logo ২১ এপ্রিল ২০২৫
৩৪তম বিসিএস
নারীর সাফল্যের আরেক অধ্যায়
মহিউদ্দিন মাহী ও হাবিবুর রহমান, ঢাকাটাইমস
১৮ মে, ২০১৬ ০০:০৭:৪৫
image



ঢাকা: ঘর ছেড়ে বের হতে নারীকে কম কষ্ট করতে হয়নি। কিন্তু পদে পদে বাধা পেরিয়ে এখন নারীরা সাফল্যের সাক্ষর রাখছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই। সেটা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষা হোক আর চাকরিতে নিয়োগের পরীক্ষাই হোক। সরকারি চাকরিতে নিয়োগে সবচেয়ে সম্মানজনক বিসিএসে নিয়োগ পরীক্ষাই বা এর ব্যতিক্রম হবে কেন?






দুই যুগ আগেও বাংলাদেশে নারীদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে নানা প্রচার প্রচারণা চালাতে হয়েছে সরকারি বা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাকে। ঘর থেকে বের করে অর্থনৈতিক কাজে নারীকে সম্পৃক্ত করতে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচির পাশাপাশি আইন করে কিছু অধিকার নিশ্চিত করতে হয়েছে। এর সুফলও মিলছে।






গত কয়েক বছর ধরেই বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে নারীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ বিসিএস বাদ দিলে এবারই নারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ৩৪ তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে যে ২০২০ জন নিয়োগ পেয়েছেন তাদের মধ্যে ৬৯৯ জনই নারী। শতকরা হিসাবে যা ৩৪.৬ শতাংশ।






কেবল সংখ্যায় নয়, শিক্ষা বাদে ২০টি ক্যাডারে নিয়োগ পরীক্ষার মধ্যে আটটিতেই প্রথম হয়েছে নারীরা। আর শিক্ষার ৩০টি বিভাগের মধ্যে ১৩টিতেই প্রথম হয়েছেন নারী প্রার্থী। বেশ কিছু ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে শতভাগই আবার নারী। 






নারী জাগরণে বাংলাদেশকে বিশ্বের উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান ও বিরোধীদলীয় নেতার পদে আসীন নারীরাই। জাতীয় সংসদের স্পিকার পদেও আছেন নারী। আর যে পোশাক খাত বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিচ্ছে তার সিংহভাগ কৃতিত্বই নারীদের। এই খাতের বেশিরভাগ কর্মীই তারা। ইদানিং গাড়ি চালানোর মতো পেশাতেও নারীদেরকে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা নারীদেরকে নিয়োগ দিতে উৎসাহী। কারণ, তাদের গবেষণা বলছে,নারীরা ট্রাফিক আইন বেশি মানেন আর গাড়ি চালনায় অনেক বেশি সতর্ক থাকেন। ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কম থাকে।






ঘর সামলানোর গুরু দায়িত্বের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ পেশাতেও এগিয়ে আসছেন নারীরা। বেসরকারি ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা, এনজিও, আইনজীবী পেশা আর ব্যবসা এমনকি শ্রমিকের কাজেও পিছিয়ে নেই নারীরা।






তবে পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নতি হলেও এখনও সামাজিক, পারিবারিক নানা বাধা রয়ে গেছে নারীর জন্য। নারীর প্রতি সহিংসতা, রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গী অতিক্রম করেই সফল হচ্ছে তারা। 






জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ইব্রাহীম হোসেন খান বলেছেন, ‘নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে যোগ্যতা ও দক্ষতা দিয়েই। অগের যে কোনো সময়ের চেয়ে তারা সুযোগ বেশি পাচ্ছে। বিসিএস ক্যাডারে তাদের এই উপস্থিতি তারই প্রমাণ’।






সাবেক জনপ্রশাসন সচিব আব্দুস সোবহান শিকদার বলেন, ‘নারীরা দক্ষতা ও যোগ্যতায় এখন অনেক এগিয়ে। সব ক্ষেত্রেই তারা যোগ্যতার সাক্ষর রাখছে। এটা নারীর উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক অবদান রাখবে’।






বিসিএস প্রশাসন আর চিকিৎসায় নারীদের জয়জয়কার






৩৪তম বিসিএস ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া ২৭৯ জন কর্মকর্তার মধ্যে ১০৭ জনই নারী। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো এক বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে এত বিপুলসংখ্যক নারী নিয়োগ পেলেন।এ ছাড়া প্রথম ১০ কর্মকর্তার মধ্যে নারী ছয়জন।






