যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার বৈঠকে খুশির জোয়ার বইছে বিএনপিতে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর রাষ্ট্রীয় প্রটোকল না থাকায় সফররত বিদেশি প্রতিনিধিদের সঙ্গে গত দুই বছর বিএনপি চেয়ারপারসনের বৈঠক হয়নি। এ নিয়ে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে বিএনপিকে। সেই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পেরে স্বস্তি ফিরেছে দলে।
কেবল বৈঠক নয়, বিএনপির উৎফুল্লের আরেক কারণ খালেদা-কেরির মধ্যকার বৈঠকের দৈর্ঘ্য। সময়সূচি অনুযায়ী তাদের ১৫ মিনিট বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও তা ৩৫ মিনিট স্থায়ী হয়। কেরির আগ্রহের কারণেই নির্ধারিত সময়ের চেয়েও বেশি সময় বৈঠক চলে বলে জানিয়েছেন বিএনপি নেতারা। তারা এই বাড়তি সময় দেয়াকে বিএনপির দাবির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক মনোভাব হিসেবেই দেখছেন বিএনপির নেতারা।
জন কেরি বাংলাদেশ সফর করে চলে গেছেন তিন দিন হলো। এখনও এই সফর নিয়ে আলোচনা রয়ে গেছে। বিশেষ করে দুইবার আন্দোলনে ব্যর্থতার কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিপাকে পড়া বিএনপির নেতা-কর্মীরা জানার চেষ্টা করছেন, বিএনপি নেত্রীকে কেরি কী বলে গেছেন। বিএনপির যেসব বিষয়ে আগ্রহ সেসব বিষয়ে কেরি কোনো কিছু বলে গেছেন কি না।
যেসব উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছে বিএনপি
বৈঠকে অংশগ্রহণকারী একজন নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেছেন, কেরির সঙ্গে বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচন পদ্ধতি, খালেদা জিয়াসহ দলের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলাসহ বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন তারা। জন কেরিও বেশ কিছু বিষয়ে নিজে থেকে জানতে চেয়েছেন।
নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপি ও তার সমমনারা। রাজনীতি আপাতদৃষ্টিতে শান্ত হলেও নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিরোধের মীমাংসা হয়নি এখনও। ফলে আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠে কি না তা নিয়ে আছে শঙ্কা।
বিএনপির কূটনৈতিক কোরের নেতারা জানান, কেরির সঙ্গে বৈঠকে এই বিষয়টিই গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছেন তারা। তার এ বিষয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সহযোগিতার আশ্বাস মিলেছে।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলা নিয়েও উদ্বিগ্ন বিএনপি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় শুনানি চলছে। সরকারপক্ষ মামলাটির দ্রুত শেষ করে রায় দিতে চায় বলে অভিযোগ করছে বিএনপি। এ ছাড়া বড়পুকুড়িয়া কয়লাখনি ও গ্যাটকো দুর্নীতি মামলাও সচল হয়েছে।
বিএনপির অভিযোগ, এসব দুর্নীতি মামলায় সাজা দিয়ে সরকার খালেদা জিয়াকে আগামী নির্বাচনে অযোগ্য করতে চায়। এরই মধ্যে অর্থপাচার মামলায় সাত বছরের সাজা হওয়ায় নির্বাচন করার যোগ্যতা হারিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। নাশকতার মামলায় বিএনপির আরও বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়েছে। এসব মামলায় রায় বিরুদ্ধে গেলে আরও বেশ জন নেতাও আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।
বিএনপির সূত্র জানায়, এই উদ্বেগের কথাও জন কেরিকে জানিয়েছে বিএনপি।
বিএনপির কূটনৈতিক একটি সূত্রের দাবি, মামলায় সাজা দেয়ার আশঙ্কা প্রকাশের পর নির্বাচন নিয়ে বিএনপি প্রধানের ভাবনা জানতে চান কেরি। তারা কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে আগ্রহী তাও জানতে চাওয়া হয়। পরে বেগম খালেদা জিয়া তাকে বলেন, নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচন হলে সবার জন্যই তা ভালো হবে।
বিএনপি নেতাদের দাবি, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান বের করতে কাজ করবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন কেরি। একজন নেতা জানান, কেরি নিজে থেকেই একাধিকবার নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপির ভাবনার কথা খালেদা জিয়ার কাছে জানতে চেয়েছেন।
যে কারণে খুশি বিএনপি
বেশ কয়েক মাস ধরে কিছুদিন ধরে বিভিন্ন দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকরা বেগম খালেদা জিয়া তথা বিএনপির কোনো প্রতিনিধির সঙ্গে কোনো বৈঠক করতেন না। কিন্তু এরইমধ্যে জন কেরি বাংলাদেশে এসে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ সময় বৈঠক করায় তারা খুশি।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিএনপির অবস্থান যে আগের মতো আছে তার প্রমাণ এই বৈঠক। কারণ বৈঠকের জন্য ২০ মিনিট নির্ধারিত থাকলেও কেরির আগ্রহেই তা আরো ১৫ মিনিট পরে শেষ হয়।
সরকারি প্রটোকলে না থাকলেও খালেদা জিয়ার সঙ্গে কেরির বৈঠককে রাজনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখছেন বিএনপি নেতারা। তাদের দাবি, বিএনপির ইস্যুগুলো নিজে থেকেই জানতে চেয়েছেন জন কেরি। এটা বিএনপির জন্য ইতিবাচক খবর।
জন কেরির সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন যারা তাদের একজন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তবে বৈঠকে আলোচ্য বিষয়ে তিনি সরাসরি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। ঢাকাটাইমসের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বৈঠকের আলোচনা নিয়ে মহাসচিব কথা বলেছেন। এ নিয়ে আমার আর কোনো কথা নেই।’
জন কেরির সঙ্গে বৈঠক নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়েছেন একজনই। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওই বৈঠকের পর তিনি বলেছে, ‘গণতন্ত্র, নির্বাচন, আইনের শাসন, মানবধিকার পরিস্থিতিসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে।...আমরা আশাবাদী মার্কিন সহযোগিতার মাধ্যমে আমাদের দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি গণতন্ত্র ও আইনের শাসনও প্রতিষ্ঠিত হবে।’
সোমবার নয় ঘণ্টার ঝটিকা সফরে বাংলাদেশে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে রওশন ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতটি পূর্বনির্ধারিত ছিল না।
ঢাকা ছাড়ার আগে বিকাল সাড়ে চারটার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকাস্থ দূতাবাসে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক হয় জন কেরির। বৈঠকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও উপদেষ্টা সাবিহ উদ্দিন আহমেদ।
(ঢাকাটাইস/১সেপ্টেম্বর/বিইউ/ডব্লিউবি)