অপার সৌন্দর্যে ভরপুর দেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলা। প্রকৃতির নান্দনিকতায় একজন পর্যটককে মুগ্ধ করার প্রয়োজীয় প্রায় সব উপাদানই আছে এই ভাটির জনপদে। কিন্তু তার পুরোটা মেলে ধরা সম্ভব হচ্ছে না যোগাযোগ অবকাঠামোর অভাবে। নেই থাকা-খাওয়ার পর্যাপ্ত সুব্যবস্থা। অথচ এ অবস্থাতেই এখান থেকে প্রতি বছর কয়েক শ কোটি টাকা জমা পড়ছে সরকারের রাজস্ব ভান্ডারে।
জেলা সদর থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের কুলঘেঁষা সীমান্ত ও হাওরাঞ্চল তাহিরপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রতিনিয়ত হাতছানি দেয় পর্যটকদের। টাঙ্গুয়ার হাওর, স্বচ্ছ পানির যাদুকাটা নদী, বারেকটিলা, টেকেরঘাট চুনাপাথর খনিজ প্রকল্প এলাকার খননকৃত কোয়ারি, শাহ আরেফিন (র.) মোকাম, হাওলি জমিদার বাড়ি, অদ্বৈত প্রভুর মন্দিরসহ কত কত দর্শনীয় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এখানে। আছে নদীতে হাজার হাজার মানুষের একসঙ্গে নুড়িপাথর সংগ্রহের অনন্য দৃশ্য।
কিন্তু সৌন্দর্যের এই লীলাভূমির উন্নয়নে তেমন মনোযোগ নেই সরকারের। সেদিকে নজর আকৃষ্ট করতে স্থানীয় প্রশাসন আয়োজন করছে দুই দিনের জ্যোৎ¯œা উৎসবের, যেখানে যোগ দেবে দেশি-বিদেশি পর্যটকসহ সাধারণ মানুষ। উৎসবে তুলে ধরা হবে এই ভাটির জনপদের সৌন্দর্যের ঢালি, আর এর মাধ্যমে জোরালো করা হবে অবকাঠামো উন্নয়নের আবেদন।
টাঙ্গুয়ার হাওর
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওর। জলচর পরিযায়ী পাখির সবচেয়ে বড় বিচরণক্ষেত্র, মাছের অভয়াশ্রম টাঙ্গুয়ার হাওর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ রামসার সাইট হিসেবে পরিচিত। হাওরের উত্তর দিগন্তে মেঘছোঁয়া তিন-চার হাজার ফুট উচ্চতার সবুজ মেঘালয় পাহাড়। এখানে শাপলা ফোঁটা জলে দল বেধেঁ নানা প্রজাতির পাখি ডুবসাঁতারে গুগলি শামুক খায় প্রতিনিয়ত। হেমন্তে ‘কোমরে খলই বাঁধা কাঁধে ঠ্যালা জাল’ নিয়ে দল বেঁধে মাছ ধরতে যাওয়ার দৃশ্য দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় পর্যটকদের। গোধূলির সোনালি মেঘে যেন রোমান্টিক হয়ে ওঠে টাঙ্গুয়া। ফুরফুরে বাতাসে নৌকার ছইয়ে বসে দোল খাওয়া এক অনাবিল আনন্দ দোলা দিয়ে যায় মনে।
হাওরে ভাসতে থাকা সূর্র্যোদয়ের লৌহিত আলোয় ¯œাত হিজল, করচসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ-গুল্ম আর অতিথি পাখির কলরবে মুগ্ধ করে তোলে সকাল। নানা ধরনের পাখির কিচিরমিচিরে সৃষ্টি হওয়া আবহ পাখিপ্রেমিকদের সহজেই নিয়ে যায় অন্য এক ভুবনে।
সব মিলিয়ে নিসর্গের অর্পূব এক মিলনমেলা টাঙ্গুয়া যেন পর্যটনের স্বর্গরাজ্য। আর তারই টানে এখানে প্রতিদিন ছুটে আসে শত শত পর্যটক। স্থানীয় প্রশাসন বলছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হলে এবং থাকা-খাওয়ার ভালো পরিবেশ থাকলে আরও বেশি পর্যটক ভিড় বাড়বে এ এলাকায়।
৯৭ দশমিক ২৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের টাঙ্গুয়ার হ্ওারে ৫২টি বিল ও ১২০টি কান্দা রয়েছে। ১৪১ প্রজাতির মাছ, ২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২১৯ প্রজাতির পাখি, ৯৮ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি, ১২১ প্রজাতির দেশীয় পাখি, ২২ প্রজাতির পরিযায়ী হাঁস, ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২৯ প্রজাতির সরিসৃপ, ১১ প্রজাতির উভয়চর অসংখ্য জলজ, স্থলজ ও জীববৈচিত্র্য রয়েছে এই অন্যন জলাশয়ে।
টাঙ্গুয়া তথা তাহিরপুরের দর্শনীয় স্থানগুলো পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে এবং পর্যটন উপযোগী অবকাঠামো গড়ে তোলার দাবিতে আসছে ১৬-১৭ সেপ্টেম্বর দুই দিনের জ্যোৎ¯œা উৎসবের আয়োজন করেছে তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসন। এই উৎসবে থাকছে ৫০টি নৌকা ও লঞ্চযোগে পর্যটকদের নিয়ে হাওর ঘুরে দেখা এবং রাত্রীযাপন। থাকবে বিনোদনের ব্যবস্থা।
এ ব্যাপারে উৎসবের পরিকল্পনাকারী তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, প্রতিদিন শত শত মানুষ টাঙ্গুয়ার হাওর দেখতে আসে। পর্যটন অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে তারা হাওরের ও অন্যান্য সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে না। নেই থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা। আমরা এই উৎসবের মাধ্যমে একদিকে পর্যটন সম্ভাবনাকে তুলে ধরতে চাই, অন্যদিকে পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানাব। তিনি বলেন, বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যে কেউ নামমাত্র খরচে এই উৎসবে যোগ দিতে পারবে।