তালিকা থেকে দেখা যায়, প্রশাসন ক্যাডারের প্রথম ১০ জনের মধ্যে প্রথমে আছে মুনিরা চৌধুরী। তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানও নারীর দখলে। তারা হলেন সাঈদা পারভীন ও সাইয়েমা হাসান। ষষ্ঠ স্থানে মাহমুদা বেগম, অষ্টম স্থানে কোহিনুর জাহান এবং নবম স্থান দখল করেছেন রাবেয়া আক্তার।






তথ্য ক্যাডারের তিনজন কর্মকর্তার মধ্যে দুজনই নারী। তারা হলেন মারুফা রহমান ইমা ও তানিয়া আক্তার। ডাক বিভাগে দুজনের মধ্যে একজন নারী কর্মকর্তা রয়েছেন। পুলিশ ক্যাডারে মোট ১৪২ জনের মধ্যে মেয়ে ২৫ জন, ছেলে ১১৭ জন।






পররাষ্ট্র ক্যাডারে মোট ২১ জনের মধ্যে মেয়ে নয় জন, ছেলে ১২ জন। আনসার ক্যাডারে মোট ২১ জন এর মধে মেয়ে দুই জন, ছেলে ১৯ জন। নিরীক্ষা ও হিসাব রক্ষা ক্যাডারে মোট তিন জন, এর মধ্যে মেয়ে এক জন ছেলে দুই জন। কর ক্যাডারে ৩৫ জনের মধ্যে মেয়ে নয় জন, ছেলে ২৬ জন। সমবায় ক্যাডারে মোট দুই জন। দুই জনই মেয়ে। ইকোনমিক ক্যাডারে ২১ জন এর মধ্যে মেয়ে আট জন, ছেলে ১৩ জন।






খাদ্য ক্যাডারের পাঁচ জনের মধ্যে এক জন, তথ্য ক্যাডারের সহকারী পরিচালক/তথ্য অফিসার পদের তিন জনের দুই জন সহকারী পরিচালক (অনুষ্ঠান)২১ জনের মধ্যে সাত জন, সহকারী বার্তা নিয়ন্ত্রক ছয় জনের এক জন মেয়ে।






মৎস্য ক্যাডারে মোট ৬৯ জনের মধ্যে ১৭ জন, পশুসম্পদ ক্যাডারে ভেটেরিনারি সার্জন/বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রভাষক পদের ৪৯ জনের ১৩ জন,হাস-মুরগি উন্নয়ন কর্মকর্তা/সহকারী হাঁস মুরগির সম্প্রসারণ কর্মকর্তার নয় জনের তিন জন মেয়ে।






কৃষি ক্যাডারে মোট ২৫৯ জনের মধ্যে ৯০ জন নারী। একই ক্যাডারে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ১৪ জনের মধ্যে পাঁচ জন আর গবেষণা কর্মকর্তা সাত জনের মধ্যে একজন নারী। 






স্বাস্থ্য ক্যাডারে নারীদের সাফল্যের হার আরও বেশি। সহকারী সার্জন ১৭৯ জনের মধ্যে ৭৫ জনই নারী। শতকরা হিসাবে এই হার ৩৮ শতাংশেরও বেশি। একই ক্যাডারের সহকারী ডেন্টাল সার্জন ৪১ কর্মকর্তার মধ্যে নারী ১৫ জন।






তথ্য ক্যাডারের সহকারী বেতার প্রকৌশলী মোট ১৬ জনের মধ্যে ছয় জন এবং রেলওয়ে প্রকৌশল ক্যাডারের সহকারী প্রকৌশলী তিন জনের মধ্যে এক জন মেয়ে।






গণপূর্ত ক্যাডারে সহকারী প্রকৌশলী ৩৬ জনের মধ্যে দুই জন আর সহকারী প্রকৌশলী (ই-এম)১৭ কর্মকর্তার মধ্যে ছয় জন নারী।






শিক্ষা ক্যাডারেও ঈর্ষণীয় সাফল্য






শিক্ষা ক্যাডারে বিভিন্ন শাখায় মোট নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৭৪৭ জনকে। এদের মধ্যে নারী ২৮৮ জন। অর্থাৎ ৩৮ শতাংশেরও বেশি নারী নিয়োগ পেয়েছেন এই ক্যাডারে।






বাংলায় ৭৭ জনের মধ্যে ৩২ জন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ৬১ জনের ২৪ জন,প্রাণিবিদ্যায় ২২ জনের মধ্যে ১০ জন, ইংরেজিতে ৯৭ জনের মধ্যে ২৮ জন, অর্থনীতিতে ৬২ জনের মধ্যে ২৯ জন, দর্শনে ২৮ জনের মধ্যে চার জন, ইতিহাসে ২০ জনের মধ্যে নয় জন, ইসলামের ইতিহাসে ৪৮ জনের মধ্যে ১৮ জন, সমাজবিজ্ঞানে ২২ জনের মধ্যে ১০ জন, সমাজকল্যাণে ১৬ জনের মধ্যে সাত জন, পদার্থ বিজ্ঞানে ৪০ জনের মধ্যে ১১ জন, রসায়নে ৩০ জনের মধ্যে নয় জন, উদ্ভিদ বিদ্যায় ২৮ জনের মধ্যে ১৯ জন, কৃষি বিজ্ঞানে দুই জনের মধ্যে এক জন নারী।






গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিষয়ে চারজনের সবাই এবং মনোবিজ্ঞান ও প্রভাষক সাধারণ শিক্ষায় বিভাগে নিয়োগ পাওয়া চার জনই নারী। ভূগোলে সাত জনের মধ্যে চার জন, হিসাব বিজ্ঞানে ৬৪ জনের মধ্যে ২৩ জন, ব্যবস্থাপনায় ৬০ জনের মধ্যে ২২ জন, মার্কেটিংয়ে আট জনের এক জন, মৃত্তিকা বিজ্ঞানে নয় জনের মধ্যে ছয় জন, পরিসংখ্যানে পাঁচ জনের দুই জন,গণিতে ২৪ জনের ১১ জনই নারী।  






ক্রমেই আরও ভালো করছেন নারীরা






গত কয়েক বছরের মধ্যে নারীরা সবচেয়ে ভালো করেছে ৩২তম বিশেষ বিসিএসে। সে বছর নিয়োগ পাওয়াদের ৫৫ শতাংশই ছিল নারী। তখন চাকরি পান মোট ৯২৩ জন। তবে এই বিসিএসটি মূলত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নারী কোটার জন্য ছিল।






৩৩ তম বিসিএসেও ঈর্ষণীয় সাফল্য পায় নারীরা। তখন চাকরি পাওয়া আট হাজার ৩৭৮ জনের মধ্যে নারী ছিলেন তিন হাজার ২০২ জন। শতকরা হিসাবে এই সংখ্যা ৩৮.২২।






এর আগে এর মধ্যে ২৯তম বিসিএসে চাকরি পাওয়াদের মধ্যে ২৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ ছিলেন নারী। ৩০তম বিসিএসে তা বেড়ে হয় ৩১ দশমিক ৪৩ শতাংশ।






নারী অধিকার কর্মীরা বলছেন, ছেলেদের তুলনায় মেয়েদেরকে বেশি সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। তারপরও একাগ্রতা আর নিষ্ঠার কারণে তারা ভালো করছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ কর্ম কমিশনের সদস্য আনোয়ারা বেগম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘নারীরা এখন অনেক সচেতন। পরিবেশ আগের তুলনায় কিছুটা হলেও নারীবান্ধব হয়েছে। তা ছাড়া অভিভাবকরাও এখন তার মেয়ে সন্তানের ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। আগে নারীদের এ রকম সুযোগ ছিল না। প্রশাসনে নারীদের এই উপস্থিতি দেশের জন্য ইতিবাচক। এর মধ্য দিয়ে নারীরা আরও একধাপ এগিয়ে গেল’।






জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘নারী উন্নয়নে সরকারের যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা চলছে তারই ধারাবাহিকতায় নারীরা সব ক্ষেত্রেই আজ এগিয়ে চলেছে। সারা পৃথিবীতে যেখানে নারীরা এগিয়ে চলেছে, সেখানে বাংলাদেশের মেয়েরা পিছিয়ে থাকতে পারে না। তারা আরও এগিয়ে যাবে, আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রকে আরও সভ্য, আরও সুন্দর করবে’।






ঢাকাটাইমস/১৭মে/এমএম/ডব্লিউবি