ঢাকা: স্বাভাবিকের চেয়ে দেড় গুণেরও বেশি দামে চাল কিনতে বাধ্য হচ্ছে ভোক্তারা। সরকার ধান-চাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে যে দাম নির্ধারণ করেছে সেই দামে কৃষক ধান বেচতে পারছে না। অথচ সরকারের নির্ধারণ করার অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে চাল। কিন্তু আইনি ক্ষমতা থাকলেও বাজারে সরকারি কর্মকর্তাদের কোনও তদারকি বা হস্তক্ষেপ নেই।
সরকারের হিসেব অনুযায়ী, এ বছর প্রতি কেজি বোরো ধান উৎপাদনে ২০ টাকা ৭০ পয়সা ও চাল উৎপাদনে ২৯ টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু হাড় ভাঙা খাটুনির পর কৃষক লোকসানে থাকলেও চাল উৎপাদন করে ব্যবসায়ীরা বিপুল পরিমাণ মুনাফা করছে।
বাজারে চালের দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে নিম্ন আয়ের মানুষ। গবেষণায় দেখা গেছে, গরিব মানুষ তার আয়ের বেশিরভাগ অংশই খরচ করে চাল কিনতে। ফলে চালের দাম বেশি হলে এই শ্রেণির মানুষ অন্যান্য খরচ কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ফলে তাদের স্বজনদের, শিক্ষা, চিকিৎসা বা অন্যান্য খরচ কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়। এতে তাদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধিতে বাধা তৈরি হয়।
কিন্তু সরকার কোনো পণ্যের দাম বাড়লে সেই পণ্যের বাজারে কিছুটা হলেও নজরদারি বা তদারকি করলেও গত কয়েক বছরে চালের বাজারে তেমন কোনো তদারকিই করেনি।
চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, বছর বিশেক আগেও চালের বাজারে স্থানীয় কৃষকদের একটি ভূমিকা ছিল। তারা ধান থেকে চাল ভাঙিয়ে বিক্রি করতেন। ফলে বাজারে কারসাজি করা কঠিন ছিল। কিন্তু গত দুই বছরে বাজারের চাল সরবরাহকারী হিসেবে এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা হারিয়ে গেছেন। এখন প্রায় ১৬ হাজার চালকল এবং সাড়ে তিনশর মতো অটো রাইস মিলই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।
ধানের উৎপাদন বাড়ছে প্রতি বছরই। উৎপাদন এতটাই বেড়েছে যে, মৌসুমের শুরুতে ক্রেতাই পাওয়া যায় না। স্বাধীনতার পর আমদানিনির্ভর বাংলাদেশ এরই মদ্যে চাল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে নাম লিখিয়েছে। কিন্তু তাতে কৃষকের লাভ হয়নি। গবেষণা বলছে, প্রধান খাদ্যশস্য ধান চাষ করে কৃষক প্রায়ই লোকসানে থাকে।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান এ বিষয়ে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘যদি ধানের দাম কম হয় এবং চালের দাম বেশি হয় তাহলে বুঝতে হবে কৃষকরা ঠকছে, কিন্তু ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছে’। গরিব মানুষের কথা চিন্তা করে হলেও চালের বাজার তদারকি করা জরুরি মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদে বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর দিকে মনযোগ দিতে হবে। প্রতিযোগিতা বাড়লে বাজারে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কারসাজি করা সহজ হবে না।’
বোরো মৌসুমের শুরুতে কৃষক চলতি বছর ধান বিক্রি করেছে সাড়ে চারশ থেকে পাঁচশ টাকা মণ দরে। বড় চালকলগুলো এই দরেই ধান কিনেছে। তবে বর্তমানে দাম কিছুটা বেড়েছে।
কম দামে ধান বিক্রি করে নাভিশ্বাস কৃষকের। অথচ গত শুক্রবার কারওয়ানবাজার গিয়ে দেখা যায়, প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে। আর নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫৮ টাকায়, পাইজাম ৩৬ থেকে ৩৮ টাকায়। আর মোটা স্বর্ণা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৪ টাকা কেজি করে। তবে খুচরা পর্যায়ে মুদির দোকানে দাম আরও বেশি।
ক্রেতাদের অভিযোগ, চালের বাজারে কারসাজি হলেও সরকারি কোনও সংস্থা এ বিষয়ে কোনও নজরদারিই করে না। ফলে ধান চাষ করে লোকসানে থাকলেও চাল উৎপাদনকারীরা বিপুল পরিমাণ লাভ করছে।
ধান ও চালের দামে সামঞ্জস্য নেই
নওগাঁ চালকল সমিতির সাবেক সভাপতি তৌফিকুল ইসলাম বাবু ঢাকাটাইমসকে জানান, চিকন ধানের ক্ষেত্রে প্রতি ৪০ কেজিকে চাল পাওয়া যায় ২৬ কেজি। আর মোটা ধান হলে ২৮ কেজি পর্যন্ত পাওয়া যায়।
এই হিসাবে ধান থেকে চাল তৈরির পর মণপ্রতি সাত থেকে আট কেজি কুড়া পাওয়া যায়। এগুলো গো খাদ্য হিসেবে কেজিপ্রতি ১২ থেকে ১৫ টাকা করে বিক্রি করে চালকলগুলো। আর বাকি পাঁচ থেকে ছয় কেজি তুষও বিক্রি হয় কাছাকাছি দামে যেগুলো প্রধানত জ্বালানি তৈরি করা হয়।
আমাদের প্রতিনিধিরা জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও ও পাবনা, নওগাঁয় হাট-বাজারে ধানের দাম এখন কিছুটা বেড়েছে। মণ প্রতি এখন বিক্রি হচ্ছে ছয়শ থেকে ৭২০ টাকার মধ্যে। এই হিসাব অনুযায়ী এই দামে ধান কেনা হলেও বাজারে চালের দাম অনেক কম থাকা উচিত ছিল।
কারণ যদি ধানের দম ৭২০ টাকাও হয় এবং মণপ্রতি যদি ২৮ কেজি ধান হয় তাহলে প্রতিকেজির উৎপাদন খর হয় ২৫ টাকা ৭১ পয়সা।
বিভিন্ন হাত ঘুরে বিক্রি হলেও বর্তমান বাজারদরের চেয়ে অনেক কম দাম হওয়া উচিত-বলেছেন কারওয়ানবাজারের এক ব্যবসায়ীই।
তবে চালকল মালিক তৌফিকুল ইসলাম বাবু জানিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে ঢাকার বড় আড়ৎদাররা চাল কিনে নেন। সেখান থেকে কেনেন ছোট পাইকাররা। তাদের কাছ থেকে কিনে নেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। আড়তদার ও পাইকাররা কেজিপ্রতি এক টাকার মতো মুনাফা করেন আর খুচরা ব্যবসায়ীরা দুই টাকার মত লাভ করেন বলে জানান বাবু।
তাহলে চালের দাম এত বেশি কেন- জানতে চাইলে বাবু দাবি করেন, মৌসুমের শুরুতে কম থাকলেও ধানের দাম এখন বেড়ে গেছে। চিকন চালের ধান এখন ৯০০ টাকা মণ দরে কিনতে হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি। আগের কেনা ধানের সঙ্গে সমন্বয় করে কিছুটা কম দামে চাল বিক্রি করা যাচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।
আমাদের জেলা প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, বাবুর যতটা দাবি করেছেন, ধানের দাম অতটা বাড়েনি। আর ধান যদি মণপ্রতি দাম ৯০০ টাকাও হয়, তাহলেও উৎপাদন খরচ ৩৪ টাকার বেশি হয় না। অথচ এই চাল ভোক্তারা কিনে খাচ্ছেন ৫০ টাকা দরে।
চাল উৎপাদনে জড়িত একাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, ধান থেকে চাল তৈরিতে যে খরচ হয়, তা কুড়া ও তুষ বিক্রি করেই উঠিয়ে নেয়া যায়। সরকার চাল উৎপাদনে যে খরচ নির্ধারণ করে, সেখানে এটা ধরা হয় না। ফলে এখানেও প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। ইদানিং আবার ধানের কুড়া থেকে ভোজ্যতেল তৈরির কাজও শুরু হয়েছে।
ক্ষমতা থাকলেও চোখ বুঁজে সরকারি সংস্থা
চলতি বছর সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ২৩ টাকা কেজি দরে ধান ও ৩২ টাকা কেজি দরে চাল কিনেছে। অর্থাৎ ধানের তুলনায় চালের দাম দেড়গুণের কম। অথচ বাজারে ধানের তুলনায় চালের দাম দুই বা তিন গুণ। কিন্তু ভোক্তারা ঠকলেও কার্যত কোনও উদ্যোগ নেই সরকারের।
১৯৬৪ সালের কৃষি বাজার নিয়ন্ত্রণ আইন ও ১৯৮৫ সালের সংশোধিত বাজার নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৬ (১) ও ১৬ (২) ধারা অনুযায়ী কৃষিজাত ও ভোগ্যপণ্যের ক্রয়মূল্য বিক্রয়মূল্য ও মজুদ পরিস্থিতির তদারকি ক্ষমতা রয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের জেলা বাজার কর্মকর্তাদের। কিন্তু চালের দাম নিয়ন্ত্রণে কোনও উদ্যোগই নেই তাদের।
ধানের দামের তুলনায় চালের দাম বেশি থাকা এবং এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ না নেয়ার কারণ জানতে চাইলে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের প্রধান গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মকর্তা ওমর ফারুক চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আপনাদের কোনো ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য নই’।
তারপরও বাড়ছে দাম
ধানের দামের তুলনায় চালের দাম বেশি-এই অবস্থায় আরও বাড়ছে পণ্যটির দাম। নওগাঁ ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোধ চন্দ্র সাহা জানান, গত কয়েকদিনে চিকন চালে বস্তাপ্রতি দাম বেড়েছে একশ থেকে দেড়শ টাকা। সরকারের চাল সংগ্রহের কারণে চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে দাবি করেন তিনি।
বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ নাঈম মিয়া বলেন, ‘চালের দাম বেশি নির্ধারণ করায় মিল এবারে সরকারকে চাল দেবার প্রতি ঝোঁক বেশি মিলারদের। এ কারণে কেউ কেউ চাল এখন বিক্রি করছে না। এজন্য বাজারে চালের দাম একটু বেশি’।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্যমতে, গত বোরো মৌসুমে ৪৮ লাখ ৪৬ হাজার হেক্টর জমিতে এক কোটি ৯৩ লাখ ৪৩ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে। যার মধ্যে এক কোটি ৫৬ লাখ টন হাইব্রিড, ৩৬ লাখ ৪৫ হাজার টন উফশি এবং ৯৮ হাজার টন স্থানীয় জাতের চাল উৎপাদন হয়েছে।
(ঢাকাটাইমস/২৬জুলাই/এমএবি/ডব্লিউবি)