রাজশাহী: ২০ জুলাইয়ের সকাল। রাজশাহী নগরের বড়কুঠি এলাকায় বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন কলেজছাত্র নাহিদ। তার কাঁধে বসে এক সবুজ টিয়া। বন্ধুর বাসার কলিং বেলে চাপ দিয়ে অপেক্ষা করছেন নাহিদ। একটু পরেই এলেন বন্ধু নাঈম। নাহিদ-নাঈমের কুশল বিনিময়ের মাঝে নিশ্চুপ টিয়া।
তারপর তার দিকে নাঈমের চোখ পড়তেই টিয়ার প্রশ্ন ‘আমি টিয়া, তোমার নাম?’ টিয়ার লাল টুকটুকে ঠোঁটে হাত বুলিয়ে নাঈমের জবাব ‘আমি নাঈম, তুমি আমার কে হও বলো তো? টিয়ার সাবলীল উত্তর ‘আমি তোমার কাকা’।
টিয়াটি সবার কাকা। বয়স মাত্র সাড়ে ছয় মাস। অথচ নিজেকে সবার কাকা হিসেবেই পরিচয় দেয় সে। এর কারণ জানিয়েছেন কলেজছাত্র নাহিদ। বলছিলেন, বন্ধু-বান্ধবরা তাকে ‘কাকা’ হিসেবে সম্বোধন করে। আর প্রায় সব সময়ই তার সঙ্গে থাকে টিয়া। তাই সেও নিজেকে সবার কাকা বলে মনে করে। তিনি নিজেও টিয়াকে ‘কাকা’ বলেই ডাকেন।
নাহিদের পুরো নাম মেহেদি হাসান নাঈম। রাজশাহী কলেজে ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। বাড়ি রাজশাহী নগরের মালোপাড়া এলাকায়। টিয়ার সঙ্গে তার ভালোবাসার বন্ধন শুরু ৮ বছর আগে। তখন পড়তেন ক্লাস এইটে। সেসময় একবার জেলার গোদাগাড়ীর শ্রীরামপুরে গিয়েছিলেন খালার বাসা বেড়াতে। খালাতো ভাই তুহিন টিয়া পালন করতেন খাঁচায় বন্দী করে। এতে নাহিদের ভীষণ মন খারাপ হয়। নাহিদ ভাবেন, সারাক্ষণ বন্দী করে রাখায় টিয়ার কত কষ্ট হয়!
তাই খালু আবুল কাশেমের কাছে আবদার করেন টিয়াটাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু খালাতো ভাই তুহিন এতে রাজি হননি। তাই সেবার টিয়াটিকে তার সঙ্গে আনা হয়নি। কিন্তু টিয়া নেয়ার ঝোঁক তার মধ্যে চেপে বসে। ক’দিন পর আবার যান খালার বাসায়। সেবারও তার টিয়া নেয়ার ‘মিশন’ ব্যর্থ হয়। তবে হাল ছাড়েননি নাহিদ। কদিন পর আবারও যান খালার বাসায়। এবার নাহিদকে পাখিটা দেন খালাতো ভাই। সেই থেকে তার টিয়ার সঙ্গে পথচলা শুরু।
নাহিদ জানান, ওই টিয়াটির বয়স ছিল ছয় বছর। তাই তাকে পোষ মানানোটা একটু কঠিন ছিল। তাই ওই পাখিটি তিনি তার এক ভাবিকে দিয়ে দেন। এরপর চারঘাট থেকে আড়াই হাজার টাকা দিয়ে আরেকটি টিয়া সংগ্রহ করেন। এই টিয়াটি সহজেই পোষ মানে। ধীরে ধীরে বাড়ির একজন সদস্য হয়ে ওঠে পাখিটি। এরই মধ্যে তার ছোট বোনের বিয়ে হয়। বোন আবদার করে, পাখিটি সে তার শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাবে। তাই এই পাখিটি তাকে দিয়ে দেন নাহিদ।
এরপর দুই হাজার ৮০০ টাকা দিয়ে এখনকার এই টিয়াটিকে সংগ্রহ করেন নাহিদ। তখন মাত্র ৩৫ দিন বয়স ছিল টিয়াটির। এখন তার বয়স বেড়ে সাড়ে ছয় মাস। এরই মধ্যে বাবা-ছেলের মতো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে নাহিদ আর টিয়ার। ধীরে ধীরে মানুষের কথাবার্তাও রপ্ত করছে টিয়াটি। নিজের নাম বলতে পারে। নিজেকে সবার কাকা হিসেবেও পরিচয় দিতে পারে। কিছু কিছু কথাও হয় নাহিদের সঙ্গে।
শুধু কলেজ ছাড়া বাকি সব জায়গাতেই নাহিদের সঙ্গী হয় তার টিয়া। বসে থাকে কাঁধের ওপর। মাঝে মাঝে উড়ে গিয়ে গাছের ডালে গিয়ে বসে। আবার পেছন পেছন উড়ে এসে কাঁধে বসে। তবে কলেজে গেলে নাহিদ পাখিটাকে খাঁচায় ভরে ঘরের ভেতর রেখে যান। তখন তার মা খাবার দিলেও তাতে আগ্রহ কম থাকে পাখিটার। অভিমানে মন খারাপ করে বসে থাকে।
পাখিটার ছেলের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণে বিরক্ত নাহিদের মা। বলেন, ‘আরে বাবা, তোর খাওয়া দিয়েছি। খাবি না কেন? কেন তাকে (নাহিদকে) এসে দাঁড়াতে হবে?’ আস্তে আস্তে বুঝে গেছেন কাকা-ভাতিজার এই আত্মিক বাঁধনের মর্ম। তাই খাওয়ার সময় হলে নাহিদ মায়ের মোবাইলে ফোন করেন। টিয়া চুপটি করে শোনে। মাঝে মাঝে কথা বলে। ‘তুমি এসো’, ‘আমি খাবো’, ‘খাবো না’, ‘আমি যাবো’- এসব বলতে পারে সে।
কথা হলে খাওয়ার বাটির দিকে এগোয়। তাই দূরে থাকলে খাওয়ার আগে ফোনে কথা বলাটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। আর পাশে থাকলে আবোল-তাবোল কথা হয়। কোনো দিন মিউমিউ ডাক শেখান, কোনো দিন শিস দেয়া। দুটোই খুব ভালো পারে টিয়া। আর পারে রাগতে। ডানা, শরীরটাকে ফুলিয়ে রাগ দেখায়।
নাহিদ জানান, টিয়াটাকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই তার। তবে একটু ঝামেলা আছে। রাত জেগে পড়াশোনা করেন নাহিদ। কিন্তু রাতে তার সঙ্গে কথা না বলে ঘুমানো যায় না। তার দিকে ঘুরে না ঘুমালেও রাগ করে সে। এভাবে রাত ২টা বেজে যায়। আবার ভোরের আলো ফুটলেই ডাকাডাকি শুরু করে টিয়া। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থেকেও সকালে একটু বেলা পর্যন্ত আয়েশ করে ঘুমানোও চলবে না!
(ঢাকাটাইমস/২৪জুলাই/প্রতিনিধি/জেবি)