অবস্থায় সোমবার ওয়ার্কার্স পার্টির তরফ থেকে দাবি জানানো হয়েছে, জামায়াত যাতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে। তাদের প্রতিহত করারও ঘোষণা দিয়েছে।
তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার রকিবউদ্দিন আহমেদ জামায়াতের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে বলেছেন, নিবন্ধিত দলগুলো তাদের দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করে। আইনে সেটি বলা আছে। জামায়াত দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে না, তবে স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচন করার সুযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের এক সদস্য বলেন, প্রতিকূল অবস্থা মেনে নিয়েই জামায়াত মাঠে আছে এবং থাকবে। পৌর নির্বাচনে ছাড় দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। দলীয় প্রতীকে না পারলে অন্য যেকোনো প্রক্রিয়ায় দলের প্রার্থীরা ভোটে লড়বেন।- সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।