ভারতের ১৭ বছর বয়সী কিশোরী মালবিকা রাজ জোশি। মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হতে পারেননি। কিন্তু কম্পিউটারে অসাধারণ প্রতিভার কারণে তিনি বিশ্বের সেরা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি(এমআইটি)-তে পড়াশুনার সুযোগ পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কেমব্রিজ শহরে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মালবিকার ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পেছনে রয়েছে এক অনবদ্য গল্প। আর এই গল্পের নেপথ্যের নায়ক হচ্ছেন জোশির মা। যিনি পড়াশুনার প্রচলিত নিয়ম ভেঙে তার মেয়েকে গড়ে তুলেছেন। মালবিকা প্রমাণ করেছেন ‘নম্বর’ এর চেয়ে ‘মেধা’’র গুরুত্ব বেশি।
মুম্বাইয়ের এই কিশোরী বৃত্তি নিয়ে এমআইটি’র স্নাতক শ্রেণিতে পড়া-শুনার সুযোগ পেয়েছেন। এর আগে তিনি তিন বার(দুই বার রুপা এবং একবার ব্রোঞ্জ) ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিয়াড অব ইনফরম্যাটিক্স(আইওআই) বা প্রোগ্রামিং অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতায় পদক জিতেছেন।
অলিম্পিয়াডের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়(গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান, কম্পিউটার) যারা পদক অর্জন করেন তাদেরকেও এমআইটিতে পড়ার সুযোগ প্রদান করা হয়ে থাকে। মালবিকার এই প্রতিভাই তার প্রিয় বিষয় কম্পিউটার বিজ্ঞানে গবেষণা করার সুযোগ এনে দিয়েছে।
মালবিক সেইসব দিনগুলির কথা স্মরণ করেন যখন বোস্টন থেকে ই-মেইলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল।
মালবিকা বলেন, ‘আজ থেকে চার বছর আগে যখন আমি স্কুলের পাঠ্যক্রমের বাইরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অন্বেষণ শুরু করি তারমধ্যে একটি ছিল প্রোগ্রামিং। বিষয়টি আমার কাছে বেশ মজার মনে হয়েছিল। অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে প্রোগ্রামিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তখন থেকে বিষয়টি আমার পছন্দের তালিকার শীর্ষে ।’
এমআইটিতে সুযোগ হওয়ার আগে ভারতের প্রথম শ্রেণির প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে গেলে মালবিকা বিপাকে পড়েন। কারণ ওইসব প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান শর্ত ছিল ভর্তি হতে গেলে কমপক্ষে উচ্চ মাধ্যমিক পাস হতে হবে।
একমাত্র চেন্নাই ম্যাথম্যাটিক্যাল ইনস্টিটিউটে(সিএমআই) মাস্টার্স-এর সমমানের একটি কোর্সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় মালবিকা। কিন্তু তার জ্ঞান ছিল তখন স্নাতক পর্যায়ের।
ভারতের জাতীয় কম্পিউটিং অলিম্পিয়াডের সমন্বয়কারী এবং সিএমআইয়ের শিক্ষক মাধবন মুকুন্দ বলেন, ‘আইওআই’তে চমৎকার সাফল্যের জন্য মালবিকা এমআইটিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। এটি অবশ্যই এমআইটির মহানুভবতা। কারণ কোনো শিক্ষার্থী যদি তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পারেন তাহলে তার হাইস্কুল পাসের সনদপত্র না থাকলেও এমআইটিতে ভর্তির সুযোগ পাবেন।’
মালবিকার সাফল্যের গল্প শুরু হয় চার বছর আগে। যখন তার মা সুপ্রিয়া একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেন।
মুম্বাইয়ের দাদর পারসি ইয়ুথ অ্যাসেম্বলি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশুনা করতো মালবিক। তার অ্যাকাডেমিক ফলাফলও ভালো ছিল। কিন্তু তার মা তাকে স্কুল থেকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়।
সুপ্রিয়া তার এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার। মালবিকা স্কুলে ভালো করছিল। কিন্তু আমার মনে হলো প্রচলিত জ্ঞানের চেয়ে সন্তানদের ভালো থাকাটা বেশি জরুরি।’
‘আমি একটি এনজিও’র সঙ্গে কাজ করি। এনজিওটি ক্যানসার রোগিদের দেখাশুনা করে। আমি দেখেছি অষ্টম, নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ক্যানসারে আক্রান্ত। এই ব্যাপারটি আমাকে খুব ধাক্কা দেয়। তাই আমি সিদ্ধান্ত নেই, আমার কন্যাদের সুখী হওয়াটা জরুরি।’
এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়াটা সুপ্রিয়ার জন্য খুব সহজ ছিল না।
‘ভারতে ‘বাড়িতে পড়াশুনা’ বা ‘অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা’র বিষয়টির সঙ্গে অনেকেই পরিচিত নন। এর জন্য মালবিকার বাবাকে(একজন প্রকৌশলী যার নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে) বেশ সময় লেগেছে।’
সুপ্রিয়া আরও বলেন, ‘আমার সিদ্ধান্ত একটু ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তাই আমার স্বামী প্রথম দিকে রাজি হননি। আমাদের সন্তানরা মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক সনদ অর্জন করতে পারবে না। এই কারণে একটি ভয় তৈরি হয়েছিল। আমি আমার এনজিও’র চাকরি ছেড়ে দিলাম এবং মালবিকার জন্য একটি অ্যাকাডেমিক কারিকুলাম ডিজাইন করলাম। বাড়িতেই শ্রেণিকক্ষের মতো পরিবেশ তৈরি করলাম। মা হিসেবে আমার আত্মবিশ্বাস ছিল, কন্যাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করতে সক্ষম হব।’
‘হঠাৎ করেই আমি দেখলাম আমারে মেয়েরা খুব খুশি। আগের চেয়ে তারা ভালো শিখছে। মালবিকা সঠিক সময়ে ঘুমাচ্ছে এবং জেগে উঠছে। জ্ঞান তাদের কাছে আসক্তিতে পরিণত হলো।’
পর পর তিন বছর প্রোগ্রামিং অলিম্পিয়াডে ভারতের শীর্ষ চার জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে মালবিকাও ছিল। এই তিন বছর ধরে অলিম্পিয়াডের জন্য মালবিকাকে প্রস্তুত করেছে মাধবন।
তিনি তার মেধা সম্পর্কে বলেন, ‘গত তিন বছর মালবিকা গণিত এবং অ্যালগরিদম শেখার জন্য সিএমআইতে ব্যাপক সময় ব্যয় করেছেন। ইনফরম্যাটিক্স অলিম্পিয়াডের জন্য তার এক্সেল জানার প্রয়োজন ছিল। আইওআইয়ের প্রশিক্ষণের জন্য তাকে শিক্ষার অপ্রত্যাশিত শূন্যস্থান পূরণের দরকার ছিল। কারণ মালবিকা আনুষ্ঠানিকভাবে স্কুলে ভর্তি হয়নি।’
অন্যান্য অভিভাবকরা আপনার মেয়ের এমআইটিতে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার রহস্য জানতে চাইলে কি বলেন?
জবাবে সুপ্রিয়া হেসে বলেন, ‘তারা সবাই এমআইটিতে কীভাবে ভর্তির সুযোগ পাওয়া যায় তা জানতে চান। আমি তাদেরকে বলেছিলাম, মালবিকাকে এমআইটিতে ভর্তির করার কোনো টার্গেট আমাদের ছিল না। আমি অভিভাবকদের বলেছিলাম, সন্তানদের পছন্দ-অপছন্দগুলো বুঝার চেষ্টা করুন।’ সূত্র: এনডিটিভি।
(ঢাকাটাইমস/১সেপ্টেম্বর/এসআই/এআর/ঘ.)