হযরত শাহ আরেফীন (রহ.)-এর আস্তানা
তাহিরপুর সদর থেকে মাত্র আট কিলোমিটার উত্তরে রয়েছে অপরূপ দর্শনীয় স্থান ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম সফরসঙ্গী সাধক পুরুষ হজরত শাহ আরেফীন (রহ.)-এর স্মৃতি বিজড়িত পুণ্যভূমি লাউড়গড় শাহ আরেফীন আস্তানা। আস্তানার দুই কিলোমিটার দক্ষিণে রয়েছে অদ্বৈত মহাপ্রভুর আখড়া। দুই ধর্মের দুই সাধক মহাপুরুষের ভক্তরা বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে দুই ধর্মের মিলনমেলা বসায় এখানে। এ ছাড়া প্রতিদিন দেশি-বিদেশি আউলিয়া আর ভক্তরা সমবেত হন সেখানে। চলে দিবা-রাত্রি আবহমান গ্রামবাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী বাউল, জারি, সারি, মোর্শিদি, ভাটিয়ালিসহ মরমি সাধক হাছন রাজা ও বাউলসম্্রাট শাহ আব্দুল করিমের গান।
যাদুকাটা নদী
হজরত শাহ আরেফীন (রহ.)-এর আস্তানার পশ্চিম পাশে তাকালেই চোখে পড়বে মেঘালয় পাহাড়ের বুক চিড়ে নেমে আসা ভারতের আসাম রাজ্যের গুমাঘাট স্টেইট এলাকা থেকে উৎপত্তি ২৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে খরস্রোতা সীমান্ত যাদুকাটা। নদীর পানি যেমন ঠান্ডা, তেমনি স্বচ্ছ। নদীর বুকে প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে বালি-পাথর আর শ্রমিকের জীবনযুদ্ধের খেলা। যেন শিল্পীর রং-তুলিতে আঁকা আবহমান গ্রামবাংলার এক মোহনীয় চিত্র। সেখানে প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক বালি আর নুড়িপাথর আহরণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে যুগে যুগে। সেই নুড়িপাথর ও বালু চলে যায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। নদীর বুকে ভেসে প্রতিদিন ভোরবেলা হাজার হাজার ছোট বারকি নৌকা নিয়ে শ্রমিকরা যখন নুড়ি ও বালি আহরণের জন্য নদীতে আসে, তখন রচিত হয় এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। তা ছাড়া রয়েছে গভীর জলরাশ্মির খেলা, যা দেখে সবারই ইচ্ছা জাগে নদীর বুকে সাঁতার কেটে স্বচ্ছ পানির সাধ উপভোগ করার। সেখানকার নদীতে গোসল করে ভেজা গায়ে কলসি কাঁখে জল নিয়ে বাড়ি ফেরা পল্লী বধূদের বালুচরে থেকে যাওয়া পায়ের চিহ্নের এমন দৃশ্য দেখে যে কাউকেই মনে করিয়ে দেবে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কপোতাক্ষ নদের কথা।
বারেকটিলা
যাদুকাটা নদীর খেয়া পেরোলেই দেখা যাবে নদীর পশ্চিম তীর ঘেঁষে রয়েছে নয়নাভিরাম প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু (৩৫৬ একর) বারেকটিলা। নদীর তীর থেকে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা উঁচু পথ বেয়ে টিলার উপর উঠলে চোখে পড়ে ঘন সবুজের সমাহার আর সারি সারি ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ। এখানে রয়েছে কড়ইগড়া ও রাজাই নামে দুটি আদিবাসী গ্রাম, তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির একটি গির্জা। আদিবাসীরা আপনাকে পুরো গ্রাম ও পাহাড় ঘুরে দেখতে সাহায্য করবে। এরা খুব পরিশ্রমী ও অতিথিপরায়ণ। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বাংলা বলার ভঙ্গিটা যে কাউকে আর্কষণ না করে পারে না। পাহাড়ের ওপর বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড জওয়ানদের টহলের জন্য রয়েছে একটি উঁচু মিনার, যা পর্যটকদের আরও কাছে টানে। টিলার ওপর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে তাকালে মনে হয় পুরো উপজেলাটি নিজের হাতের মুঠোয়। টিলা থেকে একটু দক্ষিণ দিকে চোখ মেললে দেখা যায় দেশের সবচেয়ে বড় শিমুল বাগান ‘আলহাজ জয়নাল আবেদীন গার্ডেন’।
টেকেরঘাট চুনাপাথর খনিজ প্রকল্প
এখানকার নিঝুম প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে যাবে এক কাব্যময় ভুবনে। ছোট ছোট টিলা আর ছায়াময় বৃক্ষঘেরা পুরো খনি প্রকল্প ঘুরে দেখলে নয়ন জুড়িয়ে যাবে। বর্তমানে বন্ধ থাকা টেকেরঘাট চুনাপথর খনিজ প্রকল্প থেকে একসময় ছাতক সিমেন্ট কারখানার কাঁচামাল সরবরাহ করা হতো। আছে একটি রেস্ট হাউজ । রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীরবিক্রম সিরাজের সমাধি।
(ঢাকাটাইমস/৬সেপ্টেম্বর/মোআ